জাতীয়

‘মুজিব কিল্লা’ নির্মাণে অগ্রগতি নেই, ফের বাড়ছে সময়-ব্যয়

ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জানমাল রক্ষায় দেশের উপকূলীয় এলাকায় মাটির কিল্লা নির্মাণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীকালে জনগণের কাছে এটি ‘মুজিব কিল্লা’ নামে পরিচিতি পায়। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ সেই গুরুত্বপূর্ণ মুজিব কিল্লা নির্মাণ প্রকল্পের চার বছর শেষ হলেও তেমন অগ্রগতি নেই। নতুন ও পুরনো মিলে ৫০৫টি মুজিব কিল্লা আড়াই বছরে শেষ করার জন্য নেওয়া হয় প্রকল্প। কিন্তু সাড়ে চার বছরে মাত্র ২৩ শতাংশ বা ১৫৯টি কিল্লা বাস্তবায়ন হয়েছে। যেখানে খরচ হয়েছে ৮ দশমিক ০৮ শতাংশ বা ১৬১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

Advertisement

প্রথম দফায় খরচ ও দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়েও বাস্তবায়নকারী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর শেষ করতে পারেনি প্রকল্পের কাজ। এখন দ্বিতীয়বারের মতো ব্যয়ের পাশাপাশি মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পের অবশিষ্ট মুজিব কিল্লার জন্য প্রয়োজনীয় জমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে নতুন রেট শিডিউলে আরেকটি প্রকল্প করার পরামর্শ দিয়েছে।

আরও পড়ুন: ‘মুজিব কিল্লা’ নির্মাণকাজে ধীরগতি, বাড়ছে সময়-ব্যয়

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি বছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি দুর্যোগে, বিশেষত উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর লোক মারা যায় এবং জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘূর্ণিঝড় বা বন্যা থেকে জানমাল রক্ষার্থে বহু মাটির কিল্লা নির্মাণ করা হয়।

Advertisement

বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে এগুলো নির্মিত হওয়ায় সর্বসাধারণের কাছে এটি ‘মুজিব কিল্লা’ নামে পরিচিত। দীর্ঘ দিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নির্মিত মুজিব কিল্লাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত ও বেদখল হয়ে যায়। বর্তমান প্রকল্পের মাধ্যমে পূর্বে নির্মিত কিল্লাগুলোর সংস্কার ও উন্নয়ন এবং নতুন কিল্লা নির্মাণ করে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

২০১৮ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় এক হাজার ৯৫৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকায়। আড়াই বছরে ৫৫০টি মুজিব কিল্লার কাজ শেষ করার কথা। পরে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে এবং খরচ ৪০ কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রকল্পটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার অনুমোদন পায়। কিন্তু তারপরও প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। বেশিরভাগ কাজই বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এখন ব্যয় আরও ২৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বৃদ্ধি এবং মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়িয়ে সাড়ে সাত বছরে অনুমোদনের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় মানুষের আশ্রয় হবে ‘মুজিব কিল্লায়’

প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রম হলো, ‘এ’ শ্রেণির ১৭৭টি কিল্লা নির্মাণ, যেখানে প্রতিটিতে একটি প্রাণিসম্পদ রাখার শেড ও অংশ খালি জায়গা থাকবে। ‘বি’ শ্রেণির ১৭৮টি কিল্লা, যেখানে প্রতিটিতে একটি প্রাণিসম্পদ রাখার শেড ও বাকি অংশ খালি জায়গা থাকবে। আর ‘সি’ শ্রেণিতে ১৫০টি মুজিব কিল্লা নির্মাণ, যেখানে প্রতিটিতে একটি প্রাণিসম্পদ রাখার শেড ও একটি তিনতলাবিশিষ্ট শেল্টার ভবন নির্মাণ।

Advertisement

ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, ‘এ’ শ্রেণির ১৭৭টি কিল্লা নির্মাণে ব্যয় ৪২২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। প্রতিটির ব্যয় দুই কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ‘বি’ শ্রেণির ১৭৮টি কিল্লা নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ৫২০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এখানে প্রতিটিতে খরচ হবে প্রায় তিন কোটি টাকা। আর ‘সি’ শ্রেণিতে ১৫০টি মুজিব কিল্লা নির্মাণে ব্যয় হবে এক হাজার ১২ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। প্রতিটির জন্য ব্যয় পড়বে পৌনে সাত কোটি টাকা। কারণ, এখানে একটি তিনতলাবিশিষ্ট শেল্টার ভবন নির্মাণ হবে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, প্রকল্পের আওতায় ৫০৫টি মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়নের মাধ্যমে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার প্রান্তিক মানুষ ও প্রাণিসম্পদের সুরক্ষা প্রদান নিশ্চিত করা হবে এবং সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শক্তিশালী হবে।

প্রকল্প সংশোধনের কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প অনুমোদন, জনবল নিয়োগ ও পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব এবং দেশে কোভিড-১৯ এর দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের কারণে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ জুলাই ২০১৮ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত মোট তিন বছর বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন: মুজিব কিল্লা নির্মাণ মনিটরিংয়ে গাড়ি পাচ্ছেন কর্মকর্তারা

প্রকল্পের মূল ডিপিপি এবং প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে পিডব্লিউডির ২০১৮ সালের রেট শিডিউল অনুসরণ করা হয়। নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং পিডব্লিউডির ২০২২ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী নির্মাণকাজের ব্যয় নির্ধারণ করার কারণে রাজস্ব ও মূলধন উভয় খাতে অধিকাংশ অঙ্গের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে প্রকল্প সাইটের সংখ্যা হ্রাস এবং অফিস ভবন ভাড়া বাদ দেওয়া ইত্যাদি কারণে কতিপয় অঙ্গে ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। ওই হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে প্রকল্পের ব্যয় ১৯৯৭ দশমিক ৪৭ কোটি টাকা থেকে ২৪ দশমিক ৩৬ কোটি টাকা (১.২১%) বেড়ে ২০২১ দশমিক ৮৩ কোটি টাকা নির্ধারিত হয়েছে।

আর নতুন অঙ্গ হিসেবে যাতায়াত ব্যয় অন্তর্ভুক্তি: বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত সাইটগুলোর কাজ মনিটরিং ও তদারকির লক্ষ্যে প্রকল্পের আওতায় ৪০ জন উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে প্রত্যন্ত এলাকায় ভ্রমণ করতে হয়। সর্বশেষ অনুমোদিত আরডিপিপিতে যাতায়াত ব্যয়ের সংস্থান না থাকায় দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে যাতায়াত ব্যয় অঙ্গে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা সংস্থান রাখা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলছে, প্রকল্পের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত গত সাড়ে চার বছরে বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ২৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। প্রকল্পটি ছিল আড়াই বছরের। অর্থাৎ প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এ পর্যন্ত ৬৪টি মুজিব কিল্লার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং ৯৫টির কাজ চলমান রয়েছে। এমতাবস্থায় আলোচ্য প্রকল্পের ১৫৯টির (৬৪+৯৫) মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সমীচীন হবে। চলমান ৯৫টি মুজিব কিল্লার নির্মাণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে একটি বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তার আলোকে প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এ ছাড়া অবশিষ্ট মুজিব কিল্লাগুলো নির্মাণের লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে।

তারা বলছেন, নতুন প্রকল্পের আওতায় অবশিষ্ট মুজিব কিল্লার জন্য প্রয়োজনীয় জমি সংক্রান্ত জটিলতা শুরু থেকে নিরসন করে নতুন রেট শিডিউল অনুযায়ী তার প্রাক্কলন করা যাবে বিধায় নতুন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন সহজ হবে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) এ কে এম ফজলুল হক জাগো নিউজকে জানান, মূল্যায়ন কমিটির মিটিং স্থগিত করা হয়েছে। প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। জমি সমস্যার কারণে প্রকল্পের কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে। জমিই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে প্রকল্পটি অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ।

এমওএস/এমকেআর/এমএস