মতামত

হিরোর প্রতিবাদী অভিযোগ জিরো হবে কি?

উপ-নির্বাচনে হেরে গিয়ে হিরো আলম ফলাফল জালিয়াতির ব্যাপারে জোড়ালো প্রতিবাদ করেছেন। তাকে ভোট প্রদানকারীরা তার পক্ষে এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছেন। গত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপ-নির্বাচনে একতারা প্রতীকের আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম নির্বাচনের ফল পাল্টানোর অভিযোগ করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়েছেন। গত ২ ফ্রেরুয়ারি সিইসি টেলিফোনে বগুড়া জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা এবং সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে এ নির্দেশ দেন। সেদিনই গণমাধ্যমকে একথা জানানো হয়।

Advertisement

এই আসনে উপ-নির্বাচনে ১০ কেন্দ্রে ফলাফল পাল্টানোর অভিযোগ তুলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নজরে আসার পর বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল। এই আসনের উপ-নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থীর কাছে মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন। কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলার মোট ১১২টি কেন্দ্রে মোট বৈধ ভোট পড়েছে ৭৮ হাজার ৫২৪টি।

এর মধ্যে ২০ হাজার ৪০৫ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে জয়ী হয়েছেন মশাল প্রতীকধারী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী একতারা প্রতীকধারী পেয়েছেন ১৯ হাজার ৫৭১ ভোট, তিনি এই ফলাফলের প্রতিবাদকারী হিরো আলম। তিনি সে রাতে নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘ভোট চুরি হয়নি, ফলাফল ছিনতাই হয়েছে।’ এজন্য ন্যায়বিচার পেতে তিনি উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথাও বলেন।

তিনি কষ্টের সুরে করেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে গড়ে তুলেছি। আমি একমাত্র প্রার্থী ৪-৫ জন কর্মী, একটি পিকআপ, দুটি মাইক নিয়ে দুটি আসনের মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। তাদের নানাভাবে সম্বোধন করেছি। ফলে জনগণ আমাকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভোটার হলেও অনেক বলেছেন, তারা ‘একতারা’ প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। সবাই বলেছেন, আপনি পাস করেছেন। ভোটাররাও ভোট দিয়েছেন, তাহলে ওই সব ভোট কোথায় গেলো? আওয়ামী লীগের লোকজনও তানসেনকে (বিজয়ী) ভোট দেয়নি। অথচ তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।’ .. ‘সারা বাংলাদেশ তাকিয়ে ছিল... আমার বিজয় ছিনতাই হয়েছে। উচ্চ আদালতে রিট করবো।’

Advertisement

হিরো আলম আরও বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ ভালো ছিল। তবে নন্দীগ্রামের ফলাফল ঘোষণা করার সময় তার সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। ৪৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৯টির ফলাফল ঘোষণা করা হয়। পরে বাকি ১০ কেন্দ্রের ফলাফল আলাদা ঘোষণা না করে মোট ফলাফল ঘোষণা করেছে। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, কেন ওই ১০ কেন্দ্রের ফলাফল একসঙ্গে ঘোষণা করা হলো? এখানেই কারচুপি করা হয়েছে। সব বুথে এজেন্ট থাকলেও প্রিসাইডিং অফিসার তাদের ফলাফলের কপি দেয়নি।’

হিরো আলম আরও বলেন, ‘আমি অশিক্ষিত, আমি এমপি নির্বাচিত হলে আমাকে স্যার ডাকতে হবে। দেশের সম্মান যেত; তাই ওই সব সাহেব আমার ফলাফল পাল্টে দিয়েছেন। নির্বাচিত হলে ওই সাহেবদের দেখিয়ে দিতাম আমিও পারি।’

নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আমাদের দেশে হেরে যাওয়া প্রার্থীরা নানা ভাবে নিজেদের মনের কষ্টকে কাটানোর জন্য নানা বক্তব্য দেন বলে একজন নির্বাচন কমিশনার গণমাধ্যমে আলাদা সময়ে বক্তব্য প্রদান করেন। এটা আমরাও জানি। কিন্তু অবস্থাভেদে নির্বাচনী এলাকার ভোটারাও সেকথা অনুধাবন করেন।

ভোটের পরিস্থিতি ভালো হলে সাধারণত ঘটনার বাস্তবতায় এসব নিয়ে পরে তেমন কোনো প্রতিবাদ দেখা যায় না। কিন্তু হিরো আলমের এই আসনের ভোটাররা বলেছেন উল্টো কথা। তারা বলেছেন, আমরা ভোট দিয়েছি যাকে তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি। এমন আশ্বাসে তাদের নিজেদের পছন্দের প্রার্থী হতাশ। তাই সেই বিজিত প্রার্থী আদালতে যাবেন এর সুরাহা খুঁজতে।

Advertisement

হিরো আলমের করা এই অভিযোগ শুনতে শুধু খারাপই নয়- খুব গুরুত্বপূর্ণ ও নেতিবাচক অর্থ বহন করে। এটা সম্পূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট রিটানিং কর্মকতা ও দায়িত্বরত অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যায়, যারা সেদিন ভোট পরিচালনা করেছিলেন ও ফলাফল তৈরি ও প্রকাশ করেছিলেন।

এছাড়া বড় রাজনৈতিক নেতারা হিরো আলমের এই অভিযোগ শোনার পরও তাকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে না এসে অনেকে তাচ্ছিল্য করেছেন যেগুলো অনেকটা অগণতান্ত্রিক আচরণ। এজন্য সিপিডি সেসব নেতার কঠিন সমালোচনা করতে ছাড়েনি। অপরদিকে সুশীল সমাজের অনেকেই হিরো আলমকে প্রান্তিকজনের প্রতিনিধি ও ‘আইকন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন।

জাতীয় সংসদে একই সময়ে ভিন্ন আরেকটি গুরুতর অভিযোগের কথা শোনা গেছে একজন আইন প্রণেতার বক্তব্য থেকে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য বলেছেন, ‘জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা অনেক এলাকায় রাজত্ব চালাচ্ছেন। এসব সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবটা এমন যেন তাদের কথায় যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন হয়েছে এবং জনপ্রতিনিধিরা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। আমরা ইউএনও ও সরকারি কর্মকর্তাদের দয়ায় চলছি। বর্তমানে আমাদের এলাকায় যে সরকারি কর্মকর্তা আছেন ইউএনও, ডিসি, তারাই মনে হয় দেশটার মালিক। তারা যা করে সেটাই চলে।’

ওই সংসদ সদস্য আরও বলেন, ‘আমরা কিছু চাইলে, কোনো কাজ করতে বললে, কোনো লোক পাঠালে আমাদের কথা শোনা হয় না। শুধু আমি না, এই সংসদে অনেকেই আছেন যাদের এলাকায় সরকারি কর্মকর্তারা রাজত্ব চালাচ্ছেন। আমরা নামমাত্র নির্বাচিত হয়েছি। বাস্তবে প্রকৃত ক্ষমতার মালিক তারাই।’

এসব অভিযোগ হয়তো সংশ্লিষ্ট জনেরা মামুলি হিসেবে মনে করে মোটেও আমলে নিতে চাইবেন না। কেউ হয়তো হেসে উড়িয়ে দেবেন। নয়তো এর পাল্টা প্রতিবাদে নানা ডকুমেন্ট জোগাড় করে পার পেতে চেষ্টা করবেন। হয়তোবা এজন্য তারা কর্তৃপক্ষের বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে পার পেয়ে যাবেন। সহজে পার পেয়ে যেতে পারেন এই সম্ভাবনার জন্য তারা হয়তো এরূপ নাজুক পরিস্থিতি হোক তা নিয়ে আগে মোটেও চিন্তা করেননি।

তবে একটি দেশের প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া এসব উপ-নির্বাচনে কোনো সাধারণ স্বতন্ত্র বিজিত প্রার্থী এমন কড়া প্রতিবাদ করতে পারে সেটাই এই মুহূর্তে মুখ্য বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। গতিশীল ও অবাধ অন্তর্জাল তথ্যপ্রবাহ সঞ্চালনের এই যুগে গণমাধ্যমের কল্যাণে কোনো কিছুই মানুষের অজানা নয়। জনগণের সাথে সামান্য চালাকি আজকাল দ্রুত অনুভব করা যায়, বোঝা যায়। হিরো আলমের অভিযোগের ভিত্তি ততটা নড়বড়ে নয় বলে মনে হয়। কারণ, একজন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে তিনি যে আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন তা আমলে নেওয়ার গ্রহণযোগ্য যুক্তি রয়েছে।

সেটা হলো আমাদের দেশে ‘হোয়াইট কলার ক্রাইমের’ ব্যাপক উপস্থিতি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার সরকারি-বেসরকারি ভূরি ভূরি নজির, যা প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো পত্রিকার শিরোনাম হয়। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় ক্ষুদ্র সংগঠনের সদস্যরা এ ঘটনার সংবাদ করার জন্য স্থানীয় দুজন সাংবাদিককে নাজেহাল করেছেন বলেও সংবাদ হয়েছে।

অর্থাৎ, হিরো আলমের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিষয়টিকে সবাই একটি ছেলেখেলা হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে জেতার জন্য অতি কাছাকাছি চলে আসবেন সেটা তাদের ধারণায়ও ছিল না। আর এখানেই ঘটেছে যত বিপত্তি। এই বিপত্তি ঠেকাতে সর্বশেষ দশটি কেন্দ্রের ফলাফল আটকে রেখে সেগুলো পরে প্রকাশ করা হয়েছিল এবং সেই ফলাফলের কপি হিরো আলমের এজেন্টদের কাছে আগে দেওয়া হয়নি বলে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

অন্যায়ভাবে আনুকূল্য পাওয়ার জন্য দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে তোয়াজ-তোষণের মচ্ছবের কথা বেশ আগেই চালু হয়েছিল। কিন্তু সেই মচ্ছব এখন অতি নোংরাভাবে প্রকাশিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ‘হোয়াইট কলার হিরোইজমের’ কাছে হিরো আলমের সিনেমায় হিরোগিরি তেমন কোনো বিষয় মনে না হলেও সংসদে গেলে তাকে স্যার বলে সম্বোধন করলে তাদের মান-ইজ্জত ধুলোয় মিশে যেতে পারে একথা তিনি সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন অকপটে।

এখানেই আসল গণতন্ত্রের সাথে দুষ্টু গণতন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক ভাবধারার নেতিবাচক চরিত্রটি পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। সেরকম একটি সমাজে আমরা বাস করছি। আগেকার দিনে সমাজে অপরাধ করতো কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি। এখন পুঁজি ও পদ দখলের লোভে সব সেক্টরে অগণিত কেতাদুরস্ত অপরাধী চক্র সক্রিয় হয়েছে। যারা অন্যের পাকা ধানে মই দিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা পাওয়ার আশায় সবসময় ওঁৎ পেতে থাকছে।

আর এজন্যই একজন আইন প্রণেতা অত্যন্ত ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে মহান জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রচলিত দুষ্টু গণতন্ত্রের কুণ্ঠিত হননি। এই বাস্তব সময়ে তার মূল্যবান বক্তব্য হতাশ জাতিকে আশার আলো দেখাতে পারে বলে মনে করা যায়।

এই সৎ সাহস সব সংসদ সদস্যের হোক, সব ভোটপ্রার্থীর হোক, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হোক। মূল কথা হলো- শুধু বক্তব্য ও প্রতিবাদী অভিযোগের বেড়ায় বন্দি না থেকে এসব অভিযোগের যেন দ্রুত যথার্থ আইনি সমাধান লাভ করা সম্ভব হয় সেজন্য আদালত-ইসি-দেশের সর্বোচ্চ কর্ণধার সবার ঐকান্তিক সহযোগিতা দরকার। আমরা শুধু উপ-নির্বাচন নিয়ে নয়, ছোট-বড় গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে স্মার্ট তস্করদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে আর কোনো ব্যাপারেই এ ধরনের প্রতিবাদী অভিযোগ শুনতে চাই না।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/ফারুক/এমএস