৩০ জানুয়ারি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর পেশোয়ারে মসজিদে ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা হামলার দায় স্বীকার করেছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে পৌঁছেছে একশ’তে ও দেড় শতাধিক আহত হয়েছেন।
Advertisement
অনেকের ধারণা তালেবানরা কেবল আফগানিস্তান আর পাকিস্তানেই জন্ম নেয়। এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। তালেবান কোনো বিশেষ দেশের নাগরিকত্বের নাম নয়। এটি এক বীভৎস মন-মানসিকতার নাম। যে কোনো দেশেই মানুষের মগজধোলাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তালেবান তৈরি করা সম্ভব। তাই এদের বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। তালেবান এবং ইসলাম দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।
অনেক উগ্রবাদী জঙ্গি হত্যাযজ্ঞ চালানোর উদ্দেশে আত্মাহুতি দেয়। তাদের ধারণা, এতে পরকালে স্বর্গ লাভ হবে। কিন্তু এটা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থি। ইসলামে আত্মহত্যা নিষেধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা আত্মহত্যা করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু’ (সুরা নিসা: আয়াত ৩০)।
ইসলাম শান্তিপূর্ণ ধর্ম। সর্বক্ষেত্রে শান্তির বিধান নিশ্চিত করে প্রেম-প্রীতি, সৌহার্দ্য আর শান্তি ও সম্প্রীতির এক পরিমণ্ডল বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। ইসলাম মানুষের জীবনে শান্তির এমন বায়ু প্রবাহিত করে, যা মানুষের দেহের সুস্থতায়, দৈহিক শক্তি-সামর্থ্য, তার আত্মায়, সব ধর্মের সঙ্গে প্রীতিময় সম্পর্ক গড়ে তোলাসহ সর্বদিক দিয়ে মানুষকে সতেজ করে। অন্যদিকে তালেবানি আক্রশের শিকার হয়ে গত কয়েক দশকে আফগানিস্তানে যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ বলী হয়েছে। এদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাও অনেক। বহু নারী ধর্ষণ ও খুনের শিকার হয়েছেন, হচ্ছেন। তালেবান আর আইএস সংঘাত চালিয়ে গেছে সরকারের সঙ্গে আবার নিজেদের সঙ্গেও। সমৃদ্ধ আফগানিস্তান আজ ধ্বংসের নগরী। মানবতা ওখানে বিপন্ন।
Advertisement
একটি মিথ্যা অপপ্রচার বা গুজব কত সহজেই যে জনগণের কোন কোন অংশকে উত্তেজিত করে ভয়ঙ্কর কাণ্ড তথা লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে পারে তার অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমাদের দেশেই রয়েছে।
কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ আর ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে স্পষ্ট। এছাড়া বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন মত ও চিন্তার ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণ ও হত্যা দেশে জঙ্গিবাদীদের উপস্থিতি জানান দেয়।
আমরা দেখতে পাই এসব ধর্মীয় উগ্রবাদী ও স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা অপপ্রচার এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং সরকার ও প্রশাসনের ওপর পেশিশক্তি দেখিয়ে বিভিন্ন দাবি আদায়ের চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করে। বিশেষ করে দেশে যখন কোনো ক্রান্তিকাল উপস্থিত হয় আবার যখন কোনো ইস্যু থাকে না তখন ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের লক্ষ্যে এরা নানা ইস্যু সৃষ্টির চেষ্টা করে।
আশঙ্কা হয়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঐসব অশুভ শক্তি আবারও মাঠ গরম এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টায় মাঠে নেমেছে। এসব উগ্রধর্মান্ধদের ব্যাপারে সরকার, সচেতন জনগণসহ সব বিবেকবান মানুষের উচিত হবে আরও অধিক সচেতন থাকা।
Advertisement
পাকিস্তানে যেমন ধর্মকে ব্যবহার করে দেশটাকে বারটা বাজিয়ে ছেড়েছে ঠিক একইভাবে এদেশকেও চাচ্ছে উগ্রধর্মান্ধদের কেন্দ্রে পরিণত করতে। ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমনভাবে ধর্মান্ধরা বিরোধিতা করেছে একই কায়দা এদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর জন্য এরা মেতে উঠেছে।
বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর প্রচেষ্টারত পাকিস্তানের কুখ্যাত জঙ্গি মৌলবাদী নেতা মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সফর করে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দৈনিক ভোরের কাগজ, জনকণ্ঠ, সংবাদ ইত্যাদি পত্রিকায় তার সাক্ষ্য হয়ে আছে।
ধর্মান্ধদের দ্বারা প্রফেসর হুমায়ুন আজাদ যখন আক্রমণের শিকার হন তার পরপরই মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি আবার গোপনে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি ঢাকায় এসেই বিভিন্ন স্থানে গোপনে বৈঠকও করেছেন। যদিও এ জঙ্গি নেতা মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তার পরেও এদেশে এসে তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। তার সম্পর্কে সে সময়ে দেশের পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে।
মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি যে একজন জঙ্গি নেতা ছিলেন তা খোদ পাকিস্তানেরই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তার সাক্ষ্য। পাকিস্তানের একটি দৈনিকে বলা হয়, মঞ্জুর চিনিউটি নিজ এলাকায় ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক হিংসার বিষ তৈরি করে পরিবেশকে দূষিত করেছে। (দৈনিক মসাওয়াত, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৮৮) এছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে উল্লেখ ছিল, ‘মওলানা মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি ধর্মের নামে মানুষকে প্রতারণা করেছে, সে একজন ফতোয়াবাজ হিসেবে চিহ্নিত’। (দৈনিক দিনকাল, ১ এপ্রিল ১৯৯৪)
কুখ্যাত এ জঙ্গি নেতার নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে বিবিসিতে প্রচারিত উর্দু সংবাদে বলা হয় ৪৫০ জন ধর্মীয় নেতার ওপর নিষেধাজ্ঞা। পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার মহররম মাসে ৪৫০ জন বিভিন্ন ধর্মীয় নেতার ওপর বিভিন্ন স্থানে সফরের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এ নিষেধাজ্ঞার কারণ হলো, তারা যেন এমন বক্তৃতা না করতে পারে যার দ্বারা শান্তিশৃঙ্খলা ও জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এ নেতাদের মধ্যে মঞ্জুর আহমদ চিনিউটি অন্যতম।
এক সময় পাকিস্তান থেকে নিয়মিত জঙ্গি মৌলবাদী নেতারা এদেশে এসে তথাকথিত জিহাদি বক্তৃতায় মাঠ গরম করত, ঠিক তেমনি এদেশে তাদের চেলারাও পাকিস্তানে গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে আসতো। মাওলানা সুবহানের তালেবান কানেকশন প্রসঙ্গে দৈনিক সংবাদে ২৩ জুন, ২০০৭ প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘মাওলানা সুবহানের তালেবান কানেকশন ছিল প্রকাশ্য’।
সংবাদটিতে উল্লেখ করা হয়, ত্রাণের টিন আত্মসাতের দায়ে আটক ‘সৎ লোকের দল’ জামায়াতে ইসলামী নেতা এবং সাবেক এমপি মাওলানা আবদুস সুবহানের তালেবান কানেকশন ছিল প্রকাশ্য। তিনি নিজেই পুস্তিকা ছাপিয়ে তা প্রচার করেছেন। জোট সরকারের সময় এক জামায়াতি মন্ত্রী পাকিস্তানে সরকারি সফরে গিয়ে সে সফর শেষ হওয়ার পর ব্যক্তিগত কাজে দু’দিন অবস্থান করেন পাকিস্তানে। জানা যায়, সে সময় তিনি বৈঠক করেন পাকিস্তানে তালেবানপন্থি জঙ্গিদের সঙ্গে। তার এ তৎপরতা প্রকাশ্য না হলেও জামায়াতের তালেবান নেতা মাওলানা সুবহান তালেবানের সঙ্গে তার প্রকাশ্য সম্পর্কের কথা ঘোষণা করেছেন।
২০০১ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি যে পুস্তিকা প্রকাশ করেন তাতে তার নানা কৃতিত্বের সচিত্র বিবরণ দেওয়া হয়। এতে একটি ছবিতে দেখা যায় পাকিস্তানের পেশোয়ারে তালেবান নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের সঙ্গে বৈঠক করছেন তিনি।
এ সময় তার সঙ্গে আরও কিছু জামায়াতি নেতাকেও চিত্রে দেখা যায়। এ সূত্রগুলো জানায়, সুবহান তার এ তালেবান কানেকশনের কথা কখনো গোপন করেননি বরং জামায়াতকে সে তালেবানি ধারায় পরিচালনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল খুবই সক্রিয়’ (সংবাদ ২৩/৬/২০০৭)।
সম্প্রতি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি-থানচি এলাকায় অভিযান চালিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আরও পাঁচ প্রশিক্ষণরত সদস্যকে আটক করেছে র্যাব। জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) প্রভৃতি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন থেকে সদস্য নিয়ে গঠিত জঙ্গিদের নতুন প্ল্যাটফর্ম। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার হয়েছে সংগঠনটির বেশ কিছু সদস্য।
এখনো সময় আছে এই ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই তাহলে আমরা এক বুক আশা নিয়ে বলতে পারব আমার বাংলা, আমার অহংকার, বাংলা আমার মা, এই বাংলায় ধর্মান্ধদের কোনো স্থান নেই। এই বাংলাকে আমরা কখনও পাকিস্তান আর আফগানিস্তান হতে দেব না।
আমরা যদি এখনই এদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেই তাহলে এরজন্য আরও ভয়াবহ মূল্য দিতে হতে পারে ভবিষ্যতের অনাগত সন্তানদের। তাই এসব উগ্রধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে সরকারকে যেমন আরও কঠোর হতে হবে তেমনি সমগ্র দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
পরিশেষে একটি মৌলিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখা শেষ করব। আমাদের অনেকের ধারণা হলো, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে যা হচ্ছে আমাদের এখানে তা হবে না। বিপদ দেখে উটপাখির মতো মাথাটা বালির মধ্যে লুকালে কিন্তু রক্ষা পাওয়া যাবে না।
কেননা, ‘তালেবানিত্ব’ কোনো জাতীয়তা বা কোনো বিশেষ দেশের নাগরিকের নাম নয়। নির্দিষ্ট একটি সীমানায় আবদ্ধ কোনো জীবেরও নাম নয়। এটি একটি বিকৃত মানসিকতার নাম। এটি যেকোনো দেশে যেকোনো সময় মাথাচাড়া দিতে পারে।
তাই সময় থাকতে তালেবানি আদর্শকে যারা সাপোর্ট করে, তাদের মতাদর্শ অবলম্বন করতে চায় এ ধরনের মনমানসিকতা যারা রাখে তাদের বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। যাতে কোনো অপশক্তি কোনো অবস্থায়ই মাথাচাড়া না দিতে পারে। কেননা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় ধর্মান্ধদের কোনো স্থান নেই।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।masumon83@yagoo.com
এইচআর/ফারুক/এএসএম