মতামত

নাচ জরিনা নাচ

কবুতর যেমন বারো মাসে তেরো জোড়া ডিম দেয়, তেমনি বাংলাদেশের জনৈক চিত্র পরিচালক বছরে ডজনাধিক ছায়াছবি চলচ্চিত্রামোদীদের উপহার দিয়ে থাকেন। সেজন্য এফডিসি পাড়ায় তাকে ‘কইতর’ পরিচালক হিসেবে অভিহিত করা হয়। এতে তিনি বিন্দুমাত্র বেজার হন না। লোকজন তো আর মিথ্যা বলে না! প্রকারান্তরে একটা প্রতিষ্ঠিত সত্যকেই স্বীকৃতি দেয় তারা।

Advertisement

এটাই বা ক’জনের ভাগ্যে জোটে? তবে একটা বিষয়ে তার দুঃখবোধ প্রবল; সেটা হলো, তার নির্মিত ছবি বক্স অফিস হিট পর্যন্ত করেছে অথচ আজ পর্যন্ত কোনো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনি পেলেন না। আচ্ছা, না হয় মানা গেলো-তার ছবির পাত্র-পাত্রীরা অধিকাংশই ইতর শ্রেণির যেমন সাপ-ব্যাঙ, হাতি-ঘোড়া, বেজি-শিয়াল, বানর-গরিলা, মোরগ-মুরগি ইত্যাদি এবং তাদের পুরস্কার দিলেও তারা গ্রহণ করবে কি না, এ নিয়ে সংশয় আছে; কিন্তু শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কারটি তাকে দিতে বাধা কোথায়?

দেশের মানুষই যদি সম্মান না করে, তাহলে বিদেশিরা কী করে সম্মান করবে? তিনি ভাবেন-হায়রে দুর্ভাগা বাংলাদেশ! দেশের কতিপয় অবিবেচক মানুষের অমানবিকতায় তোমার ললাটে অস্কার পুরস্কারটা বোধহয় জুটলো না। রবি ঠাকুর আর অমর্ত্য সেন তবুও যা হোক নোবেল পুরস্কার বাগিয়েছেন। এবার অস্কারটা পেলেই বাঙালি জাতির সম্মানের ঘোলকলা পূর্ণ হয়।’

নিজের জন্য তিনি ভাবেন না; কিন্তু দেশ ও জাতির স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেখানে তিনি যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। তবে মুশকিল হলো সিরিয়াস কোনো গল্পের প্লট তার মাথায় আসে না, যা দিয়ে প্রথমে দেশীয়দের এবং অতঃপর বিদেশীদের কুপোকাত করা যায়। অনেক ভেবে-চিন্তে গত বইমেলায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ‘আমি সখা তুমি সখী’-র লেখকের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

Advertisement

বাসায় ফোন করে লেখককে পাওয়া গেলো না। বলা হলো, তিনি অজ্ঞাতবাসে আছেন। অজ্ঞাতবাস কেন-এ প্রশ্নের কোনা সদুত্তর না দিয়েই লাইন কেটে দেওয়া হলো। এরপর তিনি অন্তত আরও পনেরো বার বিভিন্নজনকে দিয়ে টেলিফোন করিয়ে রহস্য উদ্ঘাটনের প্রয়াস চালালেন। কিন্তু ফলাফল সেই একই। ভগ্ন হৃদয়ে অসহনীয় কালযাপনের এক পর্যায়ে তাকে উদ্ধার করলো পাক্ষিক ঝরা পালক পত্রিকা।

ঝরা পালকের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদক লেখকের অজ্ঞাতবাস সম্পর্কে ছোট্ট একটা রিপোর্ট ছাপল। আর যায় কোথায়! তিনি গিয়ে সেই প্রতিবেদককে পাকড়াও করলেন এবং মোটা অংকের ‘টিপস’র বিনিময়ে লেখকের বর্তমান ঠিকানা উদ্ধার করে সন্ধ্যাবেলা সেখানে হজির হলেন।

লেখক: আরে ঘন্টু ভাই! আপনি?ঘন্টু: হু মন্টু ভাই, আমি। আপনে দরজা খুলতে এতো দেরি করতাছিলেন ক্যান? আমি আরও ভাবলাম অন্যরকম কেইস বুঝি! মন্টু: অন্য রকম মানে?ঘন্টু: অই আর কি! ইয়ে মানে আপনার উপন্যাসে যেমুনটা দেখা যায়। নায়িকা সংক্রান্ত।মন্টু: হাঃ হাঃ হাঃ, তা যা বলেছেন ভাই। নাহ! ওসব কিছু না। সান্ধ্যকালীন জলসেবায় গলা ভেজাচ্ছিলাম। এ সময় কয়েক ‘পেগ’ পেটে না পড়লে আমার আবার লেখার মুড আসে না। আসেন, ভিতরে আসেন।

ঘন্টু: গন্ধে মালুম অইতাছে দেশি মাল। ও মন্টু ভাই, আপনেও দেশি খান! মন্টু: বিদেশি মাল তো সব আমার নায়ক আর ভিলেনরাই সাবাড় করে দেয়। আমার জন্য এটাই বরাদ্দ। কিন্তু ঘন্টু ভাই, আপনি আমার ঠিকানা পেলেন কোথায়?

Advertisement

ঘন্টু: হেঃ হেঃ হেঃ, আমার ছবিতে সাপ যেমন বাঁশির শব্দ শুনে পাহাড়-নদী পার হয়ে জায়গা মতো পৌঁছে যায়, আমিও তেমনি আপনার শরীরের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে যথাস্থানে পৌঁছে গেছি। মন্টু : আমার শরীরের গন্ধ আপনাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে-এটা না হয় মানা গেলো; কিন্তু সাপ সম্পর্কে একটা কথা বলা দরকার।

ঘন্টু: কী কথা?মন্টু: আপনি যে বললেন-বাঁশির শব্দ শুনে সাপ ছুটে আসে, এই কথাটা সঠিক নয়। ঘন্টু: সঠিক নয়?মন্টু: না সঠিক নয়। কারণ, সাপ কানে শুনে না।ঘন্টু: সত্য নাকি?মন্টু: হ সত্য; এটা বৈজ্ঞানিক সত্য।

ঘন্টু: লে হালুয়া! এইটা আপনি কি কইলেন?মন্টু: আমিও এতসব জানতাম নাকি? ‘জুলেখার ফুলবাগানে সাপ’ নামে টেলিভিশনের প্যাকেজ নাটক লেখার সময় সাপ লইয়া ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়া এইটা জানতে পেরেছি। ঘন্টু: কী যন্ত্রণা! তাইলে এতদিন পাবলিকরে যা দেখাইছি, সব ভুল? আমি আরও একটা নাম ঠিক কইরা আপনের কাছে আইছিলাম। অহন দেতখাছি নামটা চেঞ্জ করতে অইব।

মন্টু: কীসের নাম?ঘন্টু নতুন একটা ছবির। নাম দিছিলাম ‘নাচ নাগিনা নাচ’। ভাবছিলাম চিত্রনাট্যটা আপনেরে দিয়া লেখামু। আইচ্ছা এক কাম করি-নাগিনার জায়গায় জরিনা লাগাইয়া দেই। নাচ জরিনা নাচ-কেমুন অয়? মন্টু: মন্দ নয়। তবে এইখানেও একটা সমস্যা আছে ঘন্টু ভাই। বাংলাদেশের জরিনাদের শরীরের যা অবস্থা, তাতে তো ওরা ঠিকমতো হাঁটতেই পারে না; নাচবে কী করে?ঘন্টু: এইটা কুনু চিন্তার বিষয় নয়।

মন্টু: চিন্তার বিষয় নয়?ঘন্টু: কইলাম তো নয়। অহন খোলা বাজারের যুগ না? বাংলাদেশের জরিনারা ফিট না অইলে কলকাতা যামু। কলকাতা ফিট না করলে মুম্বাই যামু।

মন্টু: সর্বনাশ! বাংলাদেশের জরিনারা ক্ষেপে যাবে তো!ঘন্টু: দেশের জরিনাগো লইয়া আমার কুনু মাথাব্যথা নাই। পাবলিক খাইলেই অইল আর সেই সাথে পুরস্কারটা...মন্টু: কিন্তু পাবলিক যদি না খায়?

ঘন্টু: কী যে আপনে কন, তার কুনু মাথামুণ্ড নাই। পাবলিক খাইব না মানে? আপনি হাজার ভালা কইরাও একটা জিনিস বানাইয়া বাজারে ছাড়েন দেহি! পাবলিক হাতে লইয়াও দেখবে না। আর ওই একই জিনিসে মেড ইন জাপান কিংবা সিঙ্গাপুর স্টিকার লাগাইয়া ছাইড়া দেন-দেখবেন, পাবলিক গপাগপ খাইতাছে। শুধু অর্থনীতি না ভাই। খেলাধুলা-রাজনীতি সবখানেই এক অবস্থা।

মন্টু: খেলাধুলা? রাজনীতি?ঘন্টু : তাইলে আর কইতাছি কি ভাই? স্টেডিয়ামে আমাগো দেশি রেফারি একটা ফাউল ধরলেও চান্দি ফাটাফটি। আর বিদেশি রেফারিরা লালকার্ড দেখাইলেও পাবলিক চুপ। মন্টু: আর রাজনীতি?ঘন্টু: আপনে কি পত্র-পত্রিকা কিছু পড়েন না নাকি?মন্টু: লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকি...ঘন্টু: আমারও অবশ্য পড়া অয় না। একটা দৈনিক পত্রিকায় আমার সিনেমার বিজ্ঞাপন যায় তো! ওইখানে পড়লাম-রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য অনেকেই বিদেশিদের কাছে ধরনা দিতেছে। বাদ দ্যান এইসব। আমারে চিত্রনাট্য কবে দেবেন, হেইডা কন।

মন্টু: কীসের চিত্রনাট্য?ঘন্টু: খাইছে আমারে! এতক্ষণ ধইরা তাইলে কইতেছি কী? আমার নতুন ছবির কাহিনিটা আপনে লেইখ্যা দেবেন। অই যে ‘নাচ জরিনা নাচ’।মন্টু: কিন্তু ঘন্টু ভাই, এখন তো পারা যাবে না।ঘন্টু: ক্যান? অসুবিধা কী?

মন্টু: আমার এই অজ্ঞাতবাস বিশেষ একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখে ঘন্টু ভাই। আমি অনবদ্য কিছু সৃষ্টি করতে চাই। আপনি কি মার্কেজ-এর নাম শুনেছেন?ঘন্টু: মার্কেজ? ইনি আবার কেডা?মন্টু: মার্কেজ হলেন নোবেল পুরস্কার পাওয়া একজন সাহিত্যিক। তিনি কী করেছিলেন জানেন?

ঘন্টু: কী করছিলেন?মন্টু: ঘরের দরজা বন্ধ করে লিখতে বসেছিলেন। পুরো এক বছর দরজা খোলেননি। দরজার চিপা দিয়ে বউ চিরকুট লিখে জানাত সংসারের হাল-হকিকত। সেগুলো ওভাবেই পড়ে থাকতো। লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব হারাম। এই জন্যই তো নোবেলটা পেলো। আমিও চাই...

ঘন্টু: কী চান? নোবেল?মন্টু: ঘন্টু ভাই! আপনার কাছে সত্য প্রকাশে দ্বিধা নাই। আসলে বয়স যতো বাড়ছে, খ্যাতির লোভটাও...ঘন্টু: আমারও তো একই অবস্থা। আপনেগো দোয়ায় পয়সা-কড়ি আল্লায় মেলা দিছে। অহন দরকার খালি সম্মান আর খ্যাতি। হুনেন, আমার মাথায় একটা আইডিয়া ঝিলিক মারতাছে।

মন্টু: কী আইডিয়া?ঘন্টু: সাহিত্যে যেমুন নোবেল, চলচ্চিত্রে তেমনি অস্কার। ঠিক কিনা?মন্টু: ঠিক।ঘন্টু: তাইলে বিষয়ডা কী দাঁড়াইল?মন্টু : কী? ঘন্টু : আপনে যা লেখবেন বইল্যা ঠিক করছেন, প্রথমে তা উপন্যাসের আকারেই লেখেন। পরে অইডারে আমি চলচ্চিত্রে রূপ দিমু। এরপর এক ঢিলে দুই পাখি বধ করমু-নোবেল আর অস্কার, হেঃ হেঃ হেঃ!

মন্টু: আইডিয়াটা অবশ্য খারাপ নয়। আরেক নোবেলিস্ট আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাস নিয়ে যেমনটা হয়েছিল।ঘন্টু: তাইলে ওই কথাই রইলো। আপনের দরকার নোবেল আর আমার দরকার অস্কার!মন্টু: অতএব, নাচ জরিনা নাচ। হাঃ হাঃ হাঃ...

লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।mokamia@hotmail.com

এইচআর/ফারুক/জেআইএম