দেশজুড়ে

আওয়ামী লীগের দুই নেতায় বন্দি বগুড়া ছাত্রলীগ

‘বিগত সময়ে কখনোই এমন করুণ দশা হয়নি বগুড়া ছাত্রলীগের। নিজ দলের নেতাকর্মীরাই একে অন্যের ওপর হামলা চালাচ্ছেন। অবজ্ঞা করা হচ্ছে মূলদল আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদেরও। প্রকাশ্যেই দলীয় কার্যালয়ে তালা দেওয়া থেকে শুরু করে অস্ত্রবাজি, হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে মামুলি ব্যাপারে। শুধুমাত্র পদের জন্য একটি ছাত্রসংগঠনের নেতারা এতটা বাড়াবাড়ি করতে পারেন তা বগুড়ার দিকে না তাকালে বোঝা যাবে না।’

Advertisement

সম্প্রতি জেলা ছাত্রলীগের অরাজকতা পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সাবেক ছাত্রনেতা ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আসাদুর রহমান দুলু এসব কথা বলেন। একইভাবে ছাত্রলীগের এই উন্মাদনার পেছনে তিনি আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার উসকানি আছে বলেও উল্লেখ করেন।

জানা গেছে, বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের কার্যক্রম বর্তমানে আওয়ামী লীগের দুই নেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বন্দি হয়ে গেছে। নিজেদের স্বার্থে এই ছাত্র সংগঠনটিকে ব্যবহার করায় দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। পরনির্ভরশীলতার কারণে বগুড়ায় ছাত্রলীগের অস্তিত্ব নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয় গত বছরের ৭ নভেম্বর। তবে এখনো তারা কার্যক্রম গুছিয়ে নিতে পারেনি। নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ এখনো বিভক্ত রয়েছে। ভিন্ন ভিন্নভাবে চলছে দলীয় বিভিন্ন কার্যক্রম।

Advertisement

এর আগে একমাসে দুই গ্রুপের বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতিতে দলীয় কার্যালয়ে তালা দেওয়া থেকে শুরু করে অস্ত্রবাজি, হামলা, অগ্নিসংযোগ, সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাদের লাঞ্ছিত করার ঘটনাও ঘটে। একটি ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে জেলার নেতাদের মাতামাতি করার ঘটনায় বিস্মিত কেন্দ্রের নেতারাও।

আরো পড়ুন- বগুড়ায় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের হাতাহাতি

কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, নিজেরা সংযত না হলে যেকোনো সময় বড় ধরনের অঘটনের আশংকা রয়েছে।

প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে জেলা ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন জেলা আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা। তাদের একজন ছিলেন জেলার প্রয়াত সভাপতি মমতাজ উদ্দিন এবং অন্যজন হলেন যুগ্মসম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন। এই দুই নেতার সুপারিশক্রমেই বিগত সময়গুলোতে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ নির্ধারণ করতের কেন্দ্রের নেতারা। মূলত ছাত্রলীগের ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশ করতেই কমিটি গঠনে হস্তক্ষেপ ছিলো তাদের।

Advertisement

তবে এবার কমিটি গঠনের আগে পরিস্থিতি ছিলো কিছুটা ভিন্ন। মমতাজ উদ্দিন মারা গেছেন ২ বছর আগে। তার জায়গায় ছাত্রলীগের একটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বর্তমান সভাপতি মজিবর রহমান মজনু। অন্যপক্ষের নিয়ন্ত্রণ যথারীতি মঞ্জুরুল আলম মোহনের হাতেই রয়েছে। এবার কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক পদ দুটিই মজিবর রহমান মজনুর পছন্দের প্রার্থী পেয়ে যান। এতেই ক্ষিপ্ত হন মঞ্জুরুল আলম মোহন গ্রুপের নেতাকর্মীরা।

তারা অভিযোগ করেন, বর্তমান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মাহিদুল ইসলাম জয় একজন হাইব্রিড নেতা। বগুড়ায় কখনো রাজনীতি না করেও মজিবর রহমানের সমর্থন পেয়ে তিনি রাতারাতি বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। অথচ এই পদে অসীন হতে বগুড়ার অন্তত্য এক ডজন নেতা ছিলো।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আমিনুল ইসলাম ডাবলু বলেন, এখনকার ছাত্রলীগ পুরোটাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। বয়সের কারণে এদের আচরণও কিছুটা উগ্র। কথায় কথায় একে অন্যের ওপর হামলা চালায়। আমরা সিনিয়র নেতারা চেষ্টা করেছি জেলার সমস্যা সমাধানে কাজ করার। মূল সমস্যা হলো একটি পদেও বিপরীতি প্রার্থী থাকে অনেক। যার কারণে সবার মন রক্ষা করা যায় না। তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি যারা মাঠে থেকে রাজনীতি করে, দলের দুঃসময়ে পাশে থাকে, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তাদেরকেই মূল্যায়িত করা দরকার।

গত দুই মাসে বগুড়ায় ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল করার দাবি তুলে ৫ বার দলীয় কার্যালয়ে তালা লাগানো ও ভাঙা হয়েছে। এছাড়া আজিজুল হক কলেজে ছাত্রলীগের দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষ, দলীয় কার্যলয়ের সামনে অস্ত্র হাতে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, সর্বশেষ ছাত্রলীগের কার্যালয়ের দরজা খুলে তাতে আগুন লাগানোর ঘটনাটও এই বগুড়াতেই। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির কুশ পুত্তলিকা দাহ করা থেকে শুরু করে তাকে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় গালিগালাজ করার ঘটনা ঘটানো হয়েছে রীতিমতো মাইক লাগিয়ে।

আরো পড়ুন- বগুড়ায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, ছুরিকাঘাতে আহত ৩

ছাত্রলীগের এহেন কর্মকাণ্ড জেলায় ক্ষমতাসীন এই দলকে ছোট করার পাশাপাশি চেইন-অব-কমান্ডও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন আমাদের শ্রদ্ধাভাজন। তিনি প্রতি কমিটিতে তার মনোনীত একজনের জন্য সুপারিশ করতেন। এবারও করেছিলেন। কিন্তু যার জন্য সুপারিশ করেছেন তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মাদক সেবনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এ কারণে তাকে সেক্রেটারি না করে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়েছে। তারপরও এই আন্দোলনের পেছনের কলকাঠি চালনাকারী তারাই।

বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু বলেন, ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগই নেয়। এখানে আমাদের কাছে সুপারিশ চাওয়া হলে আমরা প্রয়োজনে তা করে থাকি। এখানে সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়া আল-মাহিদুল ইসলাম জয় নামের যে ছেলেটিকে নিয়ে এরা বিক্ষুব্ধ হয়েছে সে বগুড়ায় ছাত্রলীগ না করলেও ঢাকায় করেছে। বগুড়ার আদমদীঘিতে তার বাড়ি। তার বাবাও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি নিয়ে একটি পক্ষ বাড়াবাড়ি রকমের ঝামেলা করেছে।

তিনি বলেন, তাদের এসব আচরণ বগুড়ায় ক্ষমতাসীন দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবে আমরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাইনি। দলীয়ভাবে মনোনীতদের নিয়েই কাজ করছি।

অন্যদিকে অপর নেতা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন বলেন, তিনি মাহাফুজার নামে যার জন্য সুপারিশ করেছেন তার বিরুদ্ধে অন্যরা ষড়যন্ত্র করেছে। একটি মিথ্যা ভিডিও তৈরি করে তাতে তার মুখ লাগানো হয়েছে। আসলে মাহাফুজ ভালো ও সাংগঠনিক ছেলে।

ছাত্রলীগে সব সময়ই মাঠের নেতারা প্রাধান্য পায়। এবার তার উল্টোটা হয়েছে। যারা রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে থেকেছে তারা একটি ভালো পদ আশা করতেই পারে। এখানে ভুলের কিছু দেখি না। তবে এটা নিয়ে যাতে কোনো অরাজকতা না হয় আমরা সেদিকে খেয়াল রাখছি।

গত ৭ নভেম্বর সজীব সাহাকে সভাপতি এবং আল-মাহিদুল ইসলাম জয়কে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের ৩০ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে ১৭ জনকে সহ-সভাপতির পদ দেওয়া হয়। এরমধ্যে কমিটিতে স্থান পাওয়া আটজন নেতাই পরবর্তী সময়ে কমিটি বাতিলের আন্দোলনে নামেন।

এরা হলেন- সহ-সভাপতির পদ পাওয়া তৌহিদুর রহমান তৌহিদ, মিথিলেস কুমার প্রসাদ, রাকিবুল হাসান শাওন, নুর মোহাম্মাদ সাগর, জাহিদ হাসান, আল আমিন হোসেন পাপ্পু, সিদ্ধার্থ কুমার দাস। আর প্রাপ্য পদ না পাওয়ার অভিযোগ তুলে মুকুল ইসলাম নামের একজন ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন।

নতুন ঘোষিত কমিটিতে ৫ জনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। এদের মধ্যে আন্দোলনে রয়েছেন মাহাফুজার রহমান, মিনহাজুল ইসলাম সজল ও আহসান হাবীব শুভ কমিটি বাতিলের আন্দোলন করে যাচ্ছেন।

একই অবস্থা সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যেও। এই পদ পাওয়ার পরও আল ইমরান হোসেন আন্দোলন করছেন।

জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন মাহাফুজার রহমান। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম মোহনের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণার কিছুদিন আগে মাদক সেবনের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে মাহফুজকে দেখা গেছে এমন অভিযোগ করে ছাত্রলীগের অপর একটি অংশ কেন্দ্রের কাছে অভিযোগ করে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে মাহাফুজ জানান, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ভিডিও এডিট করে প্রচার করা হয়েছে। এ কারণে তিনিসহ সংগঠনের অন্য নেতারা ঘোষিত কমিটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন।

বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরে আলম বলেন, ছাত্রলীগের অরাজকতা নিয়ে পুলিশ সব সময়ই সতর্ক থাকে। বগুড়া আজিজুল হক কলেজে হামলার একটি ঘটনায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে কেউ গ্রেফতার হওয়ার আগেই উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন।

তিনি বলেন, আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে বলে দিয়েছি কোনো সহিংসতা হলে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করা হবে না।

এফএ/এমএস