সাহিত্য

তানজীনা ইয়াসমিনের ভিন্নধর্মী উপন্যাস সিবতু

অমর একুশে বইমেলায় এসেছে তানজীনা ইয়াসমিনের ভিন্নধর্মী উপন্যাস `সিবতু`। জাপান প্রবাসী এই লেখিকার এটি দ্বিতীয় উপন্যাস।  ‘সিবতু’- উৎস ফার্সী শব্দ ‘সিবতে’, যার অর্থ নাতী। ‘সিবতে’র ই এক আদুরে ডাক ‘ সিবতু’। লেখিকার ভাষায় –“গল্প গড়ে উঠেছে ৪০০০ কিলোমিটার ব্যবধানের দুই ভূখণ্ডের দুই কঠিন, দুর্ভেদ্য নিয়মের বেড়াজালে বেড়ে ওঠা দুজন  ‘সিবতু’কে নিয়ে। প্রকৃতির বিচিত্র এক রহস্যে অদেখা সেই দুজনের ভেতরে গড়ে উঠলো অদৃশ্য এক কাঁচা সুতার বাঁধন। তাই বহুবছর আগের কানে লেগে থাকা আদুরে নামটাই সবচেয়ে লাগসই মনে হোল এমন কাহিনীর নামকরণে।" এই দুই সিবতু কেউ কাউকে কোনোদিন দেখেনি, গল্পের শেষ অবধি। কিন্তু তাঁদের মাঝের সেতুবন্ধন ছিল এক জটিল তদন্ত। জটিলতার চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে যেতে যার মাঝে একজন হারিয়ে যায়, একজন  টিকে থাকে- সেই ডারউইন তত্ত্বের ‘যোগ্যতরের টিকে থাকা’র মতো। প্রাসঙ্গিক পটভূমি পাঠক মনের পর্দায় নিটোলভাবে ফুটিয়ে তুলবার তাড়নায় কাহিনীর বুননে তুলে ধরা হয়েছে হাজার বছরের এক সভ্যতার ইতিহাস; জাপানের যোদ্ধা শ্রেণি ‘সামুরাই’, যার ইংরেজী অর্থ “The server” । দেশের সর্বোচ্চ শ্রেণির মর্যাদায় আসীন, দেশরক্ষায় নিয়োজিত ছিল তাঁদের আমৃত্যু সেবা । যুদ্ধক্ষেত্রে শেষ রক্তবিন্দু অবধি লড়তে লড়তে বীরের মৃত্যুবরণ পরম আরাধ্য ছিল জীবনাবসান। কারণ, ব্যর্থতায় আলিঙ্গন করতে হবে দুঃসহ যন্ত্রণাময় “হারাকিরি”র আত্মহনন!সমস্যার উদয় হলো ১৮৬৮ সালে। ১৪ বছর বয়সে সম্রাট মেইজীর অভিষেক হলে তিনি পাশ্চাত্য রীতিতে আধুনিক জাপান তৈরির লক্ষ্যে যখন শ্রেণি বিভাজন তুলে দিয়ে সামুরাই শ্রেণি অবলুপ্ত ঘোষণা করে তাঁদের অস্ত্র সমর্পণের আদেশ দিলেন। শুরু হলো রক্তগঙ্গার আরেক ইতিহাস। শৌর্যবীর্য হারিয়ে যোদ্ধা সামুরাইগণ সম্রাটের আদেশে শ্রেণিভেদে প্রশাসনিক পদে আসীন হলেন।  শুধু মেনে নিতে পারলোনা একজন। উচ্চ পর্যায়ের সামুরাই তাচিবানা সাগোই। তাঁর জীবনমন্ত্র, বিলুপ্ত প্রাচীন জীবনশৈলী আকড়ে বেঁচে রইলেন আধুনিক জাপানে “একমাত্র জীবন্ত সামুরাই”- সামুরাই তাচিবানার নাতী, কাহিনীর প্রথম ‘সিবতু”। রহস্যময়, দুর্ভেদ্য এক চলমান অশরীরী।গল্পের আরেক পটভূমি বাংলাদেশ। দেশের পার্বত্য এলাকায় সংগঠিত এক আদিবাসী বিদ্রোহী দলের নাম উন্মোচিত হোল, যাদের লড়াইয়ের মাধ্যম মার্শাল আর্ট, আগ্নেয়াস্ত্র নয়। আক্রমণের কৌশল ‘নিনজা’। কাহিনীর দাবীতে বাংলাদেশে আদিবাসী সমস্যার মূল কারণ এবং গুরু রহস্যও উঠে এসেছে পাতায় পাতায়। ধৃত সদ্য কৈশোর পেরুনো আদিবাসী ছেলেটির জবানবন্দীর ভিত্তিতে তদন্ত অনুসন্ধানে সীমান্তবর্তী দেশ ঘুরতে ঘুরতে উঠে আসলো নিনজা শ্রেণির জন্মস্থল জাপানের নাম। স্বভাবতই সন্দেহের তীর নিশানাবদ্ধ হোল জাপানের একমাত্র জীবিত সামুরাইয়ের দিকেই । এছাড়া এমন “নিনজা” প্রশিক্ষণ কে দিতে পারে? গল্পের আরেক সিবতু, ইবতেশাম সিবতে হামদ, পীর বংশের কঠিন এবং বিশেষ নিয়মতান্ত্রিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ সেও।  বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা থেকে জাপানে প্রেরিত দুই কর্মকর্তার ভেতরে পুরুষ কর্মকর্তা সিবতু। সহকর্মী এবং বিধর্মী গোপন বাগদত্তার সাথে এই বিশেষ তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে যাবার পথেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। একের পর এক জটিলতার চোরাবালিতে ডুবে যেতে লাগলো মিশনে নিযুক্ত সহকর্মী- বাগদত্তা মেয়েটি। প্রতি মুহূর্তের প্রতিটি ঘটনা যেন তাঁর চলার পথের প্রতিটি বাঁকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মোড় এবং অজানা দিক উন্মোচন করতে লাগলো। যেমনি মিলিয়ে গিয়েছিল তেমনি সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে ফিরে এলো ইবতেশাম সিবতে হামদ- কিন্তু অন্তহীন নিস্তব্ধ এক ভিন্ন মানুষ হয়ে!  একা একা আজন্ম লড়াই করতে করতে ক্লান্ত মেয়েটি নিশ্ছিদ্র এই জটিলতায় কোন পথটি সঠিক- কোনটি ভুল, কে সত্য- কে অলীক যুঝতে যুঝতে বিধ্বস্ত হয়ে নিজেও যেন হয়ে উঠলো আরেক সামুরাই, যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যবরণ ছাড়া যার কোন পথ খোলা নেই।পরিসমাপ্তি ? ফিনিক্স পাখির গল্পের মতোই- ছাই থেকে যে পাখির জন্ম হয়! তাকে যতবার পুড়িয়ে ফেলা হবে ততবার সে নতুন করে জন্ম নিবে। পোড়া ছাইয়ের ভষ্ম থেকে জেগে উঠবে বারবার, আবার উঠে দাঁড়াবে। ছাইপোড়া তেমনি আগুন থেকেই ফিনিক্স পাখির মতো আবার জেগে উঠে ক্লান্ত মেয়েটি! একটাই জীবন, আর বেঁচে থাকার জন্য প্রধানতম প্রয়োজন জীবনের প্রতি ভালোবাসা। মেয়েটিও হারাতে পারেনি জীবনের প্রতি ভালোবাসা। আজন্ম ক্ষত- বিক্ষত, ফিনিক্স পাখির মতোই সে পুড়ে ছাই হয়ে সে বার বার জেগে উঠেছে। তাই জীবনও যেন একসময় তাঁকে পোড়াতে পোড়াতে ক্লান্ত হয়ে জীবনের সব বসন্ত চেরী ফুলের পূর্ণ প্রস্ফুটন – A perfect Cherry blossom এ আচ্ছাদিত করে তাঁকে ফিরিয়ে দিল, যেই পূর্ণ বসন্ত কারও জীবনে একবার দেখা মিললেও ধন্য জীবন। ইতিহাস আশ্রিত গোয়েন্দা থ্রিলার `সিবতু’ বেরিয়েছে আদর্শ প্রকাশন থেকে। বইমেলায় স্টল নম্বর ৫৭৫-৫৭৬-এর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রান্তে পাওয়া যাচ্ছে। এইচআর/পিআর

Advertisement