আমার সাথে বইমেলার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। পড়ালেখা আর সংসার করতেই ঢাকায় বসবাস শুরু হয়। ইডেন কলেজ আর বাসা এই ছিল তখনকার জীবন। বাণিজ্যমেলায় যাওয়ার সৌভাগ্য হলেও বইমেলায় নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ ছিল না। আর একা চলার মতো সাহসও তখন ছিল না। ভাগ্যের চাকা উল্টো ঘুরতে ঘুরতে একসময় মিডিয়ার সবগুলো সেক্টর ঘুরতে থাকি। পরিচয় হয় বইমেলার সাথে।
Advertisement
আমার ঠিক কবে থেকে বইয়ের সাথে সম্পর্ক হয়েছিল মনে নেই। মায়ের কাছে শুনেছি আমার অনেক ছোট বয়স থেকে স্মরণশক্তি বেশি ছিল। মায়ের মুখে শুনে শুনে কবিতা বলতে পারতাম। একবছর হওয়ার আগেই প্রায় ১০-১৫টা ছড়া এবং কবিতা মুখস্থ বলতে পারতাম স্পষ্ট ভাষায়।
বড় হওয়ার সাথে সাথে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল। মা যেহেতু বই পড়তে ভালোবাসেন তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়ায় কোনো বাধা ছিল না কোনো দিনই। তবে একুশে বইমেলার সাথে পরিচিতি ঘটে অনেক বছর পর। ১৯৯৮ সাল থেকে ঢাকা বসবাস শুরু হলেও বইমেলার সাথে পরিচয় ঘটে আরও পরে।
সাংবাদিক হিসেবে বইমেলায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে অনেক বছর। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, পত্রিকার কন্ট্রিবিউটর হিসেবে প্রথম বছরই বইমেলার নিউজ কভার করার দায়িত্ব পেয়ে যাই। পরিচয়হীন এক সাংবাদিক আমি বইমেলায় ছুটছি প্রতিদিন। প্রতিদিন কতো বই এলো, কোন বই পাঠক সমাদৃত হয়েছে। কখনো কখনো বইমেলায় আগত নামি লেখকদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হতো। এছাড়া ঘুরে ঘুরে নতুন বই দেখা। কলকাতার লেখকদের নতুন বই দেখা। সাধ্যমতো কিনে আনা।
Advertisement
নতুন পরিচয়ে লেখক-প্রকাশক-পাঠকদের সাথে পরিচিত হতে থাকি। প্রতিটি স্টলে নতুন বইয়ের মায়াভরা গন্ধ। সবমিলিয়ে এক মোহময়ী সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যায় প্রতিদিন। তবু যেন বইমেলা থেকে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হয় না। তখন অনলাইন বলে কিছু ছিল না বলে নিউজ লেখা বা প্রকাশের তাড়া ছিল না। তাছাড়া আমি ফিচারে কাজ করতাম বলে ওইদিন নিউজ লেখার দরকার পড়তো না। তারপর কেটে যায় আরও কয়েকটি বইমেলা।
২০০৬ সালে আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয় নাম ‘স্বপ্নের ডানা’। সহকর্মী বন্ধু নতুন প্রকাশনা করেছে। আমাকে বললো, তোমার একটা পান্ডুলিপি দাও বই প্রকাশ করবো। অনেক সাত-পাঁচ ভেবে পান্ডুলিপি দিলাম। সত্যি বলতে কি, তখনও আমি নিজেকে ঠিক বইয়ের লেখক হিসেবে ভাবতে পারিনি।
এখন আমি অনেক নতুন লেখককে দেখি তাদের মধ্যে কতো আত্মবিশ্বাস। ছাই-পাশ কি লিখেছে তা বড় কথা নয়। দেখে মনে হয় তিনি কতো বড়মাপের উঁচুদরের লেখক। দেখা হলে হাতের মধ্যে গছিয়ে দেয় অটোগ্রাফসহ বই। এসব নতুন লেখকদের আমি মোটেই নিরুৎসাহিত করি না। তবে নিজের কথা বলতে গিয়ে চলে আসছে তাই বলা।
যাই হোক, একদিন বইয়ের কভার ছাপা হয়ে এলো। নিজের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম হলো। উপন্যাসের নাম তার নিচে নিজের নাম লেখা দেখলাম। আমার বেশ কয়েকদিন ঘোর কাটাতে সময় লাগলো। তারপর একদিন বই ছাপা হয়ে এলো। বইমেলার প্রথম দিন স্টলে বই আনা হয়েছে। আমি প্রথম আমার বই দেখবো। একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে মনের মধ্যে।
Advertisement
সকাল গড়িয়ে দুপুর পার হলো, আমি ছুটছি বইমেলার দিকে। বইমেলা কভার করতে এবং নিজের লেখা প্রথম বই দেখতে যাবো এটা ভাবতেই আমার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে ওঠে। ঘুরে ঘুরে বইয়ের স্টল খুঁজে পেলাম ঠিকই তবে স্টলের সামনে যেতে লজ্জা পাচ্ছি।
নিজের বই হাতে নিয়ে দেখতে এক ধরনের উত্তেজনা এবং লজ্জা দু-ই অনুভব করতে থাকি। উপস্থিত আমার অনেক লেখক বন্ধুরা কিছু বই সংগ্রহ করেছিল। সবাই বলতে লাগলো অটোগ্রাফ দাও। এটাতেও আমি মহামুশকিলে পড়লাম। ভয় হতে লাগলো, আমি ঢাকার লেখক সমাজে নবীন। যদিও গ্রামে থাকাকালীন প্রচুর লেখালেখি করতাম এবং পুরস্কারও জুটেছে অনেক। তবে তখনকার সময়ে সব লেখকদেরই আমার কাছে উঁচুদরের মনে হতো। তাই তাদের সামনে নিজের বইয়ে অটোগ্রাফ দেওয়ার মতো স্পর্ধা দেখাতে ভয় পাচ্ছিলাম।
এরপর প্রতিদিন বইমেলায় যাই আসি। কিন্তু আমার বই প্রকাশিত হয়েছে এই কথা বলা বা কাউকে কিনতে বলা তো দূরের কথা, ফ্রি গিফট দিতেও আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। আমার কেবলই মনে হতে লাগলো, কীভাবে আমি কাউকে বলবো- ‘আমার একটা বই বের হয়েছে আপনারা কেনেন’। আমার কাছে লেখক মানে অনেক উঁচু স্থানের মানুষ। অথচ না চাইতেই কেউ আমার বই প্রকাশ করে ফেললো আর আমি লেখক হয়ে গেলাম।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফেব্রুয়ারিজুড়ে বইমেলা প্রাঙ্গণে লেখক-পাঠক-প্রকাশক সর্বোপরি বাঙালির মিলনমেলা হিসেবে জমে ওঠে। মেলাকে কেন্দ্র করে প্রায় সারাবছর এক চাপা উত্তেজনা বিরাজ করে বই সংক্রান্ত সব শ্রেণির মানুষদের।
পাঠকরা অপেক্ষা করে নতুন কি বই আসবে। কোন বই হবে বেস্ট সেলার। লেখক মনে করে যে বই প্রকাশ হতে যাচ্ছে তা পাঠকের মনে জায়গা পাবে তো। আবার প্রকাশক মনে করছে ঠিক সময় মতো পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দিতে পারবো তো। আবার অনেক প্রবাসী লেখকের মনে সংশয় হয় ছুটি পাবো তো। এমন নানান প্রশ্নের সমাধান নিয়ে অবশেষে বইমেলা শুরু হয়।
গ্রামের কলেজে পড়ালেখা শেষ করে ঢাকা আসা। গ্রামীণ জীবনে সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা থাকলেও বইমেলা নিয়ে কোনো জানাশোনাই ছিল না। শুধু জানতাম জ্ঞানী হতে হলে অনেক বই পড়তে হবে, জানতে হবে অনেক কিছু। যারা শিক্ষিত গ্রামের বাইরে বিভিন্ন শহরে পড়ালেখা করতেন, তারা বলতেন, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অনেক বই পড়তে হবে। দেশ-বিদেশের অনেক বই না পড়লে তাদের শিক্ষিত বলা যায় না। ততোদিনে আমি নিজেও বুঝে গিয়েছিলাম লিখতে গেলে পড়তে হবে।
ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা গ্রামে গেলে সঙ্গে করে কিছু বই নিয়ে যেতেন। সেগুলো আমরা কাড়াকাড়ি করে পড়তাম। তারাই অনেক সময় বলতেন বইমেলা থেকে এই বই কিনেছেন। তবে কোনো ধারণা ছিল না বইমেলা সম্পর্কে। কারণ সে সময় মোবাইল বা টেলিভিশন কোনোটার সাথেই পরিচিত ছিলাম না। বড় হতে হতে জানতে পারলাম বইমেলার ইতিহাস।
আমার কাছে বইমেলা মানে প্রাণের মেলা। সারাবছর সবসময় সব মানুষের সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ থাকে না। বইমেলায় গিয়ে সেই সব হারিয়ে যাওয়া মানুষদের সাথে কুশলবিনিময়ের সুযোগ হয়। নিজে লেখক বলেই লেখকদের সাথে বেশি সখ্য। অন্যান্য লেখক বন্ধুদের লেখালেখি, প্রকাশিত বই সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া বইমেলার একটা বড় অংশ। সবচেয়ে ভালো লাগে বিদেশে থাকা লেখকদের সাথে দেখা হওয়ার বড় সুযোগ হয় বইমেলা উপলক্ষে।
পৃথিবীর অনেক দেশে বইমেলা হয়। গত বছর কলকাতা বইমেলা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। তাই কলকাতা বইমেলায় উদ্বোধন উপলক্ষে আমিও ছিলাম। আমার ধারণা ছিল কলকাতা বইমেলা বুঝি আমাদের চেয়েও জমজমাট। কিন্তু দু-তিনদিন মেলা ঘুরে আমি বেশ আশাহত হয়েছি। ঢাকার মতো কলকাতায় মুক্তমঞ্চ দেখলাম না। লেখককুঞ্জ দেখলাম না। সাংস্কৃতিক বা আলোচনা অনুষ্ঠানও দেখতে পেলাম না। এছাড়া মেলা ঘুরে আমি কোনো প্রাণ খুঁজে পেলাম না।
অধিকাংশ মানুষ এখন আর তেমন বাংলাভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। ভাবতে খুব অবাক লাগলো, যে দেশের লেখকদের সাহিত্য দিয়ে বিশ্ব জানতে পারলো বাঙালিকে। সেই দেশের মানুষ বাংলাকে নিয়ে গর্ব করতে ভুলে গেছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষ এখনো বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ে আছে। কলকাতার অনেকেই বইমেলায় যায় জাস্ট বিনোদনের জন্য। কলকাতায় বইয়ের স্টলের চেয়ে খাবারের স্টল বেশি।
সব দেখে, সব শুনে মনে হয় বাঙালির প্রাণের মেলা, অমর একুশে বইমেলা। প্রতি বছর অনেক অভিযোগ থাকে আয়োজকদের প্রতি তবুও বলবো এখনো আমাদের বইমেলাই শ্রেষ্ঠ।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম