ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবরঅধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
Advertisement
কখনো মার্স তো কখনো সার্স, কখনো টমেটো ফ্লু তো আবার কখনো নিপা, একের পর এক রোগ যেন আমাদের পিছু ছাড়তেই চাইছে না। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে গত দু’ থেকে তিন দশকে পৃথিবীতে যে কটি নতুন বা ইমার্জিং রোগের সাথে মানুষের পরিচয় হয়েছে তার ৭৫ শতাংশই হচ্ছে জুনুটিক ডিজিজ অর্থাৎ প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়া রোগ।
হালের কোভিড-১৯ এর একটা বড় উদাহরণ। যদিও নানা প্রাণী থেকে এই ধরনের রোগগুলো ছড়াতে পারে, এদের মধ্যে বাদুরের নামটাই চলে আসে সবার আগে। বাদুর হচ্ছে একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যা উড়তে পারে এবং এই সক্ষমতাটাই বাদুরকে জুনুসিসের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। মেরু অঞ্চল আর মরুভূমি বাদ দিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ১৪০০ প্রজাতির বাদুর।
বাদুর ইদানীং রোগ ছড়ানোয় যে আলোচনার শীর্ষে তার আরেকটা বড় কারণ পরিবেশ বিপর্যয়। ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে বাদুরের আবাসভূমি আর দশটি প্রাণীর মতই। ফলে বাদুরও অন্যান্য প্রাণীর মতই বাধ্য হচ্ছে খাবারের খোঁজে নতুন নতুন জায়গায় ছুটোছুটি করতে। আর ক্রমেই বনের বাদুর এসে জুটছে মানুষের বসতীতে।
Advertisement
যেমন সার্স-কোভ-২ এর মত নিপাহ ভাইরাস হচ্ছে আরেকটি ভাইরাস যা বাদুরের থেকে মানুষে ছড়ায়। বনের বাদুর বনে খাবার না পেয়ে খাবারের খোঁজে ভাগ বসাচ্ছে মানুষের খেজুর রসে আর পরিণতিতে ছড়াচ্ছে নিপাহ।
এই ভাইরাসটি শুকর বা বাদুর দিয়ে কন্টামিনেটেড খাবারের মাধ্যমে যেমন মানুষে ছড়ায় তেমনি এটি ছড়াতে পারে মানুষ থেকে মানুষেও। নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৫০-৭০ শতাংশ আর যা ভাবায় তা হলো অনেক বিশেষজ্ঞরই ধারণা যে পৃথিবীতে আগামী প্যান্ডেমিকটি হতে পারে এই ভাইরাসটির কারণেই।
ড. কো বিং চুয়া ১৯৯৯ সালে শুকরের শরীরে প্রথমবারের মত নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত করেন। সে সময় সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার শুকর খামারীদের মধ্যে এক ধরনের এনকেফালাইটিস অর্থাৎ মস্তিষ্কের প্রাণঘাতী প্রদাহ দেখা দিয়েছিল যার ফলে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের শুকর রপ্তানীশিল্প প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল।
কামপুং সুংগাই নিপাহ নামের যে গ্রামটিতে প্রথমবারের মত এই ভাইরাসটি শনাক্ত হয় সেখান থেকেই ভাইরাসটির নামকরণ। বাংলাদেশে এ ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত হয় ২০০১-এ আর তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই এ দেশে নিপাহর আউটব্রেকের ঘটনা ঘটে চলেছে। মালয়েশিয়ার এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশ-ভারতে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশে। আর প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটির একমাত্র প্রাকৃতিক রিজার্ভার হচ্ছে বাদুর। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির কোন রকম লক্ষণ নাও থাকতে পারে এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে নিপাহ রোগীর ফুসফুসে বা মস্তিষ্কে মারাত্মক প্রদাহও দেখা দিতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির শুরুতে সাধারণত জ্বর, মাথা ব্যথা, মাংস পেশীতে ব্যথা, বমি আর গলা ব্যথার মত লক্ষণগুলো দেখা দেয়। পরবর্তীতে ঝিমিয়ে পড়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের প্রদাহের বিভিন্ন লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে থাকে।
Advertisement
কারো কারে ক্ষেত্রে আবার ফুসফুসে সংক্রমণের লক্ষণগুলো প্রকট হতে পারে। আক্রান্ত রোগী সাধারণত ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে কোমায় চলে যান। শরীরে ভাইরাসটি প্রবেশ করার পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ৪-১৪ দিন আর কখনো কখনো ৪৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। যারা সৌভাগ্যক্রমে নিপাহ থেকে বেঁচে যান তাদের সাধারণত কোনো স্থায়ী সমস্যা দেখা দেয় না, তবে প্রায় ২০ শতাংশ রোগীর দীর্ঘ মেয়াদী নিউরোলজিক্যাল সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এখন পর্যন্ত প্রাণী বা মানুষের জন্য নিপাহর বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ভ্যাকসিন নেই, আর রোগটির চিকিৎসা বলতে আছে শুধুই সাপোর্টিভ কেয়ার। বাংলাদেশ আর ভারতে মূলত কাঁচা খেজুরের রস থেকে নিপাহ ছড়ায়, আর খেজুরের রসে ভাইরাসটি মিশে বাদুরের প্রস্রাব আর লালা থেকে।
নিপাহ নির্ণয়ের জন্য কোভিডের মত আমাদের নির্ভর করতে হয় আরটি-পিসিআরের উপর, তবে এলাইজার মাধ্যমেও নিপাহর এন্টিবডি সনাক্ত করা সম্ভব। নিপাহর যেহেতু কোন কার্যকর চিকিৎসা নেই কাজেই বাঁচতে হলে জানতে হবে কিভাবে আমরা এ থেকে দূরে থাকতে পারি। আর এ জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় নিয়মিত সার্ভিল্যান্স আর যখনই কোথাও এই ভাইরাসটির আউটব্রেক দেখা দেয় তখন সেখানে দায়ী প্রাণী রিজার্ভার কোয়ারেন্টাইনের উপর।
খেজুর রস থেকে বাদুরকে দূরে রাখাও নিপাহ নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। এ জন্য খেজুরের রস সংগ্রহের পাত্রগুলো বাঁশের খাঁচা বা মশারী দিয়ে ঢেকে রাখাটা জরুরি, যেমন জরুরি খেজুরের রস ভালো করে ফুটিয়ে খাওয়া। ফলও খেতে হবে ভালো করে ধুয়ে আর তাতে যদি বাদুরে খাওয়ার কোন আলামত থাকে তবে তা অবশ্যই ফেলে দিতে হবে।
রোগাক্রান্ত প্রাণী বা রোগীকে অবশ্যই গ্লাভস পরে ধরতে হবে আর জোর দিতে হবে বারবার হাত ধোয়ার ওপর। মানুষ থেকে মানুষে নিপাহ সাধারণত ছড়ায় স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয়। কাজেই যারা স্বাস্থ্যসেবার সাথে সম্পৃক্ত তাদের জন্য সাবধানতার মাত্রাটা আরেক ডিগ্রি বেশি হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কথায় বলে ‘মনে না জানলে, চোখে দেখা যায় না’। হালে দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে আবারো নিপাহর চোখ রাঙানি দেখা যাচ্ছে। আর তাই পুরনো কথাগুলোই আরেকবার গুছিয়ে লেখার এই প্রয়াস।
লেখক: ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর রিসার্চার, এহিমি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমএস