পাকিস্তানের তাজা খবর হচ্ছে সে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার শূন্য। ওষুধ বা খাদ্যের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্যও কোনো অর্থ তাদের কোষাগারে নেই। তাদের সামনে দৃশ্যত এখন একটি পথই খোলা- নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা। তবে তারা বিকল্প পথ বেছে নিতে চায়। আর তা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পরমাণু বোমা বিক্রি।
Advertisement
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবর হচ্ছে, সৌদি আরব, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার কাছে পরমাণু বোমা বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের পরমাণু বোমা তৈরিতে সৌদির বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে। কাজেই তারা চাইলেই পাকিস্তান থেকে পারমাণবিক বোমার চালান গ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে ইরান পারমাণবিক গবেষণা অব্যাহত রাখায় সৌদির ঝুঁকি বেড়েছে।
ঘটনা যাই হোক, পাকিস্তানকে জান বাঁচাতে ঘরের ঘটি-বাটি বিক্রি করার সময় এসেছে। কারণ ভারতের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে পরমাণু বোমা বানিয়ে পাকিস্তানের শুধু তহবিল শূন্য হয়নি, তারা এখন ঋণের দায়ে জর্জরিত। সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের ক্ষমতাও আজ তাদের নেই। ঋণের পরিমাণও আকাশচুম্বি।
জানা যায়, পাকিস্তানের মোট ঋণের পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ সম্পদের ৯০ শতাংশ। ঋণের এই বোঝা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। মূলত যে ওয়াদা করে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজে হাত দিয়েছিলেন তা মেনে চলা সম্ভব ছিল না।
Advertisement
১৯৭৪ সালের ১৮ মে রাজস্থানের পোকরানে প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় ভারত। এই ঘটনায় পাকিস্তান বেসামাল হয়ে পড়ে। কেননা ভারত পারমাণবিক বোমার মালিক হলে তাদের শক্তি বা মর্যাদা অবশিষ্ট থাকবে না। যে চিন্তা সেই কাজ। পাকিস্তানের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বুক চিতিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘ঘাস খেয়ে থাকতে হলেও পরমাণু বোমা বানাব’। কারণ তিনি জানতেন পাকিস্তানের হাতে এমন অর্থ মজুত নেই, যা দিয়ে পরমাণু গবেষণা চালানো যায়।
এরপর প্রায় ৫০ বছর কেটে গেছে। ভারত ও পাকিস্তান প্রায় একই সঙ্গে পরমাণু শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই পরমাণু বোমা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে পাকিস্তানকে নিতে হয়েছে বিপুল পরিমাণ ঋণ। সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের ক্ষমতা আজ পাকিস্তানের নেই। একটি অসম প্রতিযোগিতায় নেমে পাকিস্তান এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
জন্মলগ্ন থেকে ভারত ও পাকিস্তান বৈরী ভাবাপন্ন। গত ৭৫ বছরে তারা কমপক্ষে তিনবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। প্রতিবারই পাকিস্তান নাস্তানাবুদ হয়েছে। এরপরও তারা নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। মূলত এই দুই দেশের মধ্যে কোনো তুলনা চলে না। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত শূন্য। অপরদিকে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের পরিমাণ ৫৭৪ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি।
মূলত ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে তারা সর্বস্বান্ত হয়েছে। তারা সামাজিক উন্নয়নে তেমন কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারে না। ফলে জনগণের জীবনমানের কোনো উন্নতি ঘটেনি। দেশের সর্বত্রই দারিদ্র্যের ছাপ। কষ্টার্জিত সব বৈদেশিক মুদ্রাই বিশাল সেনাবাহিনীর পেছনে ব্যয় করতে হয়েছে। তাদের বড় অংকের বেতন-ভাতা এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় বাবদ যে অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে রাষ্ট্রের আয় থেকে তা মেটানো কখনও সম্ভব ছিল না।
Advertisement
ফলে প্রতি বছর ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এখন আর কেউ ঋণও দিতে চায় না। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। আজ সে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার সামর্থ্য নেই। এর ওপর আছে রোগ-ব্যাধি। এমনিতেই পাকিস্তানে রোগ-ব্যাধির প্রকোপ অনেক বেশি। সেই সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও বেশি। জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে বিভিন্ন রোগ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে ব্যর্থ পাকিস্তান, রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ।
পাকিস্তানের সর্বাধিক জনপ্রিয় ইরেজি দৈনিক ‘ডন’-এ সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। লিখেছেন পাকিস্তানের ‘শিফা তামির-ই-মিল্লাত বিশ্ববিদ্যালয়ের’ অধ্যাপক তথা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ বিষয়ক উপদেষ্টা জাফর মিরজাই। তিনি দেশটির অস্বাস্থ্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যান্য দেশকে টেক্কা দিলেও পাকিস্তান শুধু জনসংখ্যার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির হারেই টক্কর দিতে পারছে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ পাকিস্তান রোগেরও বিশাল বোঝা বহন করছে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও মারাত্মভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিবন্ধটিতে পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হতাশাজনক দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় সমস্যা। ১৯৪৭ সালে দেশটির জনসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ। কিন্তু বর্তমানে সেই জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ২২ কোটিতে। এভাবে চললে ২৭ বছর পর ২০৫০ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা হবে প্রায় ৩৫ কোটি। বিশ্বে জনসংখ্যার দিক দিয়ে পাকিস্তান এখনই পঞ্চম, এশিয়ায় চতুর্থ।
দেশটিতে তবুও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টাই নেই। বাংলাদেশ অবশ্য এ বিষয়ে ঠিক উল্টো পথে হাঁটছে। অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক ডামাডোলের পরও বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৯৫০-এর ৪ কোটি ৫০ লাখ থেকে বেড়ে পাকিস্তানের ৩ কোটি ৬০ লাখ থেকে বেড়ে ২৭ কোটির বিপরীতে মাত্র ১৭ কোটি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার ১.১ শতাংশ। আর পাকিস্তানের জনসংখ্যা বাড়ছে ১.৮ শতাংশ হারে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে পাকিস্তানের শিশুমৃত্যুর হার। প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে ৪০টি শিশু চার সপ্তাহের মধ্যেই মারা যাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার ২৩.৬৭২। শিশু মৃত্যু হারে পাকিস্তানের আগে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার শহর লেসেথো। সেখানে এই হার ৪৪।
দক্ষিণ সুদানেও পাকিস্তানের মতো প্রতি হাজারে ৪০টি নবজাতকের মৃত্যু হয়। পাকিস্তানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টি ও রুগণতার হার ৩৭.৬ শতাংশ। তাদের থেকে খারাপ অবস্থা একমাত্র আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির দরিদ্রতম দেশগুলোর। অপুষ্টির হাত ধরে পাকিস্তানের শিশুদের ভবিষ্যৎ জর্জরিত। শারীরিক ও মানসিকভাবে পাকিস্তানের শৈশবটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
‘ডন’ পত্রিকার মতে, পাকিস্তানিদের স্বাস্থ্যের বেহাল পরিসংখ্যানের পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী অবহেলা আর উদাসীনতা। বাংলাদেশ ঠিক উল্টা পথে হেঁটে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য পাচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে সেই চিত্রই উঠে আসছে। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাকিস্তানের ১৫ থেকে ৪৯ বছরের ৪২শতাংশ নারীই আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্ত স্বল্পতায় ভোগেন। ফলে শিশুর জন্মের সময় ওজন কম হয়। এমনকি প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণে মাতৃমৃত্যুহারও বেশি।
জাফর কমরজাইগের মতে, মায়েদের অপুষ্টিজনিত মৃত্যু কমানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়। রাষ্ট্র চাইলেই তা পারে। কিন্তু পাকিস্তানে সেটা হচ্ছে না। ফলে অল্প ওজন নিয়ে জন্মানো রুগণ শিশুরাই হয়ে উঠছে রাষ্ট্রের বোঝা। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত দেশের স্বীকৃতি পেলেও পাকিস্তান এখনও পোলিও দূর করতে পারেনি। আফগানিস্তানের মতো পাকিস্তানে পোলিও এখনও শিশুর মৃত্যু ডেকে আনছে। কোটি কোটি মার্কিন ডলার খরচের পরও সরকারের উদাসীনতায় এই দুই দেশ পোলিও দূরীকরণে ব্যর্থ।
চীন বা ভারতের থেকে অনেক কম জনসংখ্যা হলেও পাকিস্তানে হেফাটাইটিস-সি আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। প্রায় ১ কোটি পাকিস্তানি এই ভাইরাসে আক্রান্ত বলে জানা গেছে। পরিসংখ্যান মতে, হেপাটাইটিস-সি বা অন্যান্য রক্তবাহিত রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো একই সিরিঞ্জের বারবার ব্যবহার। পাকিস্তানের ইঞ্জেকশনের পরিসংখ্যানও বেশ চমকপ্রদ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় পাকিস্তানে। প্রতি বছর জনপ্রতি ৮-১০টি। কিন্তু জাফর মিরজার মতে, এর মধ্যে ৯৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই ইঞ্জেকশনের প্রয়োজনই নেই। চিকিৎসা অনুশীলন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারি অবস্থাকেই তিনি দায়ী করেছেন স্বাস্থ্য বিভ্রাটের জন্য। এদিকে বাংলাদেশ টিবি রোগ প্রতিরাধে অনেকটাই সাফল্য পেয়েছে। প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ২২১ জন টিবি রোগী।
পাকিস্তানে প্রতি বছর ৫ লাখ ১০ হাজার মানুষ নতুন করে টিবি রোগে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে গড়ে ১৫ হাজার রোগীর কোনো ওষুধেই কাজ হয় না। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের মতে, টিবি আক্রান্তের হারে বিশ্বের চার নম্বরে রয়েছেন তারা। এছাড়া বর্তমানে পাকিস্তানের আনুমানিক ১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ এইডস রোগে আক্রান্ত। ফিলিপাইনের পর, এশিয়ায় এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির হার পাকিস্তানেই সবচেয়ে বেশি। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে এইডস আক্রান্তের হার। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৫ হাজার রোগী যুক্ত হচ্ছেন এইচআইভি আক্রান্তের তালিকায়।
এসব পরিসংখ্যান থেকেই পাকিস্তানিদের স্বাস্থ্যের অবস্থা বোঝা যায়। বেশিরভাগ রোগ প্রথমেই প্রতিরোধযোগ্য। তারপরও বিকশিত হলে সেগুলো চিকিৎসাযোগ্য। কিন্তু পাকিস্তান রোগ প্রতিরোধ বা রোগের চিকিৎসায় চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ বলে উল্লেখ করেছে পাকিস্তানি পত্রিকাটি। তাদের মতে, পাকিস্তানে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি সর্বব্যাপী এবং সেটা বাড়ছেও। সঠিক পুষ্টি, পরিশুদ্ধ পানীয় জল এবং বিশুদ্ধ বাতাস-এই তিনটিতেই রয়েছে মারাত্মক ঘাটতি।
পাকিস্তান বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ দূষিত দেশ। লাহোর এখন পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহর। পাকিস্তানে তামাক সেবনের প্রবণতাও খুব বেশি। ব্যাপক তামাক সেবন এবং তামাক সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলের উচ্চ হারসহ বিশ্বের ১৫টি দেশের মধ্যে অবস্থান করছে পাকিস্তান। ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়াী পাকিস্তানে জনসংখ্যার ১৯.১ শতাংশ, অর্থাৎ ৪ কোটির বেশি মানুষ তামাক সেবন করেন। এদের মধ্যে নারী রয়েছেন ৫.৮ শতাংশ।
পাকিস্তানের বর্তমান গড় আয়ু ৬৭.৭ বছর। এর বিপরীতে বাংলাদেশে গড় আয়ু এখন ৭১.৯৭। আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশ থেকে শুরু করে বিশ্বের ১৩৯টি দেশের গড় আয়ু পাকিস্তানেরর থেকে বেশি। একজন বাংলাদেশীর থেকে একজন পাকিস্তানির গড় আয়ু প্রায় পাঁচ বছর কম। তাই তাদের প্রশ্ন, কেন পাকিস্তানিরা কম দিন বাঁচবেন? গুণগত জীবনধারা বা চিকিৎসা ব্যবস্থা কেন খারাপ থাকবে?
উত্তরটাও তারাই সহজভাবে দিয়েছেন। বাংলাদেশ গুরুত্ব দিলেও রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান জনগণের স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেয়নি। প্রতিরোধযোগ্য রোগকে প্রতিরোধ অথবা চিকিৎসাযোগ্য রোগের চিকিৎসা, দুটোর কোনোটাই হচ্ছে না পাকিস্তানে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস