ছাও ইয়ান হুয়া (সুবর্ণা)
Advertisement
২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি চীনাদের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বসন্ত উৎসব। ২১ থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ নাগরিক বসন্ত উৎসবের সরকারি ছুটি কাটাবেন। উৎসবের আগে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের জন্য উপহার কেনা চীনাদের বসন্ত উৎসবের অন্যতম রীতি।
তাই বসন্ত উৎসবের প্রাক্কালে চীনের বিভিন্ন সুপারমার্কেট ও শপিংমলে অনেক ক্রেতা দেখা যায়। চীনা ব্যবসায়ীদের জন্য টাকা উপার্জনেরও এটা শ্রেষ্ঠ সময়। রাস্তার দু’পাশেও বসন্ত উৎসবের লাল লণ্ঠনসহ বিভিন্ন পণ্য সাজিয়ে বসে পড়েন অনেক ব্যবসায়ী। এভাবে, বসন্ত উৎসবের আমেজ দিন দিন বাড়তে থাকে।
আরও পড়ুন: চীনে লাল পাতার উৎসব
Advertisement
আমার জন্ম বেইজিংয়ে। এই মহানগর চীনের রাজধানী। এ শহরে ৩ কোটি মানুষের বাস। ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত, গত ৩০ বছরে বেইজিংয়ের লোকসংখ্যা অনেক গুণ বেড়েছে। আমার জানামতে, বেইজিংবাসীর সংখ্যা ১ কোটির মতো। বাকি তিন ভাগের দুই ভাগ লোকের জন্মস্থান অন্যান্য প্রদেশে। তারা চাকরির জন্য বেইজিংয়ে এসেছেন, বিশেষ করে উত্তর ও মধ্যাঞ্চল থেকে। দক্ষিণ চীনের লোকেরা কুয়াংচৌ বা শাংহাইতে চাকরি নেওয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।
২১ জানুয়ারি এ বছরের বসন্ত উৎসবের প্রথম দিন। জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রাস্তায় অনেক ট্র্যাফিক জ্যাম হয়। তখন গাড়ি চালিয়ে অফিসে আসতে আধা ঘণ্টার পথ দেড় ঘণ্টায় অতিক্রম করতে হয়। তবে এখন অবস্থা ধীরে ধীরে ভালো হয়েছে, রাস্তার কোনো কোনো ছোট দোকান ও রেস্তোরাঁও ছুটির কারণে বন্ধ।
আমার ধারণা অনেকে এরই মধ্যে জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার পথে। তাই বেইজিংও আমার ছোটবেলার মতো একটু শান্ত হয়ে যাবে। বাংলাদেশে ঈদের সময় প্রায় একই দৃশ্য দেখেছি। ঈদ উৎসবের জন্য সবাই গ্রামের বাড়িতে ফিরে যায়। তখন ঢাকা শহরের ট্র্যাফিক জ্যামও অনেক কমে যায়।
আরও পড়ুন: চীনের বসন্ত উৎসব ও ব্যাঘ্রবর্ষ সমাচার
Advertisement
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে কোভিড মহামারি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ৩ বছর হয়ে গেছে। মহামারি প্রতিরোধের জন্য চীনের অনেক লোক এতদিন জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। তবে ৮ জানুয়ারি থেকে, চলমান কোভিড পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে, চীন সরকার নতুন শিথিল ব্যবস্থা নিয়েছে।
ফলে এ বছরের বসন্ত উৎসবে অনেক চীনা নিজ নিজ জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। বড় শহরের লোকদের বসন্ত উৎসবের সময় জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার একটি বিশেষ নাম আছে, আর সেটি হচ্ছে ‘ছুন ইয়ুন’। এর অর্থ হলো বসন্ত উৎসবের জন্য যাতায়াত।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, চলতি বছর প্রায় ২১০ কোটি পার্সনটাইমস যাত্রী বিমান, ট্রেন, জাহাজ ও মহাসড়ক ব্যবহার করে জন্মস্থানে ফিরে যাবেন। এতো বিশাল যাত্রী বহন করা চীনের পরিবহন ব্যবস্থার জন্য একি বড় চ্যালেঞ্জ।
চীনা চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে প্রতি বছরের বসন্ত উৎসবের তারিখ নির্দিষ্ট নয়। তবে সাধারণত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে এই দিনটি পড়ে। এ উৎসব চীনাদের জন্য নতুন বছরের প্রতীক। উৎসবের পর কৃষকদের কৃষিকাজ ধীরে ধীরে শুরু হবে, অনেকটা বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের মতো।
চীনাদের ১২টি রাশিচক্র রয়েছে। চীনা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে ইঁদুর, গরু, বাঘ এবং খরগোশসহ ১২টি পশুর নামে বছরের নামকরণ করা হয়। ১২ বছরে প্রতিটি পশুর নামে বছর একবার করে আসে এবং এভাবেই চলতে থাকে। তাই প্রত্যেক চীনার জন্য নিজের জন্মবর্ষের পশু আছে। চলতি বছর হলো খরগোশ বর্ষ। চীনা ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিতে যারা খরগোশ বর্ষে জন্মগ্রহণ করে, তারা হয় শান্ত, নরম, সরল ও দায়িত্বশীল। তারা কাজ করলে খুব ভালোভাবে তা শেষ করে।
আরও পড়ুন: চীনে কুকুরের মাংস খাওয়ার উৎসব চলছেই
চীনের বড় শহরের নাগরিকরা বসন্ত উৎসবের সময় সিনেমা হলে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখেন, শপিংমলে সুন্দর উপহার কেনেন, বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় গিয়ে গল্প করেন ও খাওয়া-দাওয়া করেন এবং বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় অংশ নেন। উত্তর চীনের লোকরা ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে স্পা করা বেশ পছন্দ করে।
গত কয়েক বছর ধরে অনেক প্রচলিত বিনোদনের পদ্ধতি এটি। এটি দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানেও বেশ জনপ্রিয়। চীনের স্পা দোকান এখন সহজ পাওয়া যায়।
স্পার দোকানগুলোতে নারী ও পুরুষদের আলাদা ব্যবস্থা আছে। তবে ডাইনিং এলাকা ও বই পড়ার কোণ, কারাওকেসহ বিভিন্ন বিনোদন এলাকা সবার জন্য খোলা থাকে। যারা বাচ্চাদের নিয়ে স্পা দোকানে যায়, সেখানে বাচ্চাদের বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।
সাধারণত প্রত্যেকে ৩০০ ইউয়ান দিয়ে ৬ ঘণ্টার মতো স্পা দোকানে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারেন। যদি পা ম্যাসাজ, বিশেষ খাবার ওর্ডার করতে চান, তাহলে অতিরিক্ত খরচ দিতে হবে। বন্ধুদের সঙ্গে আরামে একদিন কাটাতে পারেন এখানে। চীনা যুবকদের মধ্যে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
যদিও আমি সবসময় বেইজিংয়ে বসবাস করি, তবে অনেক নতুন বিনোদন সম্পর্কে কিছুদিন আগে মাত্র জেনেছি। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। চলতি বছরের বসন্ত উৎসবের একটা দিন আমিও বন্ধুদের সঙ্গে স্পা দোকানে কাটানোর পরিকল্পনা করছি।
নতুন এই পদ্ধতিতে সুখী ও সুন্দর বসন্ত উৎসবের ছুটি কাটাবো। লেখার শেষ দিকে সবাইকে বেইজিং থেকে বসন্ত উৎসবের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানাই, বন্ধুদের সময় পেলে চীনা বসন্ত উৎসবের আমেজ উপভোগ করতে আহ্বান জানাই।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) এর বাংলা বিভাগের উপ-পরিচালক।
এমআরএম/এমএস