মতামত

সংবেদনশীল পুলিশই স্মার্ট পুলিশ

৪৭ বছর পেরিয়ে ৪৮ বছরে পদার্পণ করল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। আজ শনিবার পালিত হবে ডিএমপি’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। জননিরাপত্তা বিধান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ১৯৭৬ সালে ১২টি থানা নিয়ে শুরু হওয়া ডিএমপি এখন ৫০টি থানা আর ৩৪ হাজার সদস্য নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে বড় ইউনিট।

Advertisement

প্রতিবারই দিবসটি ঘটা করে পালন করে ডিএমপি। এবং প্রতিবারই উচ্চারিত হয়, ডিএমপি বদলাচ্ছে কতটা। ডিজিটাল বাংলাদেশ শ্লোগানের বর্তমান সরকার এবারের নির্বাচনী বছরে নিয়ে এসেছে স্মার্ট বাংলাদেশ শ্লোগান। ডিএমপি কর্তারাও মনে করছেন, তারা ডিএমপি-কে স্মার্ট বাংলাদেশের উপযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলবেন।

স্মার্ট পুলিশ মানেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে একটি দৃশ্য। কেতাদুরস্ত পোশাক, বৃহদাকারের আধুনিক গাড়ি ও যানবাহন, আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত একটি বাহিনী, যাদের জীবন ঝা চক চকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো পুলিশ কী কোন বাহিনী? নাকি মানুষের জন্য গঠিত একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান?

পুলিশের চ্যালেঞ্জটাই এখানে। এটি একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান, আবার তাকে আইন প্রয়োগ করতে হয় এবং আইন প্রয়োগ মানেই বল প্রয়োগও বটে। সরকারের যতগুলো সংস্থা আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে দৃশ্যমান হলো পুলিশ। ফলে তার একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলা কঠিন কাজ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সবসময় বলেন, পুলিশদের মানবিক ব্যবহার করতে হবে। সহৃদয়তা দিয়ে মানুষের ভালোবাসা আকর্ষণ করতে উৎসাহ দেন তারা। কিন্তু মানুষ কীভাবে পুলিশকে দেখে সেটা জানতে হলে তাদের সাথে যোগাযোগটা বাড়ানো দরকার বেশি করে।

Advertisement

কম্যুনিটি পুলিশ, বিট পুলিশ করে তার একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। কিন্তু মানুষ মনে করে পুলিশের ব্যবহার নির্বতনমূলক। থানা হাজতে আসামীকে নিষ্ঠুর ভাবে প্রহার করা পুলিশের স্বাভাবিক ব্যবহার।

একটা সাধারণ ধারণা এটাও যে, পুলিশ চাইলে যে কারও বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি করতে পারে, কেবল সন্দেহের বশে যে কাউকে বন্দি করতে পারে, স্বীকারোক্তি আদায় করতে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করে মৃত্যুর ভয় দেখাতে পারে, এমনকি তাৎক্ষণিক বিচারে অভিযুক্তকে মেরে ফেলতেও পারে। সন্দেহ নেই যে এগুলো ভ্রান্ত ধারণা। তবে অনেক সময়ই থানা হাজতে বা পুলিশের হেফাজতে আসামীর মৃত্যু সংবাদে মানুষ অবাক হয় না।

স্মার্ট পুলিশের কাজ হবে মানুষের সেই ধারণা বদলে দেওয়া। পুলিশ সেবাধর্মী অনেক কাজ করে। করোনাকালে আমরা ডিএমপিসহ সারাদেশেই পুলিশ সদস্যদের মানবিক কাজের দৃষ্টান্ত দেখেছি। এই শহরে, এত মানুষের ঠাসাঠাসি বসবাসেও চুরি, ডাকাতি, খুনসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণের রাখতে দিনরাত কাটছে পুলিশ। আগের আইজিপি, বর্তমান আইজিপি, বর্তমান ডিএমপি কমিশনারসহ বড় কর্তারা সবসময় বলছেন, তারা বাংলাদেশ পুলিশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন।

কিন্তু তবুও, মানুষ কেন মনে করে যে, পুলিশ মানবাধিকার কিংবা আইনকে পদপিষ্ট করতে দ্বিধা করে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। কিন্তু এর দায় কেবলমাত্র কী পুলিশের? রাজনীতি এবং প্রশাসনের দায় কী নেই? আমাদের মনে রাখা প্রযোজন যে, সুশাসনের ঘাটতির কারণেই আইন হাতে তুলে নিতে এবং নাগরিক অধিকার নস্যাৎ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে পুলিশ।

Advertisement

পুলিশের প্রধান কাজ, আইন মেনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসকের কাজ, পুলিশকে তার এই মৌলিক দায়িত্ব নির্বিঘ্নে পালন করতে দেওয়া। সেটা কতটা করতে পারে বা করছে, তা দৃশ্যমান নয়। রাজধানীর থানাগুলোর পরিবেশ আগের চাইতে আনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু পাবলিক প্লেস হিসেবে থানাগুলোতে সাধারণ মানুষের চেয়ে এখনও চিহ্নিত সমাজ বিরোধীদের আধিক্যই বেশি। থানায় একজন নারী, একজন প্রতিবন্ধী, একটি শিশু, একজন বয়স্ক মানুষ কেন নিরাপদ বোধ করেনা সেটা বিবেচনায় নিয়ে পরিবর্তনের কাজ করাই অগ্রাধিকার।

সংবেদনশীল পুলিশই আধুনিক পুলিশ, স্মার্ট পুলিশ। থানার পরিবেশ নিয়ে কথা বললে, বলতে থানার ভেতর আর বাইরে থাকা গাড়ি, মোটরসাইকেল নিয়েও। আমরা দেখছি বছরের পর বছর থানার সামনে পড়ে থাকছে পুরনো গাড়ি ও মোটরসাইকেলের স্তূপ। তাতে বৃষ্টির পানি জমে মশার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠছে।

ডিএমপির অধীনেই বিশাল ট্রাফিক বিভাগ। এবং ঢাকার মানুষের নিত্যদিনের যন্ত্রণার নাম যানজট। মানুষ দৃশ্যত পুলিশকেই দেখতে পায় যানজট নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু যারা সড়ক বানায় তাদের নির্মাণ ত্রুটি চোখে পড়েনা মানুষের। অত্যন্ত নিম্নমানের পরিবহন ব্যবস্থার জন্য যে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের নৈরাজ্য আছে এবং সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা আছে সেটাও ভুলে গিয়ে পুলিশকেই আসামীর চোখে দেখে মানুষ। এই বিষয়টার একটা স্বচ্ছ চিত্র জনতার সামনে উপস্থিত করতে হবে স্মার্ট পুলিশকে। ধরা পড়বার ভয়ে নয়, বরং তাঁদের দেখে সাধারণ মানুষ নিয়ম মানতে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন, এই বোধ জাগতে হবে প্রতিটি পুলিশ কর্মীর হৃদয়ে। এই বোধটি তৈরি করবার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের। আসলে পুলিশ ততক্ষণই কার্যকর, যতক্ষণ অবধি সাধারণ মানুষের মনে তাদের প্রতি সমীহ থাকে। এবং, সেই সমীহ অর্জনের প্রকৃষ্টতম পন্থা আইনের প্রতি দৃশ্যত দায়বদ্ধ থাকা।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/জিকেএস