মতামত

গরুর গায়ে লেখা ‘আমি বই পড়ি না’

বইমেলার ভেতর একটি গরু বাঁধতে চাই। গরুর গায়ে লেখা-“আমি বই পড়ি না”।খুব কি খারাপ আইডিয়া? বই না পড়লে মূর্খ গরুই তো হতে হয়। আইডিয়া আমার না। প্রখ্যাত লেখক ও সম্পাদক সরদার জয়েনউদ্দীন এর। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে বইমেলার আয়োজন করলেন। মেলার ভেতরে তিনি সত্যি সত্যিই একটি গরু বেঁধে রেখেছিলেন। গরুর গায়ে লেখা, “আমি বই পড়ি না”।

Advertisement

বাংলার মাটিতে বইমেলার শুরু হয়েছিল সরদার জয়েনউদ্দীনের হাত ধরে। ১৯৬১ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সহকারী প্রকাশনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। একাডেমির সংগৃহীত বিদেশি বই ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড অব বুকস পড়ে জানলেন, বইয়েরও মেলা হতে পারে। ১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল বুক সেন্টারে (বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র) গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে এবং পরে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় যুক্ত হন ইউনেস্কো শিশুকিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একট প্রকল্পে।

ইউনেস্কোর শিশুসাহিত্য বিষয় নানা উপকরণ সংগ্রহের কাজ করতে হ’ল। ১৯৬৫ সালে পাবলিক লাইব্রেরির নিচতলায় শিশুসাহিত্য বিষয়ক ইউনেস্কোর উপকরণগুলো সাজিয়ে শুরু করলেন বইমেলা। (সূত্র: শামসুজ্জামান খান, বইমেলার ইতিহাস ও নতুন আঙ্গিকে বইমেলা)

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বইমেলাপ্রেমী সরদার জয়েনউদ্দীন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হলেন। ইউনেস্কো ১৯৭২ সালকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ ঘোষণা করেছিল। তিনি এই উদযাপন উপলক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করেন।

Advertisement

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার শুরু হয়েছে এভাবেই, আন্তর্জাতিক বইমেলার মাধ্যমে। তবে একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী, মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলাম কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন। (সূত্র: জালাল ফিরোজ, অমর একুশে বইমেলা: সত্তরের দশক)

১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এই বইমেলার নাম ছিল বাংলা একাডেমি বই মেলা। ১৯৮৪ সালে হয়ে যায় অমর একুশে বইমেলা। বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক কাজী মুহম্মদ মনজুরে মওলা এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন,“পরিবর্তনটা কেবল নামে নয়। বাংলা একাডেমির বইমেলা মানে বাংলা একাডেমির না [বা] কোনো একটি সংস্থার বইমেলা। অমর একুশে গ্রন্থমেলা মানে সারাদেশের মানুষের গ্রন্থমেলা। অমর একুশের সাথে যার সম্পর্ক কখনো ছিন্ন করা যাবে না।” (সূত্র: কাজী মুহম্মদ মনজুরে মওলা, একুশের প্রবন্ধ ২০০৫, খাজা কামরুল হক ও অন্যান্য (সম্পাদিত))

সমৃদ্ধ দেশের কাতারে জায়গা নিতে ছুটছে বাংলাদেশ। সে দেশে মূর্খ গরুর সংখ্যা কমানোর অতি জরুরি কাজটি করতে হলে অমর একুশে বইমেলাকে আরও সক্রিয় ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে হবে। ভাবতে হবে, অমর একুশের বইমেলার মূল উদ্দেশ্য কি? বই পড়ুয়া জাতি গড়ে তোলা? সেই কবে থেকে মেলার পথ চলা শুরু, জাতি কি বই পড়ুয়া হতে পেরেছে? মানুষকে বই পড়ুয়াতে পরিবর্তন করতে করতে বই নিজেও তো কত বদলে গেছে।

পাথরের উপর লেখা বই হারিয়ে গেছে। চামড়ার বই, সে-ও নেই। হাতে লেখা বই কোথাও আর লেখে না কেউ। ছাপার অক্ষরেরও তো কত বিবর্তন হয়েছে। এখন ই-বুক, অডিও বুক নিয়ে ভাবছি। বই পড়ব কি, বই এখন নিজেই নিজেকে পড়ে শোনাতে পারে। স্মার্ট ফোনে অ্যাপস ডাউনলোড করে নিলেই ই-বুকের বিশাল ভান্ডার আঙ্গুলের খোঁচায় হাজির হয়। খুব ভালো লাগে ডিজিটাল বাংলাদেশের তরুণরা বাংলা বইয়ের আর্কাইভ গড়ে তুলেছে, অসংখ্য বইয়ের পিডিএফ লিংক পাওয়া যায়। ক্লিক করলেই বিনা মূল্যে ডিজিটাল ফরমেটে চির পরিচিত বইটি পড়তে পারছি। হয়তো, এই বইয়ের গায়ে বই বই গন্ধ নেই। তবুও তো বই।

Advertisement

ভাষা আন্দোলন আমাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, ভাষা আন্দোলনকে অন্তরে লালন করে বাংলা ভাষাকে সদাজাগ্রত রাখার মহান লড়াই আজ পর্যন্ত করে যাচ্ছেন বাংলা ভাষার লেখক, প্রকাশক ও পাঠকরা। নইলে বাংলা ভাষা মুখের ভাষায় টিকে থাক্, চাকরি পেতে সুবিধা হোক্, ইত্যাকার মহাবাস্তব ও জাগতিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ, আরও আপন করে তুলতে বাংলা ভাষার লেখকরা লিখে গেছেন, প্রকাশকরা বাংলা ভাষার সেরা বই প্রকাশ করেছেন এবং পাঠকরা বাংলা ভাষার বই পড়েছেন।

এই তিনের সম্মিলন ঘটেছে ভাষা আন্দোলনের স্মরণে শুরু হওয়া অমর একুশে বইমেলায়। বাংলা একাডেমিতে শুরু হওয়া এই বইমেলা যত দিন যাচ্ছে, তত বিস্তৃত হচ্ছে। যুগের হাওয়া মেনে নিয়ে ডিজিটাল প্লাটফর্মে বাংলা বইয়ের মেলা বসে গেছে। মাসব্যাপী বাংলা বইয়ের এরকম জমজমাট মেলা এখন বাংলাদেশের অহংকারের আয়োজন, বিশ^কে জানান দেওয়ার মতো উদাহরণ। ভাষা শহীদের উত্তরসূরি বাঙালিরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসে, এর প্রমাণ এই বইমেলা।

বই বিক্রি করে খরচ উঠিয়ে আনার সব আশা প্রকাশকদের পূরণ হয় না। বইমেলায় দর্শনার্থীদের ভিড় যত বেশি, বই ততটা বিক্রি হয় না। এই অভিযোগ প্রতি বছরের। কিনে বই পড়া পাঠকের সংখ্যা কম। কেনো? বই কিনে দেওলিয়া হয়ে যাওয়ার ভয় আছে বুঝি! আচ্ছা, দোকানে বহুমূল্য হিরে রাখা আছে, সে খবর ক্রেতা না জানলে কিনতে আসবেন কীভাবে? প্রতি বছর বহুমূল্য হিরের মতো মূল্যবান বই প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু সে খবর নায়িকা এক বৈঠকে কয়টি বরই খেয়ে ফেলেন, সে খবরের মতো পত্রিকার পাতায় সেই রকম করে ছাপা হয় না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় না।

পাঠকের রুচির ভিন্নতা আছে। আগ্রহের উঠানামা ঘটে নানা কারণে। রুচি আর আগ্রহ মিলিয়ে বই কিনতে চাই, কিন্তু সেই বইগুলোর খবর সহজে পাই না। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হয়তো নিজের আগ্রহে জেনে নেন কিছুটা, প্রান্তিক মানুষের কাছে বইয়ের খবর পৌঁছানোর জন্য কোন আগ্রহী মাধ্যম কি আছে? এখনো নেই। অথচ বাংলাদেশের বয়স আর বাংলা একাডেমি প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়া বইমেলার বয়স কি কম হ’ল?

লেখক ও প্রকাশক বন্ধুদের স্বীকার করে নিতে এই সত্য, অনেককেই বই পড়তে পছন্দ করেন না। অনেকেই মনে করেন, অর্থ উপার্জন করা (সীমাহীন) জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এবং এর জন্য ‘একটু চালাক-চতুর’ হলেই চলে। ছোটবেলায় যে পড়তাম, লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে...এই লেখাপড়া কিন্তু সার্টিফিকেট বাগানোর লেখাপড়া, কখনোই না পাঠ্য বইয়ের বাইরের কোন বই পড়া নয়। এর পাশাপাশি অনেকে এ-ও মনে করেন যে, ধর্মীয় পুস্তক পড়লেই চলবে, এর বাইরের অন্য বই পড়া বিপদজনক জ্ঞান দিতে পারে (যেমন ধরুন, বিবর্তনবাদ বিষয়ক বই কিছুতেই পড়া যাবে না)।

যে দেশে বেশিরভাগ মানুষের হাতে যে ধর্মগ্রন্থ, তাতে আহ্বান জানানো হয়েছে ‘পড়’, সে দেশে পড়ার কারবার নেই! অর্থ বুঝে ধর্মগ্রন্থ পড়তে হবে, এই ঐশি আদেশও আমরা মানি না। না বুঝে মুখস্ত পড়ছি। বুঝতে চাইছি না, কেননা তাতে মাথা খাটাতে হবে। এই যে মাথা খাটাতে না চাওয়াই আসলে বই না পড়ার মূল কারণ। আমরা আবেগে গদগদ হয়ে মুখস্ত বলে যাব, ডিজিটাল স্ক্রিনে রঙিন জীবনের মরিচীকাসম দৃশ্য দেখে মনের মাঝে মরুদ্যাণ খুঁজবো ঘন্টার পর ঘন্টা, মাথা খাটানোর কষ্ট কেন করবো?

আরেকটা কারণ আছে বই না পড়ার। মানুষ নানা জটিলতায় হাবুডুবু খায় বলে বিনোদন খোঁজে। বই অন্যসব বিনোদন মাধ্যমের মতো ঝাক্কাস বিনোদন দিতে পারে না। আর সেই বিনোদন পেতে হলেও তো পড়তে হবে। আমাদের দেশের শিশু-কিশোরদের কথা বাদ দিলাম, বড় মানুষদের ক’জন গড়গড় করে পড়তে পারেন? শিক্ষাজীবন কেবল পরীক্ষা পাশের জন্য পড়তেই ব্যয় হয়েছে, পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য পড়েছি কি? স্বস্তিতে পড়তে না পারলে পড়বো কেন?

কাজেই, বইমেলায় দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া দর্শনার্থীদের দেখে খুশি হতে পারি না। কেননা এদের মাঝে পাঠক যে অনেক কম। আর সেই অল্প সংখ্যক পাঠকও জানেন না, তার আগ্রহ মেটাতে পারে যে বই, সে বইটি কোথায় পাবেন। খুব আগ্রহ নিয়ে ঘুরতে শুরু করেন, একটু পরেই ধুলো ঠেলে ক্লান্ত হয়ে যান।

তখন, ‘এসেছি যখন, স্যুভেনির হিসেবে কিছু কিনে নিয়ে যাই’ মনোভাব নিয়ে আগে শোনা, চলতি ট্রেন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে নাম জানা লেখকের বই কিংবা প্রচ্ছদ দেখে ভালো লেগেছে এমন বই কিংবা এক মলাটের ভেতর একই দামে বেশি ‘মাল’ (গল্প বা কবিতা যাই হোক) পাচ্ছেন কি না, ভেবেচিন্তে পণ্য কিনে জিতে যাওয়ার মতো করে বই কেনেন। এরপর এই বই পড়েন কি না, পড়ে থাকে এক কোণে, তা জানতে বিস্তর গবেষণা করতে হবে।

আমার বইমেলায় আমি চাই বই বিক্রি মূল উদ্দেশ্য হবে না। বইমেলায় পাঠক আসবেন তার রুচি আর আগ্রহের সাথে মিলিয়ে বই খুঁজতে। যারা আসতে পারবেন না, তারাও জেনে যাবেন মেলা উপলক্ষ্যে দাঁড় করানো চমৎকার ডিজিটাল ক্যাটালগ থেকে (এবং এই কাজটি বাংলা একাডেমি চমৎকারভাবে করতে পারে)।

পছন্দের বই যে কোন স্থান থেকে অনলাইনে সংগ্রহ করা যাবে। আমি এ-ও চাই অমর একুশে বইমেলা আন্তর্জাতিক রূপ নিক্। নানান দেশের বইয়ের স্টল থাকবে, সেসব স্টলে থাকা বইয়ের সাথে প্রতিযোগিতা করবে আমাদের বই। বইমেলায় নানান দেশের পাঠক আসবেন, প্রকাশক আসবেন, অনুবাদক আসবেন, আসবে বই প্রকাশের ও বিক্রির আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

সবচেয়ে বড় চাওয়া হচ্ছে, আমি যাদের জন্য লিখি, সেই শিশুকিশোরদের নিজস্ব ক্রয়-ক্ষমতা নেই বলে অসহায়ের মতো পছন্দের বই হলেও কিনতে পারে না, তাদের পছন্দের মূল্য দেবেন বাবা-মা ও অভিভাবকরা। শিশুকিশোরদের উপহার দিতে হলেই সবাই বই উপহার দেবেন। স্কুল-কলেজে প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে থালা-বাটি নয়, বই-ই দেওয়া হবে।

আর হ্যাঁ, ‘বড় হয়ে কি হতে চাও’ টাইপের ফালতু প্রশ্ন না করে আমরা ওদেরকে ‘এখন তুমি কি বই পড়ছ?’ জাতীয় প্রশ্ন করবো, যাতে ওরা সারা বছর অপেক্ষা করে বইমেলার জন্য, কেননা বইমেলা তখন হয়ে উঠবে আনন্দভরা পছন্দের বইয়ের খোঁজ পাওয়ার ‘ওয়ান্ডার ল্যান্ড’!

লেখক: কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/জিকেএস