কেটে গেছে প্রায় আড়াই মাস। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত এলাকা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে গ্রেফতার করা যায়নি এখনো। আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকা পলাতক দুজনের একজনকেও শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাই বড় কোনো জঙ্গি হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।
Advertisement
পলাতক দুই জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে না পারলে ওই ঘটনায় জড়িত মেহেদী হাসান অমি ওরফে রাফি (২৪) ও প্রয়াত রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুককে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।
আরও পড়ুন>> জঙ্গি ছিনতাই: আদালতের গেটে নেই সিসি ক্যামেরা!
নিরাপত্তা বিশ্লেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন, দুই জঙ্গি পলাতক অবস্থায় দেশে বড় কোনো হামলা চালাতে পারে। দেশে হয়তো তারা আরেকটি হলি আর্টিসানের মতো ঘটনা অথবা আত্মঘাতী কোনো হামলা ঘটানোর পরিকল্পনা করছে। এছাড়া নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সঙ্গে পলাতক দুই জঙ্গির কোনো চুক্তি হলে সেটিও হবে ভয়াবহ।
Advertisement
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাবধানতা ও সতর্কবার্তার মধ্যেই ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানী ঢাকায় হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় ইতিহাসের জঘন্যতম জঙ্গি হামলা ঘটে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে জঙ্গি-উগ্রবাদী তৎপরতা বেড়েছে। জঙ্গিবিরোধী তৎপরতায় আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই।
আরও পড়ুন>> আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম
মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, আদালত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া দুই আসামি গ্রেফতারে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। আশা করা যাচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যেই তারা গ্রেফতার হবেন। তারা যদি বিদেশে পালান ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনা হবে। এখন পর্যন্ত বিদেশে পালানোর বিষয়ে কোনো ধরনের গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, পলাতক দুই জঙ্গি নিষিদ্ধঘোষিত আনসার আল ইসলামের সঙ্গে জড়িত। আনসার আল ইসলাম কাট আউট (একই কাজে যুক্ত এক দলের তথ্য অন্য দল জানে না) পদ্ধতিতে কাজ করার কারণে গ্রেফতার মেহেদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো তথ্য জানতে পারেনি পুলিশ। জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় অংশ নেওয়া আরও সাতজনকে চিহ্নিত করা গেলেও তাদের অবস্থানের বিষয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
Advertisement
আরও পড়ুন>> ‘কেএনএফ’র কাছে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বাড়িছাড়া তরুণরা
ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এছাড়া আরও কয়েকটি হত্যা মামলারও আসামি তারা।
জঙ্গি ছিনতাইয়ে জড়িত সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিতের এপিএস ফারুক জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ওমর ফারুক নামে এক আইনজীবী জড়িত বলে জানায় সিটিটিসি। গত ২৬ ডিসেম্বর তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওমর ফারুক পালিয়ে যাওয়া এক জঙ্গির ভগ্নিপতি ও প্রয়াত রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ছিলেন।
পলাতক দুই জঙ্গির হাতে যেভাবে মোটা অঙ্কের টাকা দেন মেহেদীজঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মেহেদী হাসান অমি ওরফে রাফি (২৪) নামে একজনকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। রাফি (২৪) মোটা অঙ্কের টাকা এনেছিলেন। এই টাকা ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গিদের হাতে দেন তিনি। যাতে জঙ্গিরা টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের পরবর্তী কার্যক্রম চালাতে পারেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় গ্রেফতার মেহেদী আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন ছিনিয়ে নেওয়ার পর জঙ্গিদের হাতে টাকা দেবেন। অমি প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটিদুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) মো. হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করে আদেশ জারি করা হয়। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতিনিধি (ডিআইজি পদমর্যাদার নিচে নন), অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ও ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
আরও পড়ুন>> রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা
পুলিশ সদরদপ্তরের একজন ডিআইজিকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি (অডিট) মো. আমিনুল ইসলাম ও সদস্য সচিব অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম মেট্রো) মো. হাসানুজ্জামান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- সিটিটিসির ড. এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মেট্রো সাউথ) মো. আনিচুর রহমান।
দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব পালানোর ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারকে সভাপতি করে তদন্ত কমিটি গঠন করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তদন্ত কমিটির সভাপতি হলেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম আ্যন্ড অপস) এ কে এম হাফিজ আক্তার। কমিটির সদস্যরা হলেন ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস), যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি), লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ও ডিএমপির সিআরও’র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার।
আরও পড়ুন>> ফিল্মি স্টাইলে জঙ্গি ছিনতাই, ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি
পলাতক দুই জঙ্গির বিষয়ে র্যাব কাজ করছে জানিয়ে সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, হলি আর্টিসানের মতো ঘটনা বারবার হবে না। জঙ্গিরা নতুন কোনো প্ল্যানে কাজ করতে পারে। তবে র্যাব এক্ষেত্রে সব সময় সতর্ক আছে। পলাতক দুই জঙ্গিসহ তাদের সহযোগিদেরও আইনের আওতায় আনতে র্যাবের গোয়েন্দা দল ও সবগুলো ইউনিট কাজ করছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গির বিষয়ে পুলিশের একাধিক ইউনিট কাজ করছে। পুলিশ এর আগে অনেক বড় বড় জঙ্গি নেতাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছে। পলাতক দুই জঙ্গি যেখানেই পালিয়ে থাকুক তাদেরও গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করা হবে।
পালানো দুই জঙ্গিকে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত ঝুঁকি রয়েই যায় উল্লেখ করে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, দুই জঙ্গিকে গ্রেফতারে নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে যাচ্ছে। তাদের শনাক্ত করতে না পারলে গ্রেফতার করা খুব কঠিন। দুই জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্বস্তি রয়ে যাবে।
‘হলি আর্টিসানের পরে আমি আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পাই। তখন সারাদেশে জঙ্গিদের আস্তানা খুঁজে খুঁজে অভিযান পরিচালনা করে নির্মূল করি। জঙ্গিদের অনেকগুলো আত্মঘাতী দল হয়েছিল তখন। যদি শনাক্ত না করা যেত তবে দেশ অচল হয়ে যেত। জঙ্গিরা নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে ঠিক, তবে হলি আর্টিসানের মতো ঘটনা ঘটানোর সক্ষমতা জঙ্গিদের নেই।’
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. নূরুল আনোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, যখন কোনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি পলায়ন করে তখন খুব সহসা ধরে পড়বে না, সেভাবে তারা পালিয়ে যায়। তারা খুব ভালো করেই জানতেন তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। প্রথম মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া আর দ্বিতীয়ত জঙ্গি সংগঠনকে পুনর্গঠন করা। তারা দেশে থাকতে পারে, আবার দেশের বাইরেও যেতে পারে। যেখানেই থাকুক তারা চাইবে বাংলাদেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে। জঙ্গিরা সাধারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়েও বেশি মস্তিষ্ক খাটায়। তবে দেশে থাকলে তারা ধরা পড়বেই।
হলি আর্টিসানের মতো ঘটনা ঘটবে কি না তাৎক্ষণিকভাবে কেউ বলতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা হলি আর্টিসানের চেয়েও বড় কোনো হামলা ঘটাতে পারে। আমি শঙ্কা থেকে বলছি- কোনো মসজিদ কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা হামলা করতে পারে। তখন মানুষ মসজিদে যেতে ভয় পাবে। আর সেটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার পাবে। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো ইনফরমেশন নেই। হলি আর্টিসানের ঘটনা আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণ সমর্থন করেনি। তবে নির্বাচন সামনে, জঙ্গিরা ধরা না পড়া পর্যন্ত হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারি না।
টিটি/এএসএ/এমএস