বারো মাসে বছর। অথচ একজন লেখক হিসেবে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ফেব্রুয়ারি মাস। কারণ পুরো ফেব্রুয়ারিজুড়েই চলে আমাদের প্রাণপ্রিয় অমর একুশে বইমেলা। একুশের চেতনার পূর্ণাঙ্গ ফসল আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে একুশের চেতনায় ধীরে ধীরে অমর একুশে বইমেলা একটি স্থায়ী রূপ পেয়েছে।
Advertisement
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে বাংলা একাডেমিতে প্রথম সাত দিনব্যাপী একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানকে ঘিরেই মুক্তধারা’র প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির সামনের আমতলায় পাটের চট বিছিয়ে নিজের প্রকাশনার কিছু বই নিয়ে একুশে বইমেলার সূচনা করেন। তারপর ধীরে ধীরে অন্য প্রকাশকরা এই বইমেলায় যোগ দিতে শুরু করেন।
তারপর অমর একুশে বইমেলার কেবল পরিসর বৃদ্ধিই পায়নি, বরং বাংলা একাডেমি চত্বর ছাড়িয়ে এখন সেটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি মাসব্যাপী স্থায়ী বইমেলায় পরিণত হয়েছে। মাঝখানে করোনা মহামারির কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালের অমর একুশে বইমেলা কিছুটা নানান কিসিমের শৃঙ্খলার ঘেরাটোপে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। কিন্তু এবছর ২০২৩ সালে অমর একুশে বইমেলা আবারো স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে হতে চলেছে। এবছর বইমেলার ডিজাইন অনেকটাই গোছানো।
আমাদের সব জাতি গোষ্ঠী, বর্ণ ও শ্রেণির সবার জন্যই এককথায় আমাদের একটাই সাংস্কৃতিক উৎসব। আর সেটা অবশ্যই ফেব্রুয়ারিজুড়ে চলা অমর একুশে বইমেলা। যে কারণে দেশের সর্ববৃহৎ এই সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য আমি বাকি এগারো মাস মুখিয়ে থাকি। বইমেলার সবচেয়ে প্রাণবন্ত দৃশ্য হলো যেদিকেই যাব সেদিকেই কেবল বই আর বই। মাসব্যাপী এই বইয়ের হাট আমার সবচেয়ে প্রিয়।
Advertisement
বইয়ের হাটে গেলে আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, নতুন বইয়ের সুন্দর সুন্দর প্রচ্ছদ, নতুন বইয়ের চোখ ধাঁধানো বাঁধাই, নতুন বইয়ের চমৎকার সব লেখা, এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখায় আমি প্রচুর আনন্দ পাই। এমনকি বইমেলা থেকে আমি নতুন নতুন বিষয় নিয়ে চিন্তা করারও খোরাক পাই। যে কারণে অমর একুশে বইমেলা আমার প্রাণের মেলা।
প্রতি বছরই আমি অমর একুশে বইমেলার ভালো এবং মন্দ দিক নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় বেশ সরব থাকি। আমার একটাই উদ্দেশ্য থাকে প্রাণের এই অমর একুশে বইমেলা যেন আরও সুন্দর হয়, আরও পরিপাটি হয়, আরও গোছানো হয়, আরও পরিচ্ছন্ন হয়, আরও নির্বিঘ্ন হয়, আরও স্বতঃস্ফূর্ত হয়, সেটি যেন আয়োজক বাংলা একাডেমি যথাযথভাবে পালন করে, সেটি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই অনেকটা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াই।
বইমেলায় গেলে সারাদেশ ও বিদেশ থেকে আমার যত বন্ধুরা আসে তাদের সাথে কুশলবিনিময় ও আড্ডা দেওয়ার সুযোগ পাই। কেবল অমর একুশে বইমেলার মাসেই এই সুযোগটি পাই। বইমেলায় গেলে নতুন বই নিয়ে শিশুদের অবারিত আনন্দ দেখার সুযোগ পাই। বই নিয়ে শিশুদের আনন্দময় চোখ দেখা যে কোনো লেখকের জন্য একটি অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য।
আমার অ্যাজমা আছে কিন্তু বইমেলার ধুলো আমার অপছন্দ হলেও খুব একটা খারাপ লাগে না। কারণ এই ধুলো থেকেও আমি কেবল আনন্দ কুড়াই। মানুষের ভিড়ে বইয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করতে আমার ভালো লাগে। লিটলম্যাগ চত্বরে নতুন পুরাতন ছেলেমেয়েদের সাথে গানবাজনা করতে আমার ভালো লাগে। যে কারণে সময় সুযোগ পেলেই আমি বইমেলায় ছুটে যাই।
Advertisement
আমি কার্যত বইমেলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই বইমেলা চত্বরে যাওয়া শুরু করি। কারণ তখন বইমেলার মাঠে বসে বৈচিত্র্যময় এক অস্থায়ী হাট। এই হাটে বইমেলার স্টল সজ্জার সামগ্রী বিক্রি হয়। সেখানে কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, কাঠের দোকানি, রঙের দোকানি, লোহার দোকানিসহ নানান পেশার মানুষের এক অস্থায়ী হাট বসে। মিস্ত্রিদের স্টল সজ্জার কাজ দেখতেও আমার খুব ভালো লাগে।
আমি লেখালেখির পাশাপাশি এখন সিনেমা বানাই। তাই নানান পেশার মানুষের বৈচিত্র্যময় কাজ পর্যবেক্ষণ করাও অনেকটাই আমার কাজের অংশ। সিনেমায় চরিত্র বিনির্মাণে এই দেখা ও পর্যবেক্ষণ আমার জন্য অনেক সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যে কারণে বইমেলার সামগ্রিক বিষয়টি আমার নজরদারির অংশ হয়ে ওঠে।
প্রতি বছর আমাদের চাওয়া থাকে বাংলা একাডেমি একটি সফল ও নির্বিঘ্ন অমর একুশে বইমেলা আয়োজন করুক। বইমেলার নানান অসঙ্গতি চোখে পড়লেই তাই আমি সেই বিষয় নিয়ে কলম ধরি, কাগজে লিখি, সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখি। আয়োজক বাংলা একাডেমির কাজে সর্বত্রভাবে সহায়তা করাই থাকে আমার সমালোচনামূলক সেসব লেখার উদ্দেশ্য।
এবছর রমনা কালীমন্দিরকে বইমেলার অংশ করার বিষয়টি আমি ইতিবাচকভাবে দেখছি। বইমেলায় যেহেতু প্রতি বছর মসজিদ নির্মিত হচ্ছে, তাই কালীমন্দির বইমেলার অংশ হওয়ায় বিষয়টি আরও নান্দনিক হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক মহামিলনমেলা আমাদের অমর একুশে বইমেলা। কিন্তু মিলনমেলার আনন্দের পাশাপাশি বইমেলার নিরাপত্তা নিয়ে আমি সবসময় উদ্বিগ্ন থাকি।
তাছাড়া অমর একুশে বইমেলার এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো লেখক ও প্রকাশকদের নিরাপত্তা। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বহুমাত্রিক লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ অমর একুশে বইমেলা থেকে ফেরার সময় নৃশংস হামলার শিকার হন। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রবাসী মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী লেখক বন্যা আহমেদ বইমেলা থেকে ফেরার পথে নৃশংস হামলার শিকার হন। ওই নৃশংস হামলায় বন্যা আহমেদ প্রাণে বেঁচে গেলেও অভিজিৎ রায়কে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক নিহত অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশিত হয়েছিল প্রকাশনা সংস্থা ‘শুদ্ধস্বর’ ও ‘জাগৃতি’ থেকে। যে কারণে একই বছর ৩১ অক্টোবর জাগৃতি প্রকাশনার প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপেনকে আজিজ সুপার মার্কেটে তার কার্যালয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় এবং একই দিনে অন্য আরেকটি হামলায় লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, কবি তারেক রহিম ও লেখক রনদীপম বসু গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। নৃশংস এসব হামলার গ্লানিও বইমেলার।
বইমেলার সময় লেখক ও প্রকাশকদের নিরাপত্তার বিষয়টি তাই আমার মধ্যে একটি উদ্বেগ তৈরি করে। আশা করব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বইমেলার সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত দৃঢতার সাথে নজরদারি করে অমর একুশে বইমেলাকে সফল করতে সহায়ক ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন।
একটি ভালো বই আপনার ও পরবর্তী প্রজন্মের সারাজীবনের বন্ধু। তাই বই হোক আমাদের পরম বন্ধু। বইমেলা হোক আমাদের সবার প্রাণের মেলা। মহান একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা একুশকে ছড়িয়ে দেব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তবেই কেবল বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একটি অনন্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। সবাইকে অমর একুশে বইমেলায় স্বাগতম।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
এইচআর/ফারুক/এএসএম