ইন্টারনেট। বর্তমান বিশ্বে দ্রুত আধুনিকতার জাল বিস্তারে যার ভূমিকা অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য ও অনস্বীকার্য। আধুনিক বিশ্বের বাসিন্দা হিসেবে আমরা সবাই আজ ইন্টারনেটের সুবিশাল জগতে বন্দি। আচ্ছা, এই ইন্টারনেট জগতটা আদৌ কতটা বিশাল? এর সীমা পরিসীমা কতদূর পর্যন্তই বা বিস্তৃত? এর গভীরতা কতটা গভীর সেটাকি চিহ্নিত?
Advertisement
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ও বুঝতে আজ আমরা ইন্টারনেটের সমুদ্র তীর থেকে ঝাঁপ দিয়ে এর ডিপ ওয়েবে ডুব দেবো। এবং পৌঁছে যাবো এর গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারচ্ছন্ন ডার্ক ওয়েবে। ধারাবাহিকভাবে অনুসন্ধান করবো ডার্ক ওয়েবের আরও রহস্যময় খাঁদ মারিয়ানা ওয়েবও। আজ থাকছে এর প্রথম পর্ব।
শুরু করি একটা চমকে দেওয়া তথ্য দিয়ে। বর্তমানে যেটা ছাড়া আপনার দৈনন্দিন জীবন আরও সহজ বা আরও জটিল হতে পারতো সেই ইন্টারনেটের মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশই কেবল দৃশ্যমান। ইন্টারনেটের এই দৃশ্যমান ৪-৫ শতাংশকেই বলা হয় সারফেইস ওয়েব।
আর বাকি যে সুবিশাল ও সুগভীর অংশ আছে তা ইন্টারনেটের সাধারণ ব্যবহারকারীদের থেকে সম্পূর্ণ লুকায়িত ও দৃশ্যত অদৃশ্যে। যা ইন্টারনেটের অন্ধকারে নিমজ্জিত সীমাহীন রহস্যময় এক ভয়ংকর অঞ্চল। আর এ অঞ্চলগুলোই সেই ডিপ, ডার্ক এবং মারিয়ানা ওয়েব।
Advertisement
আরও সহজভাবে ব্যাপারটি বোঝার জন্য একটা আইসবার্গের দৃশ্য কল্পনা করি চলুন। যেখানে পানির ওপরে উঁকি দেওয়া আইসবার্গের দৃশ্যমান আপাত ছোট অংশটিকে সারফেইস ওয়েব আর তলদেশের বিস্তৃত বিশাল অংশটিকে ডিপ, ডার্ক এবং মারিয়ানা ওয়েবের সঙ্গে তুলনা করতে পারি।
সাধারণভাবেই এই পর্যায়ে আপনার মনে প্রশ্ন আসতে বাধ্য, কি এই ডিপ, ডার্ক বা মারিয়ানা ওয়েব? কেনইবা এগুলো লুকায়িত? কেনইবা আমরা সেখানে প্রবেশ করতে পারি না? কারাইবা সেখানে বিচরণ করে? কেনইবা এগুলো ব্যবহার করা হয়? কেনইবা আমরা ব্যবহার করতে পারি না?
কীভাবেই বা সেখানে প্রবেশ করতে পারি? ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো ধারাবাহিকভাবে। পাশাপাশি সেখানে বৈধ উপায়ে প্রবেশের কিছু সুকৌশলও উন্মোচন করবো ধারাবাহিক পর্বের শেষ পর্বে।
খুবই সাদামাটাভাবে যদি বলি, আপনি ইন্টারনেট বলতে যেটা বোঝেন, দেখেন ও ব্যবহার করেন ওটাই সার্ফেস ওয়েব। যেমন গুগল, ইয়াহু, বিং, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব বিবিধ ওয়েব সাইট যা আপনি আপনার ব্রাউজার দিয়ে ব্রাউজ করতে পারছেন এবং সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ করলেই খুঁজে পাচ্ছেন।
Advertisement
সার্ফেস ওয়েব থেকে ঝাঁপ দিয়ে ইন্টারনেট সমুদ্রে ডুব দিলেই ডিপ ওয়েব এবং ডার্ক ওয়েবের শুরু। আপনার প্রচলিত সার্ফেস ওয়েবে ব্যবহৃত ব্রাউজার বা সার্চ ইঞ্জিন ডিপ ওয়েবে অকার্যকর। অর্থাৎ আপনি আপনার ক্রম, মজিলা ফায়ার ফক্স, সাফারি ইত্যাদি ব্রাউজার দিয়ে গুগল, বিং এর মতো সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ করে ডিপ ওয়েবে এক্সেস নিতে পারবেন না এবং পারলেও কোনো সার্চ রেজাল্ট আপনি পাবেন না। তবে বিশেষ সফটওয়ার ব্রাউজার এবং সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে আপনি খুবই সহজে ডিপ ওয়েবে প্রবেশ করতে পারবেন।
‘ডার্ক ওয়েব’ ও ইন্টারনেটের ওই সকল অংশগুলোকেই নির্দেশ করে যেখানে আপনি গতানুগতিক ব্রাউজারগুলো যেমন মজিলা ফায়ারফক্স, গুগল ক্রোম বা সাফারির মাধ্যমে পৌঁছুাতে পারবেন না। এমনকি ইয়াহু, বিং, বা গুগলের মতো সাধারণ কোনো সার্চ ইঞ্জিন দিয়েও ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করা সম্ভব নয় কারণ ডার্ক ওয়েবের ওয়েবসাইটগুলো এসব সাধারণ সার্চ ইঞ্জিনে নথিবদ্ধ থাকে না।
এই পর্যায়ে এসে আপনার কাছে ডিপ ও ডার্ক ওয়েবের মধ্যে দৃশ্যত কোনো পার্থক্য নাও লাগতে পারে। তবে পার্থক্য আছে। ডিপ ওয়েব ইন্টারনেট সমুদ্রের অগভীর থেকে সুগভীর অঞ্চল হলে, ডার্ক ওয়েব ইন্টারনেট সমুদ্রের অন্ধকার তলদেশ। আর মারিয়ানা ওয়েব সেই তলদেশের ভয়ঙ্কর সব খাঁদ।
আপনি যদি ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করতে চান তবে আপনাকে অবশ্যই টর ব্রাউজার নামে একটা বিশেষ ব্রাউজার ব্যবহার করতে হবে। টর ব্রাউজার মূলত একটি বেনামি বা অজ্ঞাতনামি ব্রাউজার যা এর ব্যবহারকারীর সকল তথ্য গোপন রাখে। এদিকে ডার্ক ওয়েবের ওয়েবসাইটগুলোর এক্সটেনশানগুলোও কিন্তু আমাদের সচারাচর ব্যবহৃত ওয়েবসাইটগুলোর এক্সটেনশানগুলোর মতো নয়। ডার্ক ওয়েবসাইটের জন্য ব্যবহৃত উচ্চ এনক্রিপটেড ডোমেইন হলো ডট ওনিওন।
সে যাই হোক, মার্কিন গুপ্তচরদের নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে তথ্য আদান-প্রদানের সুবিধার্থেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রথম ডার্ক ওয়েবের মতো একটা ওয়েব কন্টেন্ট তৈরির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। সেই সুবাদেই নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক গবেষকেরা তৈরি করে নতুন এক সফটওয়ার- ‘দ্য ওনিয়ন রাউটার’ বা সংক্ষেপে যাকে বলা হয় ‘টর’।
ডার্ক ওয়েবকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে অনবদ্য ভূমিকা পালন করা এই ‘দ্য ওনিয়ন রাউটার’ ২০০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চালু হয়। প্রথমদিকে এই সফটওয়ার শুধুমাত্র মার্কিন গোয়েন্দাদের মধ্যেই ব্যবহৃত হতো যাতে তারা বেনামিভাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদির আদান-প্রদান করতে পারে।
ডার্ক ওয়েব এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ হলো এখানে ব্যবহারকারীরা বা ক্রেতা ও বিক্রেতা কেউ-ই কাউকে চিনতে পারে না বা নিজেদের পরিচয় গোপন করে ভিন্ন কোনো আইপি অ্যাড্রেস ব্যবহার করে যোগাযোগ করে। ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে আপনি অজ্ঞাত পরিচয়ে অবৈধ দ্রব্য বা কোনো বস্তু যেমন বন্দুক, ড্রাগ, ক্রেডিট কার্ড নম্বর কেনাবেচা করতে পারবেন অনায়াসেই।
আবার ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে প্রিপেইড ডেবিট কার্ড থেকে শুরু করে জাল টাকা পয়সাও বেচাকেনা হয়ে থাকে। এমনকি কেউ চাইলে অন্যকারো নেটফ্লিক্স অ্যাকাউন্ট, কোনো ইউজারনেম বা পাসওয়ার্ডও হ্যাক করতে পারে ডার্ক ওয়েবের সাহায্যে।
শুনে অবাক লাগলেও সত্যি যে, আপনি প্রফেশনাল হ্যাকারদেরও অজ্ঞাতপরিচয়ে ভাড়া করতে পারেন ডার্ক ওয়েব থেকে। শুধু তাই নয়, বহুবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন কালোবাজারি, বিকৃত বা শিশু পর্নগ্রাফি, কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে উষ্কে দেয়া, ব্যাংক ডাকাতির মতো কার্যকলাপের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল এই ডার্ক ওয়েব।
ড্যানিয়েল মুর এবং থমাস রিড নামে কিং’স কলেজ, লন্ডনের দু’জন রিসার্চার ২০১৫ সালের ডার্ক ওয়েবে প্রকাশিত কিছু কন্টেন্ট প্রকাশ করেন। যেখানে সে বছরে ডার্ক ওয়েবের ৫ সপ্তাহের মোট ২৭২৩টি লাইভ কন্টেন্ট যাচাই করে দেখা যায় ৫৭ শতাংশ কন্টেন্টই অবৈধ বিষয় বা জিনিসপত্র নিয়ে। আবার ২০১৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায় ২০১৬ সাল অবধি সেই সকল ক্ষতিকর বা অবৈধ কন্টেন্টের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
ডার্ক ওয়েবে আপনি যদি প্রবেশ করতে চান তাহলে আপনাকে টর ব্রাউজার সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখতে হবে আর তা নাহলে নেমে আসতে পারে সমূহ বিপদ। যেহেতু ইন্টারনেটের এই অংশটাতে বিভিন্ন বে-আইনি কার্যকলাপ ও হ্যাকারদের বিচরণ, তাই আপনাকে বুঝে শুনেই নিজের মোবাইলে বা কম্পিউটারে এই ব্রাউজার ইন্সটল করতে হবে।
যদি কোনো কারণে ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করতে হয় আপনাকে সেক্ষেত্রে হ্যাকিং ও ভাইরাসের আক্রমণ বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ডার্ক ওয়েবের কিছু ওয়েবসাইটের মাধম্যে আপনার ডিভাইজটি সংক্রমিত হতে পারে বা হ্যাকড হয়ে যেতে পারে। এমনকি কখনও কখনও আপনার ডিভাইজের ওয়েবক্যামও হাইজ্যাক হয়ে যেতে পারে ডার্ক ওয়েবে প্রবেশের ফলে।
আপনি যদি ডার্ক ওয়েব সম্পর্কে নিতান্ত বা অল্পবিস্তর ধারণা রাখেন তাহলে আপনি ডার্ক ওয়েবকে ভাবতে পারেন শুধুমাত্র নেটদুনিয়ার যাবতীয় অপরাধের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসেবেই। কিন্তু আসলেই কি তাই? প্রকৃতপক্ষে কোনো বিষয় ভালো নাকি খারাপ তা নির্ভর করে মূলত নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণের ওপর।
যেমন কোনো কোনো দেশ বা সেদেশের সেনাবাহিনী তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ডার্ক ওয়েবের সাহায্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি গোপন রাখতে পারে। শুধু দেশই নয়, পৃথিবীর অনেক বড় বড় বা বিশেষ ব্যক্তিত্বেরাও এখানে নিজেদের তথ্যাদি গোপন রাখেন।
আবার অনেক সাংবাদিকও ডার্ক ওয়েবের সাহায্যে প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেন অনায়াসেই। আসলে ডার্ক ওয়েবের ব্যবহার ভালো ক্ষেত্রে হবে নাকি খারাপ ক্ষেত্রে হবে তা পুরোপুরি এর ব্যবহারকারীর ওপরই নির্ভর করে। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই ডার্ক ওয়েবের বেশিরভাগ কন্টেন্টই অপরাধমূলক। চলবে…
এমআরএম/এমএস