বিমা মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আবার যানবাহনের বিমা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর সংশোধন করে কীভাবে মোটরযানের বিমা বাধ্যতামূলক করা যায় সে বিষয়ে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আইডিআরএ থেকে প্রস্তাবনা পাওয়ার পর সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে সুপারিশ পাঠানো হবে।
Advertisement
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ধারা ১০৯ অনুযায়ী তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা বাধ্যতামূলক ছিল এবং এর অধীনে ১৫৫ ধারায় দণ্ডের বিধানও ছিল। তবে নতুন সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-তে তৃতীয়পক্ষের বিমা তুলে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে যানবাহনের বিমা ছেড়ে দেওয়া হয় মালিকের ইচ্ছার ওপর। অর্থাৎ, একজন ইচ্ছা করলে তার যানবাহনের বিমা করতে পারেন, আবার না করলেও কোনো সমস্যা নেই।
আরও পড়ুন>> সাধারণ বিমায় অর্ধেকের বেশি দাবি বকেয়া
এ বিষয়ে ২০২০ সালের অক্টোবরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এর পর ওই বছরের ডিসেম্বরে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেয় বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এর পর থেকেই মূলত মালিকরা পরিবহনের বিমা করা প্রায় বন্ধ করে দেন। বর্তমানে যেসব পরিবহন চলাচল করছে তার সিংহভাগেরই কোনো বিমা নেই। বিশেষ করে বিমা ছাড়াই চলাচল করছে মোটরসাইকেল।
Advertisement
তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেওয়ার পর যানবাহনের বিমা বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান বিমা ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তবে কম্প্রিহেনসিভ ইন্স্যুরেন্সে বাধ্যতামূলক করার সুযোগ না থাকায় বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন বিমা সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে বিমা মালিকদের অংশগ্রহণে একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। সেখানে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমার আদলে নতুন একটি বিমা প্রোডাক্ট চালুর বিষয়ে আলোচনা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মোটরযান বিমা বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে যে সুপারিশ এসেছে, সেখানে এর পক্ষে কিছু যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা।
আরও পড়ুন>> সড়কে অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা: ক্ষতিপূরণের জন্য তহবিল গঠনের দাবি
আবার যাত্রী কল্যাণ সমিতির একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি দুর্ঘনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন মৃত্যুবরণ করেন এবং ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হন। এক্ষেত্রে মোটর বিমা বাধ্যতামূলক থাকলে ক্ষতিপূরণের একটি ব্যবস্থা সমাজে চালু থাকতো।
Advertisement
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, বহির্বিশ্বে মোটরযানের বিমা বাধ্যতামূলক। কিন্তু নতুন সড়ক পরিবহন আইনে তৃতীয়পক্ষের বিমা তুলে দেওয়া হয়। এতে মোটরযানের বিমা মালিকের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এটা একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এ কারণে মোটরযান বিমা ফের বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সড়ক পরিবহন আইনে কম্প্রিহেনসিভ ইন্স্যুরেন্সে অথবা অ্যাক্ট লাইবেলিটি ইন্স্যুরেন্সের (তৃতীয়পক্ষের বিমা) বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে আইডিআরএর কাছে প্রস্তাবনা চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে আইডিআরএ চেয়ারম্যানকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এ মোটরযানের ক্ষেত্রে কম্প্রিহেনসিভ ইন্স্যুরেন্সে অথবা অ্যাক্ট লাইবেলিটি ইন্স্যুরেন্স (থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স) বিমার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। আইনে বর্ণিত বিধানটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগকে অনুরোধ করা হবে। এ লক্ষ্যে মোটরযানের বিমা বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যথাযথ যৌক্তিকতাসহ সুস্পষ্ট প্রস্তাব প্রয়োজন।
আরও পড়ুন>> বিমা কোম্পানিগুলোর শতকোটি টাকার ব্যবসা হাতছাড়া
যোগাযোগ করা হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপ-সচিব মো. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী এখন মোটরযান বিমা বাধ্যতামূলক নেই। মোটরযান বিমা বাধ্যতামূলক করতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে। কীভাবে এটি করা যায়, সে বিষয়ে আইডিআরএর কাছে প্রস্তাবনা চাওয়া হয়েছে। আইডিআরএ থেকে প্রস্তাবনা পেলে আমরা সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগকে অনুরোধ জানাবো।
আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী জাগো নিউজকে বলেন, আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছি। এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। একটা আইন হয়েছে, যে আইনে তৃতীয়পক্ষের বিমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এটা এখন চাইলেই হুট করে আবার চালু করা যাবে না। আমরা একটা বিকল্প প্রোডাক্ট (বিমা পণ্য) ডেভেলপ করতে চাচ্ছি।
নতুন প্রোডাক্টের নাম কি থার্ড পার্টি বাদ দিয়ে অন্য কিছু দেওয়া হবে? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সেটা আমরা এখনই বলতে পারছি না। আমাদের যারা বিশেষজ্ঞ তাদের দিয়ে আমরা একটা প্রোডাক্ট ডেভেলপ করাচ্ছি, যাতে এটা গ্রহণযোগ্য হয়। এটা (তৃতীয়পক্ষের বিমা) বাতিল করা হয়েছে, যে গ্রাউন্ডে যেমন ক্ষতিপূরণ কম পাওয়া যায়, সেটা অ্যাড্রেস করেই তৈরি করতে হবে। বিমা খাতের যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, তাদের নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা চাই মোটরযান বিমা বাধ্যতামূলক হবে। তবে শুধু আইন দিয়ে নয়, এটা যাতে মানুষের উপকারে লাগে সে দিকটাও দেখতে হবে। তাহলে মানুষ নিজেরাই এটা গ্রহণ করবে।
এদিকে বিমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথিবীর কোথাও বিমা ছাড়া পরিবহন চলাচল করে না। সব দেশেই তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। কিন্তু হুট করেই আমাদের দেশে সড়ক পরিবহন আইন পরিবর্তন করে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যে নাম দিয়েই হোক পরিবহনের ক্ষেত্রে তৃতীয়পক্ষের বিমা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে এই বিমার প্রিমিয়াম এবং ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে।
আরও পড়ুন>> মোটরসাইকেলে লাগবে না বিমা, ধাক্কা খাওয়ার শঙ্কায় কোম্পানিগুলো
এ বিষয়ে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান জাগো নিউজকে বলেন, সারা বিশ্বেই তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমার প্রচলন রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে হুট করেই তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এটা একটি ভুল সিদ্ধান্ত। বিমা থাকলে ক্ষতিপূরণের একটা ব্যবস্থা হয়। বিমা তুলে দেওয়ার কারণে ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে যেমন সমস্যা হয়েছে, অন্যদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
তিনি বলেন, পরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে বিমা বাধ্যতামূলক করা উচিত। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে প্রিমিয়াম বাড়াতে হবে। আগে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমার ক্ষেত্রে যে প্রিমিয়াম ছিল, সেটা বাড়িয়ে তিন গুণ করা যেতে পরে। পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের পরিমাণও বাড়াতে হবে। আগে মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হতো, এখন সেটা বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে আগে যানবাহনের ক্ষতির জন্য ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ছিল, সেটাও বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন>> সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজটে বছরে ক্ষতি ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি
একই ধরনের সুপারিশ করেন বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির (বিজিআইসি) সিইও আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা গ্রহণ করলে তৃতীয়পক্ষের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমার ক্ষেত্রে যে নিয়ম প্রচলন ছিল তাতে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য ২০ হাজার টাকা এবং যানবাহনের ক্ষতির জন্য ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যেত। আমরা মনে করি এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়িয়ে হলেও আবার তৃতীয়পক্ষের বিমা চালু করা উচিত। এক্ষেত্রে মৃত্যু ও যানবাহনের ক্ষতিপূরণ বাবদ এক লাখ টাকা করে নিয়ম চালু করা যেতে পারে।
‘বিশ্বের কোথাও বিমা ছাড়া পরিবহন চলাচল করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে হুট করেই তৃতীয়পক্ষের বিমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এটা অবশ্যই একটা ভুল সিদ্ধান্ত। এখন যদি আবার পরিবহনের বিমা বাধ্যতামূলক করা হয়, সেটা হবে খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। এতে একদিকে ক্ষতিপূরণের একটা ব্যবস্থা হবে, অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।’
বিমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআই) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, পরিবহনের বিমা তুলে দেওয়া ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। পরিবহনের বিমা বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে আমরা আগেই দাবি জানিয়েছি। এ বিষয়ে একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার জানা নেই। তবে বিশ্বের কোথাও বিমা ছাড়া পরিবহন চলাচল করে না। আমাদের দেশের পরিবহন মালিক, শ্রমিকরা খুবই শক্তিশালী। তাদের ইন্ধনেই তৃতীয়পক্ষের বিমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন আবার পরিবহনের বিমা বাধ্যতামূলক করতে গেলে তাদের পক্ষ থেকে বাধা আসতে পারে।
তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা কী
তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা হলো এমন এক ধরনের বিমা যার মাধ্যমে তৃতীয়পক্ষ ক্ষতিপূরণ পায়। তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমার আওতায় থাকা একটি গাড়ি যদি দুর্ঘটনায় পড়ে, তাহলে ওই গাড়ির চালক বিমা দাবির টাকা পাবেন না। তবে ওই গাড়ির যাত্রী অথবা পথচারী ওই গাড়ির দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যুবরণ করলে ক্ষতিপূরণ পাবেন। আহত হলে কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। আবার তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমার আওতায় থাকা একটি গড়ি যদি অন্য গাড়ি বা সম্পত্তির ক্ষতি করে তাহলে যে গাড়ি বা সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে তৃতীয়পক্ষের যে ঝুঁকি বিমা চালু ছিল তার আওতায় মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ ছিল ২০ হাজার টাকা। আর গাড়ি বা সম্পত্তির সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ ছিল ৫০ হাজার টাকা।
এমএএস/এএসএ/এমএস