ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপি পরস্পরের প্রতি আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ যেমন অব্যাহত রেখেছে, তেমনি মাঠে শক্তি পরীক্ষায়ও অবতীর্ণ হয়েছে। বিএনপি যে ধরনের কর্মসূচিই দিক না কেন আওয়ামী লীগও তার পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছে। বিএনপি অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে সংঘাত এড়িয়ে চলছে, এটা ভালো লক্ষণ।
Advertisement
ঢাকায় চারদিনের পদযাত্রার কর্মসূচির শুরুর দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘অবিলম্বে পদত্যাগ করুন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিন এবং নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করার ক্ষমতা দিন। অন্যথায় আপনাদের অত্যন্ত ভারাক্রান্তভাবে চলে যেতে হবে, পালাবার পথ খুঁজে পাবেন না।’
এর জবাবে ২৯ জানুয়ারি রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আজ যারা বলে আওয়ামী লীগ পালানোর সুযোগ পাবে না, তাদের আমি স্পষ্ট বলতে চাই, পালায় আপনাদের নেতারাই।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘বিএনপি নেতারা নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে তাদের দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় স্ট্যাম্পে মুচলেকা দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল আর রাজনীতি করবে না বলে। সেই কথা কি বিএনপি নেতাদের মনে নেই? দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত খালেদা ও তারেক। এমনকি তারেক-কোকোর মাধ্যমে খালেদা জিয়া যে টাকা পাচার করেছিলেন, তার ৪০ কোটি টাকা আমরা বিদেশ থেকে ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী এটাও বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ কখনো পালায় না বরং জনগণকে নিয়ে কাজ করে। কেননা এই সংগঠন জাতির পিতা শেখ মুজিবের হাতে গড়া। এই সংগঠন যখন ক্ষমতায় থাকে, বাংলাদেশের মানুষের তখনই ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাকুক, এটা বিএনপি সহ্য করতে পারে না বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আন্দোলনের নামে বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টির প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেছেন, বিএনপি আন্দোলনের নামে ৩ হাজার ৮০০টি বাস, ২৯টি ট্রেন, লঞ্চ, প্রায় ৭০টি সরকারি অফিস, ৬টি ভূমি অফিস পুড়িয়েছে। কেমন করে মানুষ জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে? এই বিএনপি-জামায়াত জীবন্ত মানুষগুলোকে পুড়িয়ে মেরেছে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, পুলিশকে পর্যন্ত মাটিতে ফেলে পিটিয়ে মেরেছে।
Advertisement
প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের সুযোগ খুব বেশি নেই, তবে বিএনপি ক্ষমতায় না থাকলেও এখন দেশে দুর্নীতি কমেছে বলে অনেকেই মনে করবেন না। বিএনপি যে আন্দোলনের দল নয়, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশের সুযোগ নেই। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে প্রতিষ্ঠিত দল হওয়ায় ক্ষমতায় থাকতেই তারা পছন্দ করে। ফলে ক্ষমতার বাইরে গেলে এই দলটির রাজনৈতিক আচরণে এক ধরনের দিশেহারা ভাব লক্ষ করা যায়।
নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদলের যে গণতান্ত্রিক রীতি সেটাও তারা মানতে চায় না। নির্বাচন এলেই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অজুহাত খুঁজতে থাকে দলটি। অথচ বিএনপিরও জনসমর্থন আছে। ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়ার রেকর্ডও আছে। তাহলে নির্বাচন বর্জনের ব্যাপারে বিএনপির আগ্রহ কেন বেশি সে প্রশ্ন যে কারও মনে উঠতেই পারে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানও একজন সামরিক স্বৈরশাসক। অথচ খালেদা জিয়া সেই বিএনপিকেই এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শামিল করে গণভিত্তি দিয়েছিলেন। এরশাদ পতনের পর বিএনপিকে ক্ষমতায়ও এনেছিলেন খালেদা জিয়া। বিএনপির জন্ম হয়েছিল জিয়ার ক্ষমতা পোক্ত করার ইচ্ছা থেকেই। সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে নয়, বিএনপি গঠিত হয়েছিল জিয়ার ক্ষমতা পাহারা দেওয়ার প্রয়োজনে। তবে খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্বে আসার পর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিএনপির বদনাম যেমন ঘুচেছিল, তেমনি খালেদা জিয়াও অনেকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু একানব্বইয়ের নির্বাচনে ক্ষমতা পেয়ে বিএনপি আগের অগণতান্ত্রিক চরিত্রেই ফিরে যায়।
মাগুরা ও ঢাকার দুটি আসনের উপ-নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য বিএনপির মরিয়া চেষ্টা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় কলঙ্ক লেপন করে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে দেশে আর সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না- জনমানসে এই ধারণা বদ্ধমূল হওয়ায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রসঙ্গটি সামনে আসে। সে সময় তিনি বলেছিলেন, শিশু ও পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হয় না। ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনে জয়ী হয়েও খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। অবশ্য প্রবল আন্দোলনের মুখে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন।
Advertisement
আবার পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিতর্কিত করার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা পালন করেছে বিএনপি এবং দলনেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া। বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানোর অপকৌশল গ্রহণ করা না হলে এই ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক ও ক্ষোভ তৈরি হতো না। বিএনপির বদমতলব বুঝতে পেরেই ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। যদিও বিচার বিভাগের শরণাপন্ন হয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসান হয়েছে কিন্তু এটাও ঠিক যে আওয়ামী লীগ না চাইলে এটা হতো না।
এখন বিএনপি আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য আন্দোলন করছে। এখন দলটির কারও হয়তো মনে নেই যে, তাদের নেত্রীই একসময় বলেছিলেন, শিশু ও পাগল ছাড়া কেউই নিরপেক্ষ নেই। আওয়ামী লীগ সরকার আর তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারে ফিরে যাবে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এই দাবিতে অনড় থেকে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নিলে ফলাফল কি হতো তা নিয়ে এখন বিতর্ক না করে বরং এটাই বলা যায় যে, আওয়ামী লীগকে যে একটি বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হতে হয়েছে এর জন্য দায়ী বিএনপি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল অংশ না নেওয়ায় ১৫৩টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। বাকি আসনগুলোতে ভোট হয়েছিল মোটামুটি একতরফা। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচনচিত্র এ রকম হতো না।
২০১৮ সালের নির্বাচনেও নানা রকম গড়িমসি, টালবাহানা শেষে বিএনপি সঙ্গীসাথীদের নিয়ে শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করলেও জয়লাভ তাদের মূল লক্ষ ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচন বিতর্কিত করা। প্রার্থী মনোনয়ন থেকে নির্বাচনী প্রচারণা পর্যন্ত গা-ছাড়া ভাবেই বিএনপি নির্বাচনের মাঠে ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনটিও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।
আওয়ামী লীগের বিজয় সহজ হয়েছে। দেশের মানুষ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছে। এসব নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও অন্যরা বাদ-প্রতিবাদ করলেও নিজেদের পক্ষে প্রবল জনমত সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলনের কথা বলেও মানুষের মধ্যে ব্যাপক কোনো আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি। কেন মানুষ এই ধরনের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছে তার কারণ অনুসন্ধানের কোনো চেষ্টা কী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো করেছে? বিএনপি সরকারের পতন চায় কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিতে চায় না। তাহলে কীভাবে সরকারের পতন হবে?
বিএনপি মনে করে ব্যাপক গণআন্দোলনের মাধ্যমেই তারা সরকারের পতন ঘটাবে। কিন্তু এটাও যে অসম্ভব ব্যাপার সেটা দলের নীতি-নির্ধারকরা বুঝতে পারছেন না অথবা বুঝতে চাইছেন না। বিএনপি একটি সুসংগঠিত দল নয়, এটা একটি নানা ধরনের বিশ্বাসের মানুষের সমবেত প্ল্যাটফরম। বিএনপি যারা করেন তারা অধিকাংশই হয় সুবিধাবাদী অথবা দোদুল্যমান রাজনৈতিক চরিত্রের ব্যক্তি। এই দলে এমন কেউ নেই, যার অতীত রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। দলছুট বিভিন্ন শ্রেণিপেশার সুযোগ সন্ধানী মানুষের সমন্বয়ে গঠিত দলের পক্ষে গণআন্দোলন গড়ে তোলা সহজ নয়।
এটা ঠিক সংসদে না থাকলেও বিএনপির জনসমর্থন কম নয়। আওয়ামী লীগের প্রধান পতিপক্ষও বিএনপি। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকেই হিসাবে ধরে আওয়ামী লীগ। মুখে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেও তাদের উপেক্ষা করতে পারেন না। বিএনপি নেতাদের কথার জবাব সে কারণেই আওয়ামী লীগ নেতারা জোরেসোরেই দিয়ে থাকেন। কিন্তু রাজনৈতিক কৌশলে আওয়ামী লীগের কাছে বার বার হেরে যাচ্ছে বিএনপি।
আমাদের রাজনীতির কতগুলো দুর্বলতা আছে। এই দুর্বলতাগুলো একদিনে তৈরি হয়নি এবং মজার ব্যাপার হলো, রাজনৈতিক দলগুলো কখনো নিজেদের ভুল স্বীকার করে না, কোনো ঘটনা নিয়ে দলগতভাবে কখনো মূল্যায়নে যায় বলে শোনা যায় না। আমাদের এখানে আওয়ামী লীগের দুর্বলতা হলো বিএনপির শক্তি আবার বিএনপির দুর্বলতাকেই আওয়ামী লীগ শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়া যে ভুল ছিল এই মূল্যায়ন কী দলটি করেছে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটা মনে করেন যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে জোরদার করতে হলে বা এগিয়ে নিতে হলে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কোনো সময়ই বিশেষ কোনো দলের সুবিধাজনক শর্তে অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সাংবিধানিক রীতি অনুযায়ীই নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে দেখার বিষয় হলো, নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণের সমান সুযোগ থাকে কি না, মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে প্রভাবমুক্ত হয়ে ভোট দিতে পারেন কি না এবং নির্বাচনী সব কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ উপায়ে সম্পন্ন হয় কি না।
১৯৭০ সালের নির্বাচন ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের বিধিনিষেধের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। মানুষের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস থাকলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে দোদুল্যমানতা থাকার কথা নয়। দেশে নির্বাচন এলেই বিএনপি কেন অংশ না নেওয়ার অজুহাত খুঁজতে থাকে সেটা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। সব ব্যবস্থা বিএনপির অনুকূলে হলে, সেটা আওয়ামী লীগ কেন মেনে নেবে?
তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে অনঢ় না থেকে বিএনপির উচিত আগামী নির্বাচন চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করা। সরকারের পায়ের নিচে যদি মাটি না থাকে এবং এটা যদি বিএনপি বিশ্বাস করে তাহলে তাদের উচিত হবে বড় বড় কথা না বলে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, কোনো রাজনৈতিক দলের বা কোনো নেতা-নেত্রীর নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান তৈরির কোনো নজির নেই। কিন্তু মানুষের নীরব ভোট বিপ্লবের সরকার পরিবর্তন হওয়ার নজির অবশ্যই আছে। নীরব পথযাত্রার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ধারাকে বিএনপি সম্প্রসারিত করুক মানুষের নীরব ভোটবিপ্লবের দিকে। পালানোর পথ পাবে না- এমন নিষ্ফল হুঙ্কার বিএনপির অক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ। ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম