শক্তিশালী ভূমিকম্পে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে তুরস্ক। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) আঘাত হানা জোড়া ভূমিকম্পে এ পর্যন্ত দুই হাজার ৩১৬ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০টি শহর। এসব এলাকার অধিকাংশ পরিবারের কেউ না কেউ হতাহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন বহু মানুষ। ভাগ্যক্রমে যারা বেঁচে গেছেন তারাও আতঙ্কে দিন পার করেছেন। নিজ চোখে দেখেছেন প্রিয়জনের রক্তাক্ত মরদেহ।
Advertisement
এদিকে, দিনের আলো নিভতেই ‘মৃত্যুপুরী’তে নেমেছে রাজ্যের ভয়-শঙ্কা। ক্ষুধার্ত-ঘরহারা মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন। প্রচণ্ড ঠান্ডায় শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম রাখার চেষ্টা করছেন তারা। অসহায় মানুষেরা বলছেন, ‘বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বনই তাদের আর নেই।’
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা আনা ফস্টার সোমবার দিনগত রাতে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের শহর ওসমানিয়ে ও কাহরামানমারাস রাস্তায় ঘুরে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখেছেন।
তিনি বলেন, প্রচণ্ড ঠান্ডায় শরীর গরম রাখতে অনেকে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে অবস্থান করছেন। সেখানে থাকা একজন নারী আমাকে জানালেন, ভূমিকম্পে তিনি ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। এখন তার থাকার জন্য একটি বিছানাও অবশিষ্ট নেই। পাশেই দাঁড়ানো মধ্যবয়সী আরেক নারী বলে ওঠেন- ‘ভোরে ঘটনার পর থেকে আমরা কিছুই খাইনি। আমরা সবাই ক্ষুধার্ত। আমাদের ঘর নেই, খাবার নেই, পানি নেই, বেঁচে থাকার জন্য আমাদের কিছুই নেই।’
Advertisement
আরও পড়ুন: কম্পনের আকস্মিকতায় শরীর হিম হয়ে আসছিল, নড়তেই পারিনি
মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তুলে ধরে বিবিসির সাংবাদিক আনা ফস্টার লিখেছেন, ‘আমি রাতে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের ওসমানিয়ে শহরের অনেক জায়গায় ঘুরেছি। এ শহরটি বিধ্বংসী ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের একেবারে কাছাকাছি অবস্থিত। রাস্তার সর্বত্র ধ্বংসস্তূপ। বহুতল ভবনগুলোর অধিকাংশ ধসে পড়েছে। ধসে পড়া অনেক ভবনের ধ্বংসস্তূপ এখনও সরানোর কাজ শুরু হয়নি। সুপার মার্কেটগুলো ভেঙেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে রয়েছে। দোকানগুলোর সামনে ভাঙা কাচের টুকরো।’
আরও পড়ুন: জীবিত উদ্ধার শিশুর মা-ভাই-বোনের মৃত্যু, সংকটাপন্ন বাবাও
‘ওসমানিয়ে শহরের মূল অংশে যাওয়ার অনেক রাস্তায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। ব্রিজগুলো ভেঙে পড়েছে। পুরো এলাকা অন্ধকার। রাস্তায় হঠাৎ একটি পরিবারের কয়েকজন দেখতে পেলাম। তাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তাদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। কান্না থামছেই না। প্রচন্ড ঠান্ডায় তারা রাস্তায় কিছু কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে অবস্থান নিয়েছেন। নিজেদের ঘর হারিয়েছে। অক্ষত ভবনগুলোর আশপাশে যেতেও তারা ভয় পাচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়েই আমরা আফটারশক অনুভব করছিলাম। এমন কম্পনের অনুভূতি হলেই তারা দৌড়াদৌড়ি শুরু করছেন। রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াচ্ছেন।’
Advertisement
আরও পড়ুন: তুরস্কে ৭ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করলেন এরদোয়ান
এদিকে, ভূমিকম্পে হতাহতদের স্মরণে সাতদিনে জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। স্থানীয় সময় সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে এক টুইটবার্তায় তিনি এ ঘোষণা দেন।
টুইটবার্তায় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান লেখেন, ‘সাতদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এসময়ে আমাদের জাতীয় পাতাকা অর্ধনমিতভাবে উত্তোলন করা হবে। আগামী রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) সূর্যাস্ত পর্যন্ত এ শোক পালন করা হবে। দেশে ও বিদেশে তুরস্কের বিভিন্ন অফিসে হতাহতদের প্রতি শোক জানিয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতভাবে উত্তোলনের আহ্বান জানাচ্ছি।’
আরও পড়ুন: ‘মৃত্যুপুরী’ তুরস্ক-সিরিয়ায় প্রাণহানি তিন হাজার ছাড়ালো
সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ভোররাত সোয়া ৪টার দিকে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চল ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ৪০ সেকেন্ড ধরে চলা এ ভূমিকম্পের কম্পন পৌঁছায় লেবানন ও সাইপ্রাসেও।
ধারণা করা হচ্ছে, সোমবার ভোরে আঘাত হানা ভূমিকম্পে ধসে পড়া ভবনগুলোতে অসংখ্য মানুষ আটকা পড়েছে। কর্মীরা ধ্বসংস্তূপের মধ্য থেকে আটকে পড়াদের উদ্ধারে তৎপড়তা জোড়ালো করেছে।
আরও পড়ুন: তুরস্কে ১০ শহর ক্ষতিগ্রস্ত, কিছু এলাকায় এখনও পৌঁছেনি উদ্ধার দল
ভয়াবহ এ ভূমিকম্পে তুরস্কের অন্তত ১০টি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব শহর দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। আল-জাজিরার সাংবাদিক সিনেম কোসেওগ্লু ইস্তাম্বুল থেকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
১৯৯৯ সালের পর এটাই তুরস্কে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। ওই বছরের আগস্টে সাত দশমিক ছয় মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প তুরস্কের দক্ষিণে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল মারমারায় আঘাত হানে। ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পে দেশটিতে সাড়ে ১৭ হাজার মানুষ নিহত হয়।
এএএইচ