দিবস রজনী না হলেও, সারা বছর ধরে মনে মনে অপেক্ষা করে থাকি বইমেলায় যাবো। তা বছরজুড়ে কত জায়গায় কত রকম বইমেলাই তো হয়। যেখানে যাই হোক, প্রাণের বইমেলা একটিই। সেটি বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা।
Advertisement
ফেব্রুয়ারি মাসটা এমনিতেই ছোট। আর বইমেলায় প্রায় প্রতিদিন গেলেও মনে হয় যেন খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। গত কয়েক বছর করোনার জন্য বিরূপ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব, বাংলাদেশ তো বটেই। তবু গত বছর বইমেলাটি দেরিতে হলেও হয়েছিল। সেদিক থেকে বলতে গেলে, বলা যায় করোনার পর এটিই আগের সেই বইমেলা, ফেব্রুয়ারি মাসকেই যা ভরিয়ে রাখে প্রাণের আনন্দে।
বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারও স্মৃতি। শৈশবে বাবা-মায়ের হাত ধরে যেতাম বইমেলায়। হাতভরে বই কিনতাম। নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, অ্যান্ডারসনের রূপকথা, কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ, দস্যিছেলের দশচক্রে, লেবুমামার কাণ্ডকারখানা এগুলো ছিল সেসময়ের জনপ্রিয় শিশুসাহিত্য। মেলায় দেখাও হতো কত লেখকের সঙ্গে।
এখলাসউদদীন আহমেদ, আলী ইমাম ভাই কত গল্প করতেন। বইতে কিছু শুভেচ্ছাবাণী লিখে দিতেও ভুলতেন না। তখন আজকালকার মতো জোর করে বই কেনার জন্য ঝুলোঝুলি করতে দেখিনি কাউকে।
Advertisement
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ার সময় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দল বেঁধে বইমেলায় যেতাম। একে অন্যকে বই উপহার দেওয়ার রীতি ছিল। আমরা টিএসসিতে আড্ডা দিয়ে তারপর বইমেলায় ঢুকতাম। প্রায় প্রতিদিনই যাওয়া হতো। তখন বইমেলা মানেই যেন মাসজুড়ে উৎসব।
এর মধ্যেই পহেলা ফাল্গুনে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো আনন্দের রঙ। সে সময় আমরা ভ্যালেনটাইনস ডে’র নাম শুনিনি। ফাল্গুনটাই ছিল আমাদের আপন উৎসব। হলুদ শাড়ি পরে বইমেলায় যাওয়ার মধ্যেই খুঁজে পেতাম জীবনের সব সুখ। আর একুশের দিন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়ে বইমেলায় তো যাবোই।
পেশাগত জীবনে অনেকবার বইমেলা নিয়ে লিখেছি। আর একজন লেখক হিসেবে সারাবছর বইমেলার অপেক্ষায় থাকবো এটা তো খুবই স্বাভাবিক। ২০২২ সালে আমার লেখা ‘আমি বেগমবাজারের মেয়ে’ বইটি বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। এ বছর প্রকাশিত হচ্ছে দুটি বই। একটি কবিতার, ‘ব্যক্তিগত জোছনা কুড়ানোর রাত’ আরেকটি তথ্যমূলক বই ‘চীনের মুসলিম, চীনের মসজিদ’। আশা করছি এ বই দুটিও পাঠকের ভালো লাগবে।
হ্যাঁ, বইমেলাকে ঘিরে লেখক, প্রকাশক, পাঠক সবারই প্রত্যাশা থাকে। প্রতি বছরই বইমেলায় অনেক বই প্রকাশিত হয়। তার সবগুলোই যে খুব মানসম্পন্ন হয় তা নয়। তবে ভালো বই প্রকাশিত হয় না, এ কথাটাও ঠিক নয়। অনেক মানহীন বইয়ের ভিড়ে মানসম্পন্ন বইও অনেক থাকে। খুঁজে নিতে হয়, বেছে নিতে হয়।
Advertisement
১৬ কোটি মানুষের দেশে বই বিক্রি কিন্তু বিস্ময়করভাবে কম। তিন-চারশ কপি বই বিক্রি হলে মনে হয় অনেক বিক্রি হয়েছে। বইমেলায় লোকের অভাব নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে ক্রেতা কজন? যত মানুষ বইমেলায় ঢোকে তারা যদি প্রত্যেকে একটি করে বই কেনে তাহলেও কোনো স্টলে কোনো বই পড়ে থাকার কথা নয়।
এক প্যাকেট সিগারেটের দামে, দুই প্লেট চটপটির দামে একটি বই কেনা যায়। কিন্তু অনেক মানুষ সেটুকুও ব্যয় করতে নারাজ। অথচ তারাই বইমেলায় ঢোকার মুখে ফুলের মুকুট, মালা চুড়ি কিনছেন, বন্ধুবান্ধবীকে এটা ওটা খাওয়াচ্ছেন। তার মানে পকেটে টাকা আছে কিন্তু বই কেনার বেলায় সেটি পকেট থেকে বের হচ্ছে না।
আবার অনেকে বইমেলায় এসে উচ্চপদস্থ কোনো আমলা লেখককে তোষামোদ করার জন্য তার বইটি কিনে সরে পড়েন। আজকাল এমন লেখক অনেক আছেন। তারা স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে একটি অখাদ্য বই মেলায় প্রকাশ করেন।
অনেকে নিজেই লেখেন, অনেকে লিখিয়ে নেন টাকার বিনিময়ে। তারপরে সেই বই দেদারসে বিক্রি হয়। কারা কেনেন? যারা তাকে তেল দিতে ইচ্ছুক তারাই কেনেন। অনেক উচ্চমানের লেখক এই কেনা দেখে নিজের অবিক্রীত বইয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
তবে তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, হতাশ হবেন না। আপনার যদি আত্মবিশ্বাস থাকে যে, আপনি ভালো লেখেন তাহলে ধৈর্য রাখুন। সময়ই বলে দেবে সাহিত্যের অঙ্গনে কে টিকে থাকবে আর কে ঝরে যাবে।
তবে সব মিলিয়ে বইমেলা এখনও আমার প্রাণের বইমেলা। এখনও অপেক্ষায় থাকি কবে যাবো মেলার প্রাঙ্গণে যেখানে রয়েছে নতুন বইয়ের সৌরভ, লেখকের উজ্জ্বল দৃষ্টি, পাঠকের উৎসাহী মুখ। জয় হোক বইমেলার, জয় হোক বাংলা ভাষার।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম