মতামত

বিয়ের বাদ্য বাজে

না, শুধু মালকা বানুর দেশে নয়, পুরো বাংলাদেশেই এখন ঘরে ঘরে বিয়ের বাদ্য শোনা যাচ্ছে। শীত সোহাগী বাঙালির জন্য এটাই হলো বিয়ের মৌসুম। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই চেনা জানা কোন না কোন পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র পাচ্ছি। ই-কার্ডের প্রচলন যতই থাকুক, বিয়ের জন্য নিমন্ত্রণের কার্ড ছাপানোর রীতি এখনও বহাল আছে।

Advertisement

বলছিলাম, বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা। বিয়ে শাদিতে একটু আমোদ আহ্লাদ, খরচপত্র হবে এটা খুবই ভালো কথা। কিন্তু আজকাল বিয়ের খরচের বাহুল্য যেমন দেখা দিয়েছে তা একেবারেই লাগাম ছাড়া। ব্রাইডাল মেকআপ বা কনের সাজ এখন হাজার দশেক টাকার নিচে নেই। পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েও ব্রাইডাল মেকআপ নিচ্ছেন অনেকে। ভাবা যায়? একদিনের একবেলার সাজের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা। অনেক মানুষের ছয়মাসের রোজগার।

আরও আছে পার্টিসেন্টারের ভাড়া। খাওয়ানোর খরচ। বরকনের পোশাক। এখনও বিয়েতে সোনার গয়না দেয়ার বর্বর রীতি চালু আছে। সোনার দাম তো চড়তে চড়তে আসমানে গিয়ে উঠেছে। আরও আছে বেশ কিছু ছদ্মবেশী যৌতুক। যেমন, ফার্নিচার দিয়ে বাড়ি সাজিয়ে দেয়া। সে আবার যেনতেন ফার্নিচার হলে হবে না। নামী দোকানের দামী সামগ্রী হওয়া চাই। সেই সঙ্গে ফ্রিজ টেলিভিশনও চাই। অনেক পরিবার এখন জামাইকে গাড়িও গিফট করে।

এসব উপহার যখন এক পরিবার দেয়, তখন অন্য দশটা পরিবারের উপরও কিন্তু এর পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। যখন একজন তার নতুন বউয়ের পরিবার থেকে প্রচুর ‘যৌতুক’ পায় তখন সেই পরিবারেরই অন্য ছেলে অথবা তার বন্ধুও কিন্তু মনে মনে অতটা পাওয়ার আশা করে। কিন্তু সে যদি এমন পরিবারে বিয়ে করে যাদের অতটা দেবার সামর্থ্য নেই তখন সে আশাভঙ্গের দুঃখ পায়। যেটার ঢেউ লাগে দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই।

Advertisement

এখানে হয়তো ছেলেপক্ষ কিছু চায়নি। তাই সেটাকে আইনত যৌতুক বলা চলবে না। কিন্তু এই যে দেয়া-নেয়া এটার ফলে ছদ্মবেশী যৌতুক প্রথা সমাজে রাজত্ব করে।

এজন্য বিয়ের সময় এ ধরনের উপহার প্রদানের প্রথাটিই বন্ধ করা দরকার। কেউ যদি তার ছেলে বা মেয়েকে কিছু দিতে চায় তাহলে সেটা বিয়ের অনেক পরেও দেয়া যেতে পারে।

সামগ্রিকভাবে বিয়ের যে খরচ সেটার চাপটা বেশিরভাগই পোহাতে হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে। অনেকক্ষেত্রেই এই খরচ বহনের জন্য ঋণও করতে হয়।

আমাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাগুলোতে পরিবর্তন আনা দরকার। বিয়েতে শয়ে শয়ে মানুষকে দাওয়াত খাওয়ানোর যে একটা নবাবী স্টাইল রয়েছে সেটা বদলানো জরুরি। একেবারে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বন্ধুদের নিয়ে পঞ্চাশ জনের একটা অনুষ্ঠানই যথেষ্ট। ব্রাইডাল মেকআপের যে প্রবল প্রতাপ সেটারও বদল দরকার।

Advertisement

পার্লার থেকে অদ্ভুত সাজ দেয়ার যে প্রথা গড়ে উঠেছে তা অত্যন্ত হাস্যকর। বিয়ের আসরে অধিকাংশ কনেকেই একরকম এবং একটা কৃত্রিম মুখোশের মতো চেহারায় হাজির হতে দেখা যায়। যে উৎকট সাজ দেয়া হয় তাতে কনের প্রকৃত চেহারাটা বোঝাই যায় না। বরং আগে যে ঘরে সাজার প্রথা ছিল সেটা ফিরিয়ে আনা দরকার।

আরেকটি বিষয় আজকাল খুব দেখা যাচ্ছে। সেটা হলো বলিউডি ছবির অনুকরণে ‘মেহেন্দি নাইট’, ‘ব্যাচেলর’স নাইট’ ইত্যাদি প্রথা। এগুলো অপসংস্কৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশের পুরনো লোকজ প্রথাগুলো বরং অনেক স্নিগ্ধ এবং অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। দেশীয় প্রথাগুলোর চর্চা হতে পারে বিয়েতে। উৎকট হিন্দিগানের পরিবর্তে আমাদের দেশীয় গানগুলো বাজানো যেতে পারে। গায়ে হলুদের প্রথাটি তার পুরনো রীতিসহ ফিরতে পারে বিজাতীয় ‘মেহেন্দি নাইটে’র বদলে।

আরও দরকার বিয়ের বেনারসী শাড়িকে ফিরিয়ে আনা। একথাটা বললাম কারণ আজকাল অনেক কনের গায়ে দেখতে পাচ্ছি লেহেঙ্গা। আচ্ছা, লেহেঙ্গা কি আমাদের দেশের পোশাক? বাঙালি মেয়েকে কি লেহেঙ্গায় শাড়ির মতো সুন্দর দেখায়? অন্য সময় যতই অন্য দেশের পোশাক পরা হোক না কেন, অন্তত বিয়ের উৎসবে যদি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পোশাক বেছে নেয়া হয় সেটা কি অনেক ভালো নয়?

বিয়েতে আরেকটা বিষয় খুব কমন। সেটা হলো কোনো না কোনো আত্মীয়র দ্বারা একটা না একটা ঝামেলা পাকানো। বিয়েতে ছেলের খালুর পাতে কেন মুরগির ঠ্যাং ছোট আকারের ছিল সেটা নিয়ে বিয়ের অনেক বছর পরেও খোটা শুনতে হয় অনেক মেয়েকে। এই ঝামেলা সাধারণত একটু দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা বা ‘দুরাত্মা’ আত্মীয়রা বেশি পাকায়। তাই বর ও কনে পক্ষের ঘনিষ্ঠ লোকদের (যেমন, বর ও কনের বাবা মা) উচিত এ বিষয়ে সতর্ক থাকা।

যে পরিবারে আপনি বিয়ে করতে যাচ্ছেন অথবা যে পরিবারে আপনার ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন তাদের সম্মান এখন আপনারই সম্মান। যাকে বউ করে বা জামাতা করে আপনজনের আসনে বসাচ্ছেন তার সম্মান ও সুখও আপনারই। বিয়ের কয়েক দিনের আনুষ্ঠানিকতায় কোনোভাবে যেন নব দম্পতির নতুন জীবনে কোন নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিকে সতর্ক থাকা দরকার।

আর বিয়ের আগে অবশ্যই বর ও কনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো দরকার। এটাকে এখনও, মানে এই একুশ শতকেও অনেকে অপমানকর বলে মনে করেন। অথচ বিয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা থাকলে পরবর্তীকালের অনেক জটিল সমস্যার হাত থেকে বাঁচা যায়।

অত্যাধুনিক কতিপয় চিত্রতারকা ছাড়া সকালে বিয়ে বিকেলে ডিভোর্স বিশ্বের কোন সমাজেই কাম্য নয়। তাই বিয়ের আগেই সবদিক ভালোভাবে বিবেচনা এবং দুইপক্ষ বিষয়ে বিশদ খোঁজখবর করে নেয়া ভালো। এমনকি সেটা প্রেমের বিয়ে হলেও।

আর ভালো পাত্র বা পাত্রী পাওয়া গেছে তাই আহ্লাদে আটখানা হয়ে কোনরকম খোঁজ না নিয়ে তড়িঘড়ি করে বিয়ে দেয়া অনেক ক্ষেত্রেই জীবনব্যাপী বিষাদ বয়ে আনে। তাই বিয়ের আগে ভাবুন ভালোভাবে। বিয়ের বাদ্য বাজা একটা সুখের বিষয়, সেই সুখটা যেন আমৃত্যু স্থায়ী হয় সেজন্যই দরকার সুবিবেচনা।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস