১৯৭১ সালের ১৩ জুন। সকালটা মার্কিন জনসাধারণের জন্য একটি কর্মব্যস্ত স্বাভাবিক ছিল যতক্ষণ না তারা সংবাদপত্রের পাতায় তাদের চোখ রেখেছিল। পত্রিকার পাতাজুড়ে ছিল এমন কিছু চোখ ঝলসানো সত্য, এমন কিছু হকচকিত তথ্য যা প্রকাশিত হতেই বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিরই নয়, রীতিমতো বিশ্বজুড়ে তাদের যুদ্ধবাজ ধূর্ত পররাষ্ট্রনীতির ভিট কেঁপে যায়।
Advertisement
সকালের সংবাদপত্র হাতে নেওয়ামাত্রই যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ প্রকৃত সত্যটা জানতে পারে। জানতে পারে কীভাবে তাদের এতদিন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা রেখেছিল মিথ্যা তথ্যের পরতে বন্দি। কি সেই সত্য, যা ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে’ প্রকাশিত হতেই মুহূর্তেই তোলপাড় শুরু হয়ে যায় গোটা যুক্তরাষ্ট্রে? ধীরে ধীরে যার প্রভাব পড়ে পুরো বিশ্বে! এমনকি যা অবসান ঘটায় একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের! দ্যা পেন্টাগন পেপারস!
চলুন যাওয়া যাক ঘটনার গোড়ার দিকে। ১৯৩১ সালের ৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে জন্ম নেন ড্যানিয়েল এলসবার্গ-যিনিই কি-না পরে পেন্টাগন পেপারস নামের মার্কিন সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন নথি, সংবাদ মাধ্যমের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ছোট থেকেই প্রবল মেধাবী ড্যানিয়েল এলসবার্গ সেই প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও কর্মজীবনেও।
পেন্টাগন পেপারস নিয়ে কথা উঠলে ড্যানিয়েল এলসবার্গের শৈশব ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে কিছুতেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। কেননা তার ছোটবেলা ও পূর্বে অর্জিত শিক্ষা তাকে সরকার ও জনগণের মাঝে একটি সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারণা বিকাশে সাহায্য করেছে। আর সেটার অস্তিত্ব তিনি রেখে গেছেন তার পেন্টাগন পেপারস নামের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নথিগুলো প্রকাশ করার মাধ্যমেই। সে যাই হোক, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ ও ১৯৫৪ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক ও পর্যায়ক্রমে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে এলসবার্গ যোগদান করেন মার্কিন নৌ বাহিনীতে। সে সময় তাকে ভূমধ্যসাগর এবং কোরিয়া যুদ্ধ সফর করতে পাঠানো হয়। এরপর তিনি সামরিক বাহিনী ছেড়ে আবার হার্ভার্ডে আসেন অর্থনীতিতে পিএইচডি সম্পন্ন করতে। কিন্তু ড্যানিয়েল এলসবার্গ তখন ডিগ্রি না নিয়েই, পিএইচডি কার্যক্রম মাঝপথে রেখেই একজন কৌশলগত বিশ্লেষক হিসেবে র্যান্ড করপোরেশনে যোগদান করেন।
Advertisement
র্যান্ড কর্পোরেশন ছিল সে সময়ের ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা মনিকাভিত্তিক নীতি নির্ধারণের একটি থিংক ট্যাংক। র্যান্ড করপোরেশনে থাকাকালীনই মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ড্যানিয়েল এলসবার্গ। তিনি আমেরিকার পারমাণবিক অস্ত্রকৌশল উন্নয়ন ও সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণের দায়িত্বও পালন করেছেন এ সময়। এমনকি কিউবার ক্ষেপনাস্ত্র সংকটকালে, কিউবাতে আমেরিকার সম্ভাব্য আক্রমনের আকস্মিক কর্মপরিকল্পনা তৈরির মতো গোপন প্রকল্পেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
দীর্ঘ বৈচিত্রময় কর্মজীবনে ১৯৬৪ সালে ড্যানিয়েল এলসবার্গ র্যান্ড করপোরেশন ত্যাগ করে এবার যোগ দিলেন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামরিক বিশ্লেষক পদে। কর্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ পর্যবেক্ষণের জন্য ভিয়েতনামে পাঠালেন। সেখান থেকেই শুরু হলো এই পেন্টাগন পেপারসের মূল যাত্রা।
ভিয়েতনামে যাবার মধ্য দিয়ে ড্যানিয়েল এলসবার্গ খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন সেই যুদ্ধের বিভীষিকা এবং নানান গুপ্ত সত্য। তিনি খুব গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারেন এই যুদ্ধে মার্কিনীদের জেতা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তিনি আরও অবাক হয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন যে, যুদ্ধে অংশ নেওয়া মার্কিন সৈন্যরা ছিল ১৮ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে।
এমনকি এই বিতর্কিত যুদ্ধে যেন অংশ নিতে না হয় সেজন্য সে সময় অনেক তরুণ মার্কিন নাগরিক কানাডা পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর যারা অংশ নিয়েছিলেন ও বেঁচেছিলেন, যুদ্ধ শেষে অর্থাৎ পরবর্তী জীবন তাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কেটেছিলো।
Advertisement
যাইহোক, ঘটনাচক্রে এলসবার্গ আবারও ফিরে আসলেন র্যান্ড করপোরেশনে। সে সময়, অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট ম্যাকনামারা ভিয়েতনাম যুদ্ধের উপর গৃহীত আমেরিকান সরকারের সকল প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ওপর একটি সমীক্ষা প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন।
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সেই সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে ১৯৪৫ থেকে ১৯৬৭ সাল অবধি ভিয়েতনামের ওপর নেওয়া আমেরিকার যাবতীয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্তসমূহ। সেই মোতাবেক সমীক্ষা তৈরির জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং র্যান্ড করপোরেশন থেকে কিছু ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা হলো। ৩৬ সদস্যের সেই নির্বাচিত দলটিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ড্যানিয়েল এলসবার্গও।
এই সমীক্ষা তৈরির জন্য নির্বাচিত দলটিকে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গোপন ও জটিল উৎস যেমন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। এমনকি তারা সেসময় সমীক্ষাটি তৈরি করতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থারও সাহায্য নেন।
প্রায় ১৮ মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি প্রায় ৪৭ খণ্ড ও ৭ হাজার পৃষ্ঠার যে সমীক্ষাটি পাওয়া যায় তাতে স্পষ্ট হয় মার্কিন প্রশাসন ভিয়েতনাম যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্যগুলো সে দেশের সাধারণ নাগরিকদের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছিল। প্রস্তুত করা নথির চার হাজার পৃষ্ঠাতে সকল প্রকার ব্যখ্যা বিশ্লেষণ এবং ৩ হাজার পৃষ্ঠা ছিলো মূল বিষয় সংবলিত।
এসব সমীক্ষায় সরাসরি যেসব কর্তাব্যক্তিদের নাম উঠে আসে তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি ও লিনডন বি. জনসন ছিলেন অন্যতম। শীতল যুদ্ধের বশবর্তী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সরকারই চাচ্ছিলেন না ভিয়েতনামে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ প্রতিষ্ঠিত রূপ গ্রহণ করুক।
এ লক্ষ্যে তারা ভিয়েতনাম যুদ্ধকে আরও সম্প্রসারিত করেছিলো, যদিও সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের বারবার বলা হচ্ছিল আমেরিকা চায় না যুদ্ধ আরও দীর্ঘমেয়াদি হোক। এমনকি সে সময় যুদ্ধ বন্ধে তারা প্রতিটি সম্ভাব্য কূটনৈতিক সমাধানও সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। অথচ অকাতরে কম বয়সী যুবকদের যুদ্ধে পাঠিয়ে আমেরিকান সরকার প্রধানেরা ভুলে গিয়েছিলেন উত্তর ভিয়েতনামের কংগ্রেস বাহিনির শক্তিমত্তা সম্বন্ধে।
পরে সেই সমীক্ষাটি ‘রিপোর্ট অফ দা অফিস অফ দ্য সেক্রেটারি অফ দা ডিফেন্স ভিয়েতনাম টাস্ক ফোর্স’ নামে মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন নথি হিসেবে বিবেচিত হয়।
ড্যানিয়েল এলসবার্গের ছেলেবেলার শিক্ষা তাকে জনগণের সঙ্গে সরকারের এই ধোঁকা মেনে নিতে বাঁধা দিচ্ছিল। তিনি উপলব্ধি করছিলেন আমেরিকার সাধারণ নাগরিকদের জানা উচিত আসলে এই ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফলাফল কি হতে যাচ্ছে এবং রক্তক্ষয়ী এই সংঘাতে আমেরিকান সরকারগুলোর দায় সম্পর্কেও তাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
১৯৬৮ সালের মার্চে ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামে সংঘটিত মার্কিন সৈন্য কর্তৃক হামলা, ড্যানিয়েল এলসবার্গকে খুব বেশি প্রভাবিত করে। জনগণকে সরকারের গৃহীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সেদিনের এই ঘটনাটিও প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়।
তবে স্পর্শকাতর এই বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ও জটিল কাজ তা এলসবার্গ ভালোভাবেই জনতেন। কিন্তু আদর্শের কাছে মাথা না নুইয়ে তিনি পথ খুঁজতে থাকলেন, কিভাবে এই তথ্যগুলো মার্কিন সাধারণ নাগরিকদের সামনে তুলে ধরা যায়। সে রকম কোনো উপায়ান্তর না দেখে ড্যানিয়েল এলসবার্গ মার্কিন সিনেট সদস্যদের সাহায্য চাইলেন। তবে বেশ ক’জন সিনেট সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এলসবার্গকে আশাহত হতে হলো। সিনেট সদস্যরা কেউ-ই রাষ্ট্রীয় সেই সংরক্ষিত ও অতি গোপনীয় নথিগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরার সাহস পেলেন না।
এরপর এলসবার্গের খুব কাছের বন্ধু, যুদ্ধবিরোধী কর্মী এবং দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক বেন বাগদিকিয়ান তাকে পরামর্শ দেন ওয়াশিংটন পোস্টে এই মূল্যবান নথিগুলো প্রকাশ করতে। ড্যানিয়েল এলসবার্গ সে পরামর্শ সানন্দে গ্রহণ করেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তখন, যখন দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এত গুরুত্বপূর্ণ নথি ছাপাতে তাদের অপারগতা প্রকাশ করে।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের কর্তাব্যক্তিরা তখন এলসবার্গকে পরামর্শ দেন প্রথমে দ্য নিউ ইউর্ক টাইমস পত্রিকায় এই তথ্যগুলো ছাপাতে। বলে রাখা ভালো, দ্য নিউইউর্ক টাইমস সে সময় অনুসন্ধানমূলক ও আক্রমণাত্মক সংবাদ ছাপানোয় অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হত। এমনকি এই পত্রিকা সেসময় নানান ঝুঁকি সত্ত্বেও সরকারের গোপন কর্মকাণ্ড সংবলিত নথিগুলো প্রকাশ করতে খুবই আগ্রহী ছিল।
এজন্য ড্যানিয়েল এলসবার্গের আর বেশি সময়ক্ষেপণ করতে হলো না। দ্য নিউ ইউর্ক টাইমস পত্রিকা সাদরে গ্রহণ করলো তার প্রস্তাব। এরপর এলসবার্গ, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক নিল শিহানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গোপন সেই নথিগুলোর কপি হস্তান্তর করেন। নিল শিহান তখন হিলটন হোটেলের গোপন কক্ষে বসে ফক্স বাটারফিল্ড, হেড্রিক স্মিথের মতো বেশ ক’জন সাংবাদিকের সাথে সেই কপিগুলো পর্যালোচনা করতে শুরু করলেন।
এরপর দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে ১৯৭১ সালের ১৩ই জুন সেই নথির প্রথম পর্ব পেন্টাগন পেপারস নামে প্রকাশিত হলো নিউ ইয়র্ক টাইমসে। প্রকাশের পরপরই ব্যাপক আলোড়ন তোলা এই নথি, মার্কিন প্রশাসনকে চরমভাবে ধাক্কা দিলো এবং সমগ্র সাংবাদিকতা ইতিহাসে স্থান পেলো এক সুদুরপ্রসারী মাইলফলক হিসেবে।
প্রথম পর্বের পরদিন একই নামে পুনরায় প্রকাশিত হয় সে নথিগুলোর পরবর্তী পর্ব। তবে এতকিছুর মধ্যেও কিন্তু পিঁছিয়ে থাকেনি দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রটিও। যেহেতু তাদের কাছে এই সম্পর্কিত কোনো ডকুমেন্ট ছিল না, তবুও তারা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের উদ্ধৃতি দিয়ে পেন্টাগন পেপারসের প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকলো।
এদিকে তখন ক্ষমতায় থাকা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসন এ নথি প্রকাশ থামাতে রীতিমতো তোড়জোড় শুরু করে দেয়। তারা এত স্পর্শকাতর একটা নথি প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টিকে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে অভিহিত করে। এজন্য যেকোনো মূল্যে এ তথ্যাদি প্রকাশ করা থেকে দ্য নিউ ইউর্ক টাইমস ও দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাকে বিরত থাকতে ও সতর্ক হতে বলে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পেন্টাগন পেপারস নামে সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা বলবৎ রাখতে চাইলে নিক্সন প্রশাসন পত্রিকাটির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা করে। ফলশ্রুতিতে এ প্রতিবেদন প্রকাশ থেকে সাময়িকভাবে বিরত থাকতে হয় দ্য নিউ ইউর্ক টাইমস পত্রিকাকে।
তবে থেমে থাকেননি ড্যানিয়েল এলসবার্গ। তিনি দ্রুত পেন্টাগন পেপারসের বাকি নথিগুলো ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে সরবরাহ করেন। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়ে মার্কিন প্রশাসন কর্তৃত তাদের ওপরও এসে পরে মামলার ভয়ভীতি প্রদর্শন। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট সেই ভয়ভীতির তোয়াক্কা না করে নিজ কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।
সময় যত গড়াতে থাকে মামলা সংক্রান্ত জটিলতা ঘোর থেকে ঘোরতর হয়। আমেরিকান প্রশাসন দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের বিরুদ্ধেও মামলাজুড়ে দেয় এবং সেই মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সে বছরের ২৫ জুন শুনানি শেষে ৩০ জুন সুপ্রিম কোর্ট পত্রিকা দুটিকে বিজয়ী ঘোষণা করে এই রায়ে উপনীত হন যে, জনসাধারণের অধিকার রয়েছে রাষ্ট্রের যেকোনো তথ্যাদি সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা রাখার।
সেদিনের সেই রায়ে নিক্সন প্রশাসন হেরে গিয়ে জিতে যায় সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। এই ঐতিহাসিক রায়, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতায় মার্কিন নাগরিকদের জনমত গড়ে তুলতেও সাহায্য করে। এই রায়ের ফলশ্রুতিতেই আমেরিকার সরকার প্রধানেরা সংবাদমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ হ্রাস করতে বাধ্য হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষগুলো আস্থা হারায় তাদের সরকারের নেওয়া যাবতীয় পদক্ষেপের ওপর থেকে।
বলে রাখা ভালো আমেরিকার সরকার শুধু দ্য নিউ ইউর্ক টাইমস ও দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের ওপরই নয় বরং ড্যানিয়েল এলসবার্গ ও তার মিত্রদের ওপরও দেশদ্রোহীতার মামলা করে। তবে সে মামলাও বেশিদিন ধোপে টেকেনি। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতেই এলসবার্গ ও তার সহযোগী বন্ধুদের নির্দোষ ঘোষণা করেন আদালত।
সে যাই হোক, এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গণমাধ্যম পুরোদমে পেন্টাগন পেপারসের ওপর কাজ শুরু করে। একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের কূটচাল। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, শেষমেশ ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় আমেরিকার সরকার।
পেন্টাগন পেপারসের কথা উঠলে ড্যানিয়েল এলসবার্গও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন পৃথিবীর সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে। ইতিহাস বদলে দেওয়া এই ঘটনা, আমাদের মনে করিয়ে দেয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা। প্রকৃতপক্ষে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয় বরং আস্তে আস্তে সারা বিশ্বে পেন্টাগন পেপারসের এমনই সাড়া ফেলে দেয় যে, আজও গণমাধ্যম ও সরকারের সম্পর্ক বোঝাতে উজ্জ্বল ও অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে চলে আসে দ্যা পেন্টাগন পেপারস।
এমআরএম