দেশজুড়ে

ভেস্তে গেছে হাতি তাড়ানোর বৈদ্যুতিক বেড়া

শেরপুরে বন্যহাতি ঠেকাতে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের প্রথম সোলার ফেন্সিং (বৈদ্যুতিক বেড়া) প্রকল্প ভেস্তে গেছে । বাস্তবায়নের মাত্র চার মাসেই প্রকল্পের ব্যাটারি অকেজো এবং দীর্ঘদিন পরিচর্যা ও দেখভাল না থাকায় চুরি হয়ে গেছে বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি।

Advertisement

বৈদ্যুতিক বেড়া নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হচ্ছে, ব্যাটারি নয় বরং বিভিন্ন সময় বেড়ার তারে গুল্মলতা আঁকড়ে ধরছে, সৃষ্টি হচ্ছে শর্টসার্কিট। এসব কারণেই কাজ করছে না বৈদ্যুতিক বেড়া।

তাদের অভিযোগ, সীমান্তে স্থানীয়দের অসহযোগিতা আর আগ্রহ না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের অল্প দিনেই অকেজো হয়েছে বৈদ্যুতিক বেড়া।

তবে বন বিভাগের দাবি, প্রকল্প বাস্তবায়নের পর রক্ষণাবেক্ষণে লোক নিয়োগ না দেওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

Advertisement

আরো পড়ুন- নানা সংকটে শেরপুরের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো, সেবাবঞ্চিত দরিদ্ররা

হাতির উপদ্রব থেকে বাঁচতে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার আদলে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় শেরপুরের ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী সীমান্তের ১৩ কিলোমিটারজুড়ে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে তার দিয়ে বেড়া নির্মাণ করে বন বিভাগ। ৯১ লাখ টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে ঢাকার নিউ ন্যাশন সোলার লিমিটেড নামের এক প্রতিষ্ঠান।

বুয়েটের প্রতিনিধি দল বৈদ্যুতিক বেড়া পরিদর্শন ও প্রতিবেদন দাখিলের পর ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ফরেস্টার মামুন অর রশীদ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সম্পূর্ণ কাজ বুঝে নেন। এর মাত্র চার মাস পরই ত্রুটি দেখা দেয় বৈদ্যুতিক বেড়ায়।

বন বিভাগের তথ্য পেয়ে নিউ ন্যাশন সোলার লিমিটেডের একটি প্রতিনিধি দল পরে পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে স্থানীয়দের অসহযোগিতা, দক্ষ ইলেকট্রেশিয়ান না থাকা, নিয়মিত পরিচর্যার অভাব ও গুল্মজাতীয় গাছের কারণে বৈদ্যুতিক বেড়ার ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়।

Advertisement

স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় ৩০ বছর সীমান্তবাসী মশাল জ্বালিয়ে ও ঢাকঢোল পিটিয়ে হাতি তাড়াতেন। বিদ্যুতের বেড়া নির্মাণের ফলে প্রথম দিকে এর সুবিধা অনেকে ভোগ করেছেন। কিন্তু বছর না যেতেই বৈদ্যুতিক বেড়া অকেজো হয়ে পড়ে। পাঁচ বছর ধরে এই বেড়া এমনই পড়ে আছে। কোনো কাজেই আসে না। সরকারের কোটি টাকা অযথা নষ্ট হচ্ছে। দ্রুত এই বেড়া আবার ঠিক করা হোক।

আরো পড়ুন- শেরপুরে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব মিটবে কিসে?

স্থানীয় বিমল কোচ বলেন, সরকার এত টাকার একটা প্রজেক্ট করে দিয়েছে, কিন্তু কোনো দক্ষ লোক রাখেনি। এ জন্য বৈদ্যুতিক বেড়া কোনো কাজে আসছে না। ফলে সীমান্তে বসবাসরত লক্ষাধিক মানুষ আবারও হাতির আক্রমণে জীবন ও ফসল হারানোর শঙ্কায় দিন পার করছে।

রঞ্জিত সাংমা বলেন, বৈদ্যুতিক বেড়ায় ব্যবহৃত ব্যাটারি মেরামত এবং এর রক্ষণাবেক্ষণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না করলে এটি কোনো কাজে আসবে না। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না করলে সীমান্তের মানুষ বন্যহাতির কবলে পড়ে ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হবে।

ওই সময় দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বৈদ্যুতিক বেড়া নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণেই দ্রুত ভেস্তে গেছে প্রকল্পটি। তাদের সময়মতো সব বিল পরিশোধের পরও এ বিষয়ে তারা কোনো খোঁজ নেয়নি। তাদের কয়েক দফায় চিঠি দিয়েও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকার নিউ ন্যাশন সোলার লিমিটেডের পরিচালক শাহ আহসান হাবিব বাবু বলেন, বৈদ্যুতিক বেড়া এবং এর যন্ত্রাংশ সঠিকভাবে পরিচালনা না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষ লোক নিয়োগ না দেওয়ায় দীর্ঘদিন অকার্যকর ছিল সোলার। পরে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

আরো পড়ুন- শেরপুরে দখল হচ্ছে বনভূমি, উজাড় হচ্ছে গারো পাহাড়

তিনি আরও বলেন, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বুয়েট টেস্টের রিপোর্ট, তৎকালীন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা গোবিন্দ চন্দ্র রায় স্বাক্ষরিত সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ কাজ বুঝে পাওয়ায় সন্তোস প্রকাশের চিঠির কপি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বন বিভাগকে চিঠি দিয়ে বৈদ্যুতিক বেড়া রক্ষণাবেক্ষণে স্থায়ীভাবে ইলেকট্রিশিয়ান নিয়োগের মতামতও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বন বিভাগ জনবল নিয়োগ না দেওয়ায় প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পেড়েছে।

শেরপুর বন বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নের পর তা রক্ষণাবেক্ষণে লোক নিয়োগ না দেওয়ায় প্রকল্পের এমন দুরবস্থা হয়েছে। তবে দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন ঢাকা বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মোল্ল্যা রেজাউল করিম।

বন বিভাগের তথ্য মতে, শেরপুর সীমান্তের তিন উপজেলার প্রায় ৪০ কিলোমিটার হাতির বিচরণক্ষেত্র। হাতির আক্রমণে জেলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে পাল্টা আক্রমণে মারা পড়েছে ২৮ হাতি।

এফএ/এএইচ/এমএস