গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে বাড়লো রেলওয়ের ভাড়া। রুট ভেদে যাত্রী পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হলো গড়ে ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। একই হারে বেড়েছে রেলপথে কনটেইনার পরিবহন ভাড়াও। পাশাপাশি রেলে ভ্রমণের ন্যূনতম ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। এর আগে ২০১২ সালের অক্টোবরে বাড়ানো হয় রেলের ভাড়া। লোকসান কমানোর জন্য এখন থেকে প্রতিবছর ভাড়া বাড়ানোর শর্ত দেয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ঋণের শর্তের কারণে এখন থেকে বছরের শুরুর দিকে ভাড়া বাড়ানো হবে বলে রেল বিভাগ জানিয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে রেল ভাড়া বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলছে ৮৫ শতাংশ যাত্রী। ৭২ শতাংশ রেলের যাত্রী সেবার মানে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ভাড়ার চেয়ে সেবার মান নিয়েই প্রশ্ন বেশি। প্রতি বছরই বাজেটের সময় রেলের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখি, সেখানে লোকসানটাই দেখি বেশি। নিয়ম করে নতুন প্রকল্প ও নতুন ট্রেন চালু করার প্রস্তাব থাকে- যা চাহিদার তুলনায় অল্পই, তবুও সেসব বাস্তবায়ন হয় না। রেলমন্ত্রী প্রতিনিয়তই সেবার মান বাড়ানোর কথা বলেন, কিন্তু তা আর বাড়ে না, ফলে যাত্রীরা সন্তুষ্ট থাকে না। রেলের উন্নয়ন করা দরকার, দরকার লোকসান কমানো। যাত্রী ভাড়া বিপুল বাড়িয়েও কি তা সম্ভব? বোঝার উপর আবার শাকের আঁটি হয়ে এলো সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন বাড়া, যা রেলের লোকজনও পাবে। ভাড়া বাড়িয়ে সে টাকাও আসলে উঠবে না। রেলের অন্তর্নিহিত শক্তি নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ হয় না খুব একটা। এর কারণ হলো ভাবনায় নেই গতিশীলতা, সৃজনশীলতা। সরকারি প্রতিষ্ঠান মানেই লোকসান, সেবার মানের যা তা অবস্থা। তাই নজরটা আসুক এই খাতে বেসরকারি বিনিয়োগে। বিনিয়োগকারীদের মূলধন বিনিয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে রেল সবকিছু দীর্ঘমেয়াদি মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে সেই পরিষেবা কিনে নিক। এই খরচ নির্বাহ হোক রেলের রেভিনিউ ইনকাম থেকে। দেশের উন্নয়নে রেল এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সড়ক পরিবহনে জমি অধিগ্রহণ থেকে রাস্তা তৈরি, সিগন্যালিং সিস্টেম, তার রক্ষণাবেক্ষণ, সিকিউরিটি সব কিছুই ব্যয়বহুল। এর উপর সারা দেশে দুর্ঘটনায় বছরে প্রায় দেড় লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। মানব সম্পদ, জাতীয় সম্পদের ক্ষতি হয়। এর তুলনায় রেলের অনেক কম জমি লাগে। ফলে শস্যহানি কম হয়। রেল দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পত্তির হানিও হয় সামান্যই। আমাদের রেলের সম্পদ প্রচুর। কিন্তু সর্বত্রই একটা দরিদ্র ভাব। দেশ জুড়ে রেল স্টেশনগুলোর অবস্থা করুন। আধুনিকীকরণের জন্য এগুলোকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ব্যবহার করা যায় কিনা ভাবতে পারে সরকার। রেল স্টেশনগুলোতে প্রচুর যাত্রী বা জনসমাগম হয়। ব্যক্তিখাতে ছেড়ে সরকার দেখতে পারে কতটা পরিবর্তন আসে। ভাবনার পরিবর্তনে স্টেশনগুলোতে বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স করা যায়। বিনিয়োগকারী নিজের খরচে স্টেশনের আধুনিকীকরণ করবেন, বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স করবেন আর এর থেকে যে আয় হবে তার একটি অংশ রেলকে দিবেন। সরকারি টাকার শ্রাদ্ধ করে, প্রকল্প বানিয়ে রেলের আধুনিকায়নও হবে না, লোকসানও কমবেনা, যাত্রী সেবার মানও বাড়বে না। সারাদেশে রেলের বিপুল পরিমাণ জমি। অব্যবহৃত জমি প্রচুর, বেহাত, বেদখল হয়ে যাচ্ছে আনেক। জনসংখ্যা বাড়ছে, তাই জমির দামও বাড়ছে। কাজেই রেলের জমির ব্যবহার নিয়ে সৃজনশীল ভাবনা দরকার। কতটা সম্ভব হবে জানি না, একটা বৈপ্লবিক প্রস্তাব রাখতে চাই। জমি চিহ্নিত করে শিল্প, বাণিজ্যকেন্দ্র লাভের অংশ ভিত্তিতে আউটসোর্সিং করা যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিংবা পরিবেশের কথা ভাবলে বাণিজ্যিক বনায়নও ভাবা যেতে পারে যেন জমিগুলো নিষ্ফলা না থাকে। রেল গাড়িগুলো চলছে দেশব্যাপী। রেল পথগুলো রোদ পুড়ে প্রতিনিয়ত। তাই রেল পথগুলোর মাঝখানে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় কিনা ভাবা যেতে পারে। এই বিদ্যুৎ সরাসরি গ্রিডের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়তো। এগিয়ে আনতে হবে বেসরকারি খাতকেই। রেল ভ্রমণ সবসময়ই মানুষের প্রথম পছন্দ। কিন্তু ময়লা, নোংরা বগি, নিকৃষ্ট যাত্রীসেবাসহ নানা কারণে মানুষ রেলে চড়তে চায় না। কিন্তু রেলকেও করা যায় ঝা চকচকে। এই চমৎকার ভ্রমণ-ব্যবসা থেকে কোনোদিন লাভের মুখ দেখেনি রেল কর্তৃপক্ষ। তাই ব্যক্তিখাতের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই তার কাছে। আর সনাতনী ভাবনায় পরিবর্তন আনা। আউটসোর্সিং করে অপারেশনটাও হয়ে উঠতে পারে দক্ষ, লাভজনক। রেলের ক্যাটারিং অত্যন্ত নিম্নমানের এবং অপরিচ্ছন্ন, আবার দামও বেশি। এখানেও আধুনিক চিন্তা প্রয়োজন। প্রয়োজন পানীয় জল নিয়ে ভাবা। দূরপাল্লার রেল ভ্রমণে যাত্রীরা দাম দিয়ে কেনে বোতলজাত পানি। অসংখ্য ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল দূষণ সৃষ্টি করছে। বিচ্ছিন্নভাবে হকারদের কাছ থেকে এসব বোতল কেনে যাত্রীরা। এই ব্যবসাটিকেও একটা সিস্টেমে আনতে পারে রেল কর্তৃপক্ষ। প্লাস্টিকের বদলে ডিজপোসিবল কোনো পানির আধারে এসব বিক্রি করা যায় কিনা তার সৃজনশীল চিন্তা দরকার বলেই মনে হচ্ছে। উন্নয়নের প্রধান সোপান রেল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে সেখানে উন্নয়ন শুরু হয়। দেশজুড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগের এই মাধ্যমটিকে আবহেলায় রেখে দেয়া যায় না। উপরে প্রস্তাবিত ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ট্যুর অপারেটরদের সাথে আলোচনা করে বের করা যেতে পারে কি করে রেল হয়ে উঠতে পারে অভ্যন্তরীণ পর্যটনের ভ্রমণ মাধ্যম। রেল শুধু অর্থনৈতিক উন্নতির হাতিয়ার নয়, জাতীয় সংহতির পক্ষেও সহায়ক। সেইজন্যই দরকার, যাত্রীভাড়া যথাসম্ভব কম রেখে রেল পরিষেবাকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিতান্ত সাধারণ মানুষেরও নাগালের মধ্যে এনে দেওয়া। যাতে তাঁরা বুঝতে পারেন সেখানকার মানুষ কত ভালো, কত আপনজন। প্রয়োজন এতদিন ধরে যেভাবে রেলকে নিয়ে ভাবা হয়েছে তার পরিবর্তন। এইচআর/এমএস
Advertisement