ফিচার

জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি চায় মণিপুরী তাঁত

রফিকুল ইসলাম জসিম

Advertisement

সিলেটি মণিপুরী তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। এটি ৩০০ বছরের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। মণিপুরী শাড়ির জন্যই তাদের সুনাম এখন বিশ্বব্যাপী। সম্প্রতি ঢাকায় এক সভায় সিলেটি মণিপুরী শাড়িকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি চেয়েছে ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ইডিসি)।

মণিপুরী নারীরা বুনন শিল্পে খুবই দক্ষ। নিজেদের কাপড় নিজেরাই বোনেন। তাই প্রায় প্রতিটি মণিপুরী ঘরেই তাঁত রয়েছে। প্রবাদ আছে—মণিপুরী নারীরা জন্মসূত্রেই তাঁতি। প্রায় ৯০ শতাংশ মণিপুরী নারী তাঁতের সঙ্গে যুক্ত। তাদের উৎপাদিত তাঁত পণ্যের মধ্যে আছে—ফানেক (বিশেষ পোশাক), শাড়ি, বিছানার চাদর, শাল, ওড়না, গামছা, থ্রি-পিস ইত্যাদি। অবশ্য তাদের শাড়ি বুননের প্রচলন অন্য বুননের কিছুটা পরে শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে এ শাড়ি জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।

মণিপুরী কাপড়ের ইতিহাসদ্বাদশ শতাব্দীর দিকে মণিপুরের মোইরাং অঞ্চলে বস্ত্র বয়নশিল্প যথেষ্ট উৎকর্ষ লাভ করেছিল। সে সময়ের মোইরাং অঞ্চলের রাজকন্যা থোইবীর হাতে বোনা কাপড় উৎকর্ষে এবং মিহি কারুকাজে এতই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, এখনো মণিপুরের জাদুঘরে রাখা সেসব বস্ত্র বিমুগ্ধ করে।

Advertisement

মণিপুরী নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ফানেক—যেটি কোমরে প্যাঁচ দিয়ে পরতে হয়। সাথে ব্লাউজ এবং ফিতুপ অথবা ইনাফি। ফিতুপের উন্নত সংস্করণ মৈরাংফি—যেটি মূলত কারুকার্যখচিত ওড়না বিশেষ। মণিপুরী শাড়ি এ মৈরাংফিরই ইম্প্রোভাইজড সংস্করণ। যার উৎপাদন শুরু হয় নব্বই দশকে মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই।

আরও পড়ুন: মীতৈ মণিপুরীদের বৈচিত্র্যময় বিয়ের রীতিনীতি

ভারতে ‘মৈরাং’ হচ্ছে প্রাচীন মণিপুরের একটি রাজ্য, ‘ফি’ অর্থ পোশাক। মৈরাংফির সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অংশ হলো এর পাড়ের বৈচিত্র্যময় ‘মৈরাং’ বা মন্দির ডিজাইন। মন্দির ডিজাইনটি মৈরাংয়ের সুপ্রাচীন থাংজিং মন্দিরের নকশার অনুকরণে করা। থাংজিং মণিপুর মিথোলজির দেবতা; তিনি ঈশাণ কোণের দিক রক্ষাকর্তা। মৈরাংয়ের নারীরাই প্রথম মৈরাংফির বুনন শুরু করেন। মৈরাংয়ের রাজকন্যা থৈবী সর্বপ্রথম মৈরাংফি পরিধান করেন বলে জনশ্রুতি আছে।

মণিপুরী শাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্যজামদানি, বেনারসি, টাঙ্গাইল, পাবনা, রাজশাহীসহ অন্য দেশীয় তাঁতের শাড়িগুলোর প্রতিটির আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, যা দেখলেই বোঝা যায় এটি কোন তাঁতের শাড়ি। ঠিক তেমনি মণিপুরী শাড়ির রং ও নকশা দেখলেও বোঝা যাবে এটি মণিপুরী শাড়ি। কারণ মণিপুরী শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হলো—এর নকশায় মাইরাংগ (টেম্পল) বা মন্দিরের প্রতিকৃতি থাকবে। তাই প্রায় প্রতিটি শাড়ির আঁচল, জমিন ও পাড়ের নকশায় দেখা যাবে এ প্রতিকৃতি। আরেকটি বিশেষ দিক হলো—মণিপুরী শাড়ি তৈরি হয় বরাবরই উজ্জ্বল রঙের সুতায়। আর এ সুতাগুলো দেশি সুতি ও একটু মোটা মানের। তাই শাড়িগুলো হয় একটু ভারী ও একটু অমসৃণ। অন্য শাড়ির পাড় বিভিন্ন ধরনের হলেও মণিপুরী প্রায় সব শাড়ির পাড়ই চওড়ায় এক থেকে দুই ইঞ্চি হয়ে থাকে এবং এক রঙের। এ ছাড়া পাড়ের রং প্রায় সব সময় জমিনের রঙের বিপরীত হতে দেখা যায়। আঁচল, জমিন ও পাড়ে মন্দিরের প্রতিকৃতির পাশাপাশি আঁচল ও জমিনে বিভিন্ন নকশা থাকে। যেমন- গোলাপ ফুল, জবা ফুল, বৃত্ত, রেখাসহ বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতি। অনেক আগে থেকেই এসব নকশার প্রচলন আছে। তা এখনো চলছে।

Advertisement

মণিপুরী শাড়ির আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, সেটি হলো—এর পুরো জমিনেই কম-বেশি নকশার ছাপ থাকবে। তবে আগে কিছু কিছু মণিপুরী শাড়ি তৈরি হতো একেবারেই সাদামাটা নকশাবিহীন। তবে সাদামাটা নকশাবিহীন শাড়ি এখন যে একেবারেই তৈরি হচ্ছে না, তা নয়। হাতেগোনা দুই-একজন তাঁতি এখনো সাদামাটা নকশাবিহীন মণিপুরী শাড়ি বুনছেন। তবে তা নিতান্তই নিজেদের প্রয়োজনে বা বিশেষ কাজের জন্য বোনা হচ্ছে। নকশার দিক থেকে মণিপুরী শাড়ির সঙ্গে জামদানি শাড়ির একটি মিল আছে। সেটি হলো—জামদানি শাড়ির নকশা যেমন অনেকটা সূক্ষ্ম হয়, তেমনি মণিপুরীরাও শাড়িতে জামদানি শাড়ির মতো সূক্ষ্ম নকশা করতে পছন্দ করেন।

জিআই পণ্যের স্বীকৃতি কেন পাবেঢাকার বনশ্রীতে ‘সিলেটি মণিপুরী কেন জিআই পণ্য হওয়া উচিত?’ এ শিরোনামে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভার প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী। বিশেষ অতিথি ছিলেন ইডেন মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ফারজানা হোসেন, ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রেসিডেন্ট কাকলী তালুকদার ও কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিগার ফাতেমা।

আরও পড়ুন: মণিপুরী পাঙালদের বিয়ের রীতিনীতি

আলোচনায় সিলেটি মণিপুরী জিআই পণ্য হওয়া উচিত বলে তারা দাবি জানান। পণ্যের জিআই পাওয়ার প্রধান শর্তগুলোর কয়েকটি হলো—১. সেই পণ্যের মিনিমাম ৫০ বছরের ইতিহাস থাকতে হবে। যার প্রমাণ কোনো বই, জার্নাল বা কোথাও উল্লেখ থাকতে হবে। ২. পণ্যের ভৌগলিক অবস্থানের নির্দিষ্ট ম্যাপ থাকতে হবে। ৩. পণ্যের কাঁচামাল থেকে শুরু করে তৈরির পুরো প্রসেস আমাদের দেশের হতে হবে। জেনে রাখা ভালো, বাংলাদেশ ও ভারতে আলাদা আলাদা তাঁতে তৈরি হয় এক্সক্লুসিভ মণিপুরী শাড়ি। দেখতে প্রায় একই হলেও বুননে অনেক পার্থক্য আছে।

ভারতের জিআই ট্যাগ লাগানো মৈরাংফি—যেটি পিওর কটন এবং রেশম সুতায় তৈরি শাড়ি। আমাদের দেশের সিলেটি মণিপুরী শাড়ির সুতা নরসিংদী থেকে আসে এবং এটি মিক্সড সুতা। ভারতের মৈরাংফি আর সিলেটি মণিপুরী শাড়ির মধ্যে অনেক তফাৎ। নামে তারা মৈরাং, আমাদের দেশের মণিপুরী তাঁতের শাড়ি। এখানে সুতা, ডিজাইনে সব দিক থেকে ভিন্নতা আছে।

ভারতের মণিপুর রাজ্যে শুধু মণিপুরী তাঁতিরাই এ শাড়ি তৈরি করেন। তার অন্যতম কারণ—মণিপুরীরা এ শাড়ি তৈরিতে যতটা দক্ষ, অন্য সম্প্রদায়ের লোক সেটি পারেন না। আমাদের দেশে মণিপুরী সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বাঙালি অন্য সম্প্রদায়ও এ তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। যার জন্য আমাদের দেশের মণিপুরী শাড়িগুলোয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতা আছে।

বাংলাদেশে সুতি সুতায় তৈরি শাড়িগুলোর চেয়ে টেট্রন সুতায় তৈরি করা শাড়ির আধিক্য বেশি। তুলনামূলক এ সুতা দামের দিক থেকে সস্তা এবং টেকসই। তাই টেট্রন সুতায় বোনা শাড়ি বাংলাদেশের মানুষের কাছে অনেকটাই সহজলভ্য। এমন আরও কিছু বিষয় আছে, যার জন্য ভারতের মণিপুরী শাড়ির থেকে আমাদের দেশীয় মণিপুরী শাড়ি কিছুটা হলেও আলাদা।

আরও পড়ুন: মণিপুরিদের বিলুপ্ত ‘কাং খেলার’ ঐতিহ্য ফিরে আসছে

মণিপুরী শাড়ির চাহিদা ও গুণগতমান বাড়লেও মণিপুরী তাঁতশিল্প এখনো পুরোটাই চলছে মণিপুরীদের লোকজ্ঞানে। তারা তাঁতের কাজ করছেন পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। তাই যদিও অনেক সম্ভাবনাময় একটি শিল্প এ মণিপুরী তাঁতশিল্প। কিন্তু এর পেছনে আছে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও দিকনির্দেশনার অভাব। আর সেইসঙ্গে অভাব আছে তাঁতিদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের। যদি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়, সেই সমস্যা দূর হবে নিঃসন্দেহে।

সিলেটি মণিপুরী তাঁতের শাড়ি এবং মণিপুরী নৃগোষ্ঠীর ইতিহাস আমাদের দেশে প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। কারণ মণিপুরীরা তাদের মৌলিক পণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় কাপড়, যেমন- গামছা, শাল, বিছানার চাদর—এসব নিজেদের জন্য বুনে আসছেন শত বছর ধরে। শাড়ি মৌলিক পণ্য না হলেও সাইড পণ্য হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে দেশ থেকে বিদেশে। মণিপুরী পণ্যের কাঁচামাল বা সুতা নরসিংদীতে তৈরি হয়। তাই জিআই পণ্য হিসেবে নিঃসন্দেহে স্বীকৃতি পেতে পারে মণিপুরী শাড়ি।

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।

এসইউ/এএসএম