কৃষি ও প্রকৃতি

বিলের রাজা হেরন

সাদার মধ্যে হাল্কা ছাই রঙের আভা। মাথায় ঝুঁটি। গলায় লম্বা কেশর। ঠোঁট আর পা লাল। লম্বা ঠ্যাং। ছড়ানো সরু আঙুল। সাপের মতো গলা। স্থির হলুদ চোখ। ছোরার মতো ঠোঁট। উচ্চতা চার ফুট। ওজন পাঁচ থেকে আট পাউন্ড। ডানার বিস্তার সাত ফুট। এই হলো আমেরিকার সবচেয়ে বড় বক (হেরন)।

Advertisement

জলাভূমি, হ্রদ বা নদীর ধারে এদের দীর্ঘ গড়ন আর ধীর পদক্ষেপ চলে বেড়ানো দেখে সহজেই চেনা যায়। দক্ষ শিকারি এরা। মাছের অপেক্ষায় অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। শিকার পেলে নিমেষে আঘাত করে। দেশের সর্বত্র এরা অতি পরিচিত পাখি। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের দ্বীপ, কানাডা ও দক্ষিণ আলাস্কার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এদের দেখতে পাওয়া যায়।

আটলান্টিক মহাসাগর সংলগ্ন চেসোপেক উপসাগরে অনেক উপনদী এসে পড়েছে। এই উপনদীগুলোয় আবার অসংখ্য খাল এসে মিশেছে। এর দুপাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আছে বিশাল বনভূমি। এখানেই বকের আবাস-নিবাস। উঁচু উঁচু গাছের ডালে বাসা বাঁধে এরা। একেকটা গাছে দশ-বিশটি করে। এলাকাজুড়ে দেখা মেলে শত শত পাখির বাসা। মাছ, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, ব্যাঙ, সাপ, ইঁদুর প্রভৃতি ছোট প্রাণী ধরে খায়।

আরও পড়ুন: ফাহমিদার শখের পাখিতে সফলতা

Advertisement

বসন্তের শুরুতেই এই বক বা হেরনের বাচ্চা দেওয়ার সময়। বিভিন্ন দিক থেকে এরা তখন উড়ে এসে জমা হয় বিস্তীর্ণ উপকূলে বা খোলা মাঠে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই গায়ের রং তখন খুব উজ্জ্বল হয়। এ সময় এরা বাস তৈরি করে। অনেকেই আগের বছরের পুরোনো বাসা মেরামত করে নেয়। কেউ কেউ নতুন বাসা বানায়। পুরুষটা ডালপালা ভেঙে আনে আর মেয়ে পাখিটা বাসা বোনে। ডিমপাড়া আর বাচ্চা ফুটানো ছাড়া আর বাসার প্রয়োজন পড়ে না।

স্ত্রী পাখি প্রথমদিকে ১-২টি, পরে ৩-৪টি এবং শেষের দিকে ৫-৬টি ডিম পাড়ে। এ সময়ে এরা অত্যন্ত রাগী হয়ে পড়ে। কাউকে ঘেঁষতে দিতে চায় না বাসার কাছে। ২৮ দিনে বাচ্চা ফোঁটে। বাসার গর্তে নতুন বাচ্চা চুপটি করে পড়ে থাকে। যেন মাংসের একটি দলা। মা-বাবা তখন এদের ঠোঁটে করে নিজেদের পেটের অর্ধেক হজম করা খাবার উগরে খাওয়ায়। একটু বড় হলে মাছ, কাঁকড়া, ব্যাঙ এনে ঠোঁটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে বাচ্চার মুখে তুলে দেয়।

হেরন বা বকশিশুর মৃত্যুর হার অনেক। বাসায় অপেক্ষাকৃত বলবান শাবকটিই বেশিরভাগ খাবার খেয়ে নেয়। এদের প্রতিদিন নিজের ওজনের এক-চতুর্থাংশ খাবার লাগে। দুর্বল শাবক না খেয়েই মারা যায়। আবহাওয়া ভালো থাকলে রাতের বেলাও মা-বাবা খাবারের খোঁজে বেরোয়। জ্যোৎস্না রাতে এদের পানির ধারে চলাফেরা করতে প্রায়ই দেখা যায়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ছানার পালক গজায়। সে তখন বাসা ছেড়ে একটু একটু করে ডালে এসে বসে। সাত-আট সপ্তাহ পর্যন্ত ডালে ডালেই ঘুরে বেড়ায়। দৈবাৎ কেউ পড়েও যায় নিচে। একবার নিচে পড়লে আর উপরে আসার উপায় থাকে না। শিয়াল বা অন্য শিকারি পাখি ওদের ধরে নিয়ে যায়।

আরও পড়ুন: ১৪ বিড়াল নিয়ে তাপসীর ‘পুচি ফ্যামিলি’

Advertisement

নয় থেকে বারো সপ্তাহের মধ্যে ডানা আরও বড় হয়। কুৎসিত ছানাটি তখন এক সুন্দর পাখিতে পরিণত হয়। সে উড়ে বেড়ায় এ ডাল থেকে ও ডালে। এক সময় ভালোভাবে উড়ে যায় নদীর ধারে। মা-বাবার কাছে। কিছুদিন মা-বাবার সঙ্গে ঘোরে। মা-বাবার ঠোঁট থেকে খাবার খায়। নিজেও ধরার চেষ্টা করে মাঝে মাঝে। এ সময়ে মা-বাবার কাছে দ্রুত ধাবমান মাছ ধরতে শেখে। সদ্য খোলস ছাড়ানো কাঁকড়া চিনতে শেখে। এরপর শুরু হয় স্বাধীন জীবন। জীবনযাত্রার বাকি সবকিছু প্রকৃতিই এদের শেখায় সময়ের প্রয়োজনে।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও এমফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/জেআইএম