তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর থেকে বারবার প্রশ্ন উঠছে- এত বড় ট্র্যাজেডি কি এড়ানো যেতো না? কিংবা প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সরকার মানুষের জীবন বাঁচাতে আরও কিছু কি করতে পারতো না?
Advertisement
১৯৩৯ সালের পর তুরস্কে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প। এটি টানা ২০ বছর ক্ষমতায় থাকা এরদোয়ানের ফের ক্ষমতায় বসা ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
ভূমিকম্পপরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু ভুল হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। তবে এমন বিপর্যয়ের পেছনে ভাগ্যকে দোষারোপ করেছেন তিনি। বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা সবসময় ঘটেছে। এটি নিয়তির অংশ।
সতর্ক করা হয়েছিলতুরস্ক দুটি ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত। এর কারণে দেশটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের হুমকিতে রয়েছে, এ বিষয়ে অতীতে বহুবার সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু খুব কম মানুষই ধারণা করেছিলেন, ভূমিকম্পটি পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট বরাবর আঘাত হানবে।
Advertisement
এই ভূমিকম্পের প্রভাব দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ বড় কম্পন উত্তরের ফল্টে আঘাত করেছে।
আরও পড়ুন>> ‘চারদিকে লাশের গন্ধ’
২০২০ সালের জানুয়ারিতে তুরস্কের এলাজিগে একটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। স্থানটি গত সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) আঘাত হানা অঞ্চলের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত।
তখন ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ব প্রকৌশলী অধ্যাপক নাসি গোরুর এ ধরনের একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের ঝুঁকি অনুমান করেছিলেন। এমনকি আদিয়ামান এবং কাহরামানমারাস শহরের উত্তরে পরবর্তী ভূমিকম্প আঘাত হানার সতর্কবার্তাও দিয়েছিলেন তিনি।
Advertisement
অধ্যাপক নাসি বলেন, আমি স্থানীয় সরকার, গভর্নর এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করেছিলাম। বলেছিলাম, দয়া করে শহরগুলোকে ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত করার ব্যবস্থা নেন। আমরা যেহেতু ভূমিকম্প থামাতে পারবো না, তাই এর ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হবে।
আরও পড়ুন>> ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া কি সত্যিই সম্ভব?
তুরস্কের অন্যতম ভূমিকম্প প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুস্তাফা এরদিকের ধারণা, বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করে ভবন নির্মাণের জন্যই এবার এত বেশি ক্ষতি হয়েছে। নির্মাণ শিল্পের অজ্ঞতা এবং অযোগ্যতাকেও দায়ী করেছেন তিনি। তার মতে, এসব ক্ষতি প্রতিরোধ করা উচিত ছিল।
আরও পড়ুন>> জীবিত উদ্ধার এখন ‘অলৌকিক’ ঘটনা
তুরস্কে ভূমিকম্পরোধী যে বিল্ডিং কোড রয়েছে, সেটি ৮০ বছরের পুরোনো। ২০১৮ সালে হালনাগাদ হওয়া নিয়ম অনুসারে, উচ্চমানের কংক্রিটকে রিবড ইস্পাত বার দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। লম্বালম্বি কলাম এবং আড়াআড়ি বসানো বিমগুলোর কম্পনের প্রভাব শোষণের সক্ষমতা থাকতে হবে।
অধ্যাপক মুস্তাফা বলেন, সব নিয়ম মেনে চললে কলামগুলো অক্ষত থাকতো এবং ক্ষয়ক্ষতি বিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। কিন্তু কলামগুলো ভেঙ্গে পড়ায় প্রতিটি তলা একে অপরের ওপর ধসে পড়েছে। এ কারণে এত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
ভূমিকম্প কর রহস্যতুরস্কে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড না মানার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশটির বিচারমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেছেন, এই কোড লঙ্ঘনকারীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
কিন্তু ভবন নির্মাণে দুর্নীতির বিষয়ে অনেকেই তুর্কি সরকারের সমালোচনা করেছেন। বিরোধী দল সিএইচপি’র নেতা কামাল কিলিকদারোওলু বলছেন, ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সরকার ভূমিকম্পের জন্য দেশকে প্রস্তুত করতে পারেনি।
১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের পরে ‘ভূমিকম্প সংহতি কর’ নামে তহবিল তৈরি করা হয়েছিল। বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানির ভয়েস এবং মেসেজিং সার্ভিসের ওপর কর, ইন্টারনেট সেবা, ক্যাবল টিভি ও রেডিও’র ওপর কর আরোপ করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে তুর্কি সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছিল প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার।
আরও পড়ুন>> যে দৃশ্যে বুক কাঁপে
এই তহবিল দিয়ে ভূমিকম্পপ্রতিরোধী ভবন তৈরি এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় খরচ করার কথা ছিল। কিন্তু সেই অর্থ শেষপর্যন্ত কোথায় গেছে, তা জানা যায় না। এর কোনো ব্যাখ্যা সরকারের কাছ থেকে কখনোই পাওয়া যায়নি।
নগর পরিকল্পনাবিদরা অভিযোগ করেছেন, তুরস্কের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে নিয়ম মেনে ভবন তৈরি করা হয়নি। যারা নিয়ম না মেনে ভবন নির্মাণ করেছিল, তাদের সামান্য কিছু আর্থিক জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে প্রায় ৬০ লাখ ভবন অপরিবর্তিত অবস্থায় থেকে যায়।
২০১৯ সালে ইস্তাম্বুলে একটি আবাসিক ভবন ধসে ২১ জন নিহতের পর তৎকালীন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার চেম্বার প্রধান বলেছিলেন, এই সাধারণ ক্ষমা তুরস্কের শহরগুলোকে কবরস্থানে পরিণত করবে।
আরও পড়ুন>> বেঁচে আছে ধ্বংসস্তূপের নিচে জন্মানো শিশুটি
ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেলিন পিনার গিরিটলিওগ্লুর বলেন, এবারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি শহর থেকে এক লাখেরও বেশি আবেদন জমা পড়েছিল। এসব এলাকায় বিল্ডিং কোড না মেনে বহু ভবন নির্মাণ হয়েছে। সবশেষ ভূমিকম্পে এত ভবন ধসে পড়ার পেছনে সরকারের সাধারণ ক্ষমা অন্যতম প্রধান কারণ।
অধ্যাপক মুস্তাফার মতে, এই সমস্যার পেছনে আরেকটি বড় কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে অনেক প্রকৌশলী নামমাত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে সরাসরি অনুশীলনে নেমে পড়েন।
তিনি বলেন, আমরা একে অপরকে দোষারোপ করে কিছু করতে পারবো না। আমাদের সমাধান খোঁজা উচিত। এখন নীতিনির্ধারকদের একত্রিত হয়ে জনগণ, অবকাঠামো, ভবন ও আশপাশের এলাকাগুলোকে ভূমিকম্পপ্রতিরোধী হিসেবে গড়ে তুলতে নীতি প্রণয়ন করা দরকার।
সূত্র: বিবিসি বাংলাকেএএ/