কৃষি ও প্রকৃতি

বেড প্ল্যান্টিং পদ্ধতিতে ঝুঁকছেন চাষিরা

কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় বেড প্ল্যান্টিং পদ্ধতির চাষাবাদে ঝুঁকছেন রাজশাহী অঞ্চলের চাষিরা। সার, বীজ এবং পানির অপচয় কম হওয়ায় খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আধুনিক এই চাষপদ্ধতি।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘বেড প্ল্যান্টার’ যন্ত্রে বেড তৈরি করে চাষাবাদ করার ফলে কম সময়ে জমি যেমন তৈরি করা যায়; তেমনি সার, বীজ এবং পানির অপচয় কম হয়। আধুনিক এ পদ্ধতিতে এক চাষেই জমি তৈরি, সার দেওয়া, বীজ বপন, মই দেওয়া ও বেড তৈরির কাজ হয়। সার-বীজও সঠিক গভীরতায় পড়ে। ফলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া প্রচলিত চাষাবাদের তুলনায় বেড-নালা পদ্ধতিতে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পানি কম লাগে।

আবার অতি বর্ষণে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায়। ফাঁকা ও সারিবদ্ধ হওয়ায় জমিতে আগাছা পরিষ্কারও সহজ হয়। এতে ইঁদুরের উপদ্রপ থাকে না। এছাড়া আলো-বাতাস বেশি পেয়ে ফলন বাড়ে। এই বেড প্ল্যান্টিং পদ্ধতিতে ধান, গম, ভুট্টা, মুগডাল, সূর্যমুখী, সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করা যায়। এছাড়া এক ফসল ওঠার পর একই বেড পরের ফসলের জন্য ব্যবহার করা যায়। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে বেড প্ল্যান্টিং পদ্ধতির চাষাবাদ জনপ্রিয় হচ্ছে।

আঞ্চলিক কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে নানা সংকটে গম-ভুট্টা চাষ ধীরে ধীরে কমে আসছিল। তবে আধুনিক বেড-প্ল্যান্টিং পদ্ধতিতে ভালো ফলন ও দাম পাওয়ায় আবারও গম-ভুট্টা চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা।

Advertisement

আরও পড়ুন: যমুনার বালুচরে সূর্যমুখীর হাসি 

২০০৩ সালে রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলার মাত্র ৭০ কৃষক ১৮ হেক্টর জমিতে বেড প্ল্যান্টিং পদ্ধতিতে গম-ভুট্টা চাষ শুরু করেন। ভালো ফলন পেয়ে চাষিদের মাঝে জনপ্রিয় হতে থাকে এ পদ্ধতি। ২০১০ সালে বিভাগের ৪ হাজার ৬৯২ হেক্টর জমি এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন ১৪ হাজার ৫০০ কৃষক। ২০১৫ সালে ২৫ হাজার কৃষক এ পদ্ধতিতে ৬ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে গম-ভুট্টা চাষ করেন। চলতি মৌসুমে কৃষকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধির পাশাপাশি আবাদ হয়েছে ৬ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। সে হিসেবে গত ২০ বছরে আবাদ বেড়েছে ৩৭৮ গুণ।

রাজশাহীর কাশিয়াডাঙ্গা উপজেলার মুরালিপুর গ্রামের চাষি মো. ওমর ফারুক, আশিকসহ অনেকেই জানান, প্রচলিত পদ্ধতিতে হাত দিয়ে ছিটিয়ে গম ও ভুট্টা রোপণ করলে কোথাও বেশি কোথাও কম গাছ বের হতো। এছাড়া চাষাবাদের খরচও অনেক বেশি ছিল। তবে গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষের সময় একই সঙ্গে বেড ও নালা তৈরি হয়। বেডের ওপর ফসল ও নালায় পানি দেওয়া হয়। এতে সেচ কম লাগে। কম পানিতে গম-ভুট্টার বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হচ্ছে।

একই এলাকার মো. বেনু নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে ফসলের শেকড় মাটির গভীরে থাকায় গাছ হেলে পড়ে না। আবার বেডের সঙ্গে নালা থাকায় আগাছা দমন সহজ হয়। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করায় ইঁদুরের আক্রমণও হয় না। একই বেড না ভেঙে বিভিন্ন ফসল চাষ করা যায়। ব্যয়সাশ্রয়ী এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে ভালো ফলন মিলছে।’

Advertisement

আরও পড়ুন: লালশাক চাষ করার সহজ উপায় 

গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিডব্লিউএমআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও রাজশাহী অঞ্চল প্রধান ড. মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘প্রচলিত পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষের ক্ষেত্রে এক হেক্টর জমি চাষে খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। বীজ বপন ও নালা তৈরিতে শ্রমিক খরচ প্রায় ২৬ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে হেক্টরে খরচ হয় ৩৮ হাজার টাকা। কিন্তু বেড পদ্ধতিতে মাত্র একটি চাষেই বেড তৈরি, বীজ বোনা ও চাষ হয়ে যায়। এতে কৃষকের খরচ পড়ে ১০ হাজার টাকা। হেক্টরে সাশ্রয় হয় ২৮ হাজার টাকা। অন্যদিকে প্রচলিত পদ্ধতিতে গম চাষে হেক্টরে খরচ ১৫ হাজার টাকা। আর বেড প্ল্যান্টিং পদ্ধতিতে খরচ হয় মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা।’

নিজের এক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে ড. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘বেড প্ল্যান্টিং প্রযুক্তিতে সেচের পানি ২৫-৪০ শতাংশ সাশ্রয় হয়। ক্ষেতে নাড়া বা খড় থাকায় ১০-২০ শতাংশ ইউরিয়া ও ৯ শতাংশ পটাশ সার সাশ্রয় হয়। জ্বালানি সাশ্রয় হয় প্রায় ৪০ শতাংশ। টেকসই এ প্রযুক্তিতে কার্বন নিঃসরণ কম হয় প্রায় ৪৪ শতাংশ। আবার প্রচলিত চাষে প্রতি হেক্টরে ৪৫ লিটার জ্বালানি পোড়ে। তাতে উৎপন্ন হয় ১১২ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড। কিন্তু বেড পদ্ধতিকে চাষে জ্বালানি পোড়ে ১৭ লিটার। তাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয় ৪২ লিটার। এ পদ্ধতিতে চাষে ৭০ লিটার কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়। ফলে কম খরচে ফলন ও লাভ ভালো হওয়ায় কৃষকরা বেড প্ল্যান্টিং পদ্ধতির চাষাবাদে ঝুঁকছেন।’

আরও পড়ুন: বোরো চাষে দরদি কৃষক, এ বছর সুখবরের সম্ভাবনা 

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, ‘বেড প্ল্যান্টিং পদ্ধতি কৃষি ও কৃষকবান্ধব একটি ভালো উদ্যোগ। বেড প্ল্যান্টিং উত্তর-দক্ষিণমুখী ও ফাঁকা ফাঁকা হওয়ায় আলো-বাতাস ভালো লাগে। এতে ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে। এছাড়া ইঁদুর অন্ধকার ও জরাজীর্ণ জায়গা পছন্দ করায় এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা ফসলের ক্ষতি করতে পারে না।’

এসএইচ/এসইউ/জিকেএস