দেশজুড়ে

মোগল আমলের ‘দেওয়ানের পুল’ ভাঙতে এবার গণশুনানি

সচেতন মহলের প্রতিবাদের মুখে সিলেটের গোলাপগঞ্জে মোগল আমলে নির্মিত ‘দেওয়ানের পুল’ নামে ঐতিহাসিক সেতু ভাঙার কাজ বন্ধ করার পর এবার এটি ভাঙা হবে কী না, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে।

Advertisement

রোববার (২২ জানুয়ারি) বেলা ১১টায় সেতুসংলগ্ন রাস্তায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এই শুনানির আয়োজন করেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত ছাড়াই এলজিইডির গণশুনানি আয়োজনের সমালোচনা করছেন সচেতন মহল এবং পরিবেশকর্মীরা।

সেতু পুনর্নির্মাণ ও প্রশস্তকরণ করতে গিয়ে প্রায় ২০০ বছর আগে নির্মিত পুরোনো এই সেতুটি ভাঙা হচ্ছে এমন খবরে ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট সিলেটের নেতারাসহ স্থানীয়রা এর প্রতিবাদ জানান। এর পরপরই এটি ভাঙা বন্ধের নির্দেশ দেয় স্থানীয় প্রশাসন ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

ইতিহাস ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও স্থানীয়রা বলছেন, চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত এই ধরনের দৃষ্টিনন্দন সেতু সিলেটে বিরল। সেতুটিকে প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ ঘোষণা করে এটি সংরক্ষণ করা জরুরি। একই সঙ্গে ঐতিহ্যের স্বার্থে সেতুটি অক্ষত রেখে বিকল্প সেতু নির্মাণের দাবিও তাদের।

Advertisement

গত ২৮ ডিসেম্বর এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (চট্টগ্রাম-সিলেট) সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে জানিয়েছিলেন, গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়নে প্রাচীনতম মোগল স্থাপত্যের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘দেওয়ানের পুল’ ভাঙা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রাচীনতম এই সেতু ভেঙে ফেলা হচ্ছে শোনার পরপরই এটি না ভেঙে সংরক্ষণ করার জন্য গোলাপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রত্নতত্ত্ব আইনের কয়েকটি ধারা উল্লেখ করে চিঠি দেওয়া হয়। এর অনুলিপি জেলা প্রশাসককেও দেওয়া হয়েছে। ঐতিহ্যের এই স্মারক সেতুটি রক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

এ বিষয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংগ্রাহক ভাষাসৈনিক মতিন উদদীন আহমদ জাদুঘরের পরিচালক ডা. মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার জাগো নিউজকে বলেন, মোগল স্থাপত্যের ঐতিহাসিক দেওয়ানের পুল প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্পদ। এটা না ভাঙতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এরইমধ্যে চিঠি দিয়েছে। তাই এলজিইডি কর্তৃপক্ষের এটা ভাঙার অধিকার নেই। সেতুটি যেখানে সংরক্ষণ করা উচিত, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠান এলজিইডির উদ্যোগে ঐতিহ্য ধ্বংসের এমন প্রক্রিয়া দেখে আমরা হতাশ।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সংবিধানে সরকারকে প্রাচীনতম এসব প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ রক্ষার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এ ধরনের একটি অমূল্য সম্পদ কাওকে না বলেই ভেঙে ফেলা ফৌজদারি অপরাধের শামিল। আমাদের এই ঐতিহ্যের স্মারক সেতুটি রক্ষার দাবি জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে এলজিইডি সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী ইনামুল কবীর বলেন, পুরাতন সেতুটি ভেঙে আধুনিক যুগোপযোগী একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল এলজিইডি। পরে এ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি হলে ভাঙার কাজ স্থগিত রাখা হয়। পরে স্থানীয় লোকজন পুরাতন সেতুটি ভেঙে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেন।

Advertisement

তিনি বলেন, স্থানীয় ব্যক্তিদের পাল্টাপাল্টি মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে। রোববার বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত গণশুনানি চলবে। সেখান থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ১৫ জানুয়ারি গণশুনানি আয়োজনের নোটিশ প্রকাশ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দেওয়ানের পুল সেতুটি ২০ ফুট দীর্ঘ ও ১৬ ফুট প্রস্থের ছিল। একই জায়গায় এখন ৯৯ ফুট দীর্ঘ ও ৩২ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট সেতু নির্মাণ করা হবে। এজন্য ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরে সেতুর সংযোগ সড়কটিও প্রশস্ত করা হবে।

এর আগে গত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাউশা এলাকার দেওরভাগা খালে অবস্থিত প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো মোগল আমলের ‘দেওয়ানের পুল’ ভাঙার কাজ শুরু করে এলজিইডি। ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে এখানে নতুন একটি সেতু নির্মাণ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে মোগল আমলে নির্মিত সেতুটি ভাঙার খবর পেয়ে স্থানীয় মানুষ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থলে পৌঁছে সেতুটি অক্ষতভাবে রক্ষার দাবি জানায়। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্দেশনায় ২৮ ডিসেম্বর থেকে সেতু ভাঙার কাজ বন্ধ রাখা হয়।

রেকর্ড অনুযায়ী জানা যায়, মোগল শাসনামলে সম্রাট মুহম্মদ শাহর রাজত্বকালে অল্পকালের জন্য সিলেটের দেওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা) নিযুক্ত হয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে সিলেট আসেন দেওয়ান গোলাব রাম (মতান্তরে গোলাব রায়)। এসময় সিলেট অঞ্চলের ফৌজদার ছিলেন সমসের খান এবং সারা বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন সুজা উদ্দিন খান। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই এই ধর্মপ্রাণ দেওয়ান গোলাপগঞ্জের ঢাকা-দক্ষিণে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্যের পিতৃভূমি সম্পর্কে অবগত হন। দেওয়ানের নির্দেশে ওই সময়ে সিলেট থেকে ঢাকা-দক্ষিণ পর্যন্ত সড়ক ও সেতু নির্মিত হয়। এ সড়ক পথে ঢাকা-দক্ষিণ এসে দেওয়ান শ্রী চৈতন্যের পিতৃভূমিতে এক মন্দির স্থাপন করেন। এর সামনে এক দিঘি খনন করান।

হেতিমগঞ্জ থেকে ঢাকা-দক্ষিণগামী সড়কটি আজও ‘দেওয়ানের সড়ক’ নামে পরিচিত। এ সড়কে দেওয়ানের পুলটি গোলাপগঞ্জবাসীর কাছে মোগল স্থাপত্য রীতির একটি নিদর্শন ছিল। যা প্রাচীন দলিল ও রেকর্ডপত্রে তারই সাক্ষ্য বহন করে।

ছামির মাহমুদ/এমআরআর/এএসএম