দেশজুড়ে

মজুরি বাড়লেও খুশি হতে পারছেন না শ্রমিক, বিপাকে বোরো চাষি

তীব্র শীত পড়ছে। আবার বিদ্যুৎবিল ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় খরচও বেড়েছে। তাই লোকসানের শঙ্কা মাথায় নিয়েই বোরো আবাদে নেমেছেন ময়মনসিংহের কৃষকরা। তবে নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের তুলনায় মজুরি না বাড়ায় হতাশ শ্রমিকরা।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর বোরো মৌসুমে এক বিঘা জমিতে পাঁচবার চাষে খরচ ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। এ বছর বোরো মৌসুমে এক বিঘা জমিতে পাঁচবার চাষে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ টাকা।

গত বছর বোরো মৌসুমে এক বিঘা জমিতে সেচ খরচ ছিল দেড় হাজার টাকা। এ বছর বোরো মৌসুমে এক বিঘা জমিতে সেচ খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। একই সঙ্গে বিঘা প্রতি চারা রোপণ খরচ বেড়েছে ৩০০-৪০০ টাকা করে।

ময়মনসিংহ সদর উপজেলার মরাকুড়ি গ্রামের কৃষক লিয়াকত আলী ফকির চলতি মৌসুমে এক একর জমি বোরো আবাদের জন্য প্রস্তুত করছেন। এর জন্য বীজতলাও তৈরি করেছেন। তবে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে চারা রোপণ করতে পারছেন না।

Advertisement

আরও পড়ুন: লোগো পদ্ধতি ধান চাষে ফলন বাড়ে

তিনি বলেন, ‘তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে বোরো মাঠ প্রস্তুত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শীত না থাকলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বোরোর চারা রোপণ করা যেত। সময় মতো রোপণ করতে না পারায় বীজতলার চারা নষ্ট হতে বসেছে। আবার সবকিছু খরচও বেড়েছে। এবার ঠিকমতো ফসল ঘরে তুলতে পারবো কি-না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

একই উপজেলার চর লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক মিয়াজ উদ্দিন মাস্টার বলেন, ‘গত বোরো মৌসুমে সকালের নাস্তা ও দুপুরে ভাত খাওয়াসহ দৈনিক ৪০০ টাকা মজুরি দিতে হতো। নাস্তা ও ভাত খাওয়া ছাড়া দিতে হতো ৫০০ টাকা। এখন তা ১০০-১২০ টাকা বেড়েছে। বেশি না দিলে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে ১০ শতাংশে এক কাঠার হিসাব করা হয়। গত বছর এক কাঠা জমির হালচাষ ছিল ৪০০ টাকা। এ বছর তা বেড়ে ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা দিতে হচ্ছে। এদিকে বিদ্যুৎ বিল বাড়ায় কাঠাপ্রতি সেচ খরচ এ বছর আরও ১০০ টাকা বাড়ছে।’

Advertisement

আরও পড়ুন: দুর্বৃত্তের কীটনাশকে নষ্ট ৪০ বিঘা বীজতলা

চর ঈশ্বরদিয়া গ্রামের কৃষক মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি এ বছর দুই একর জমিতে বোরো আবাদ করছি। এ বছর হালচাষ, শ্রমিক ও সেচ খরচ কাঠাপ্রতি ১০০ থেকে ১২০ টাকা বেড়েছে। এভাবে প্রতি মৌসুমে খরচ বাড়তেই থাকলে আমাদের মত কৃষকের ধান চাষ করা কঠিন হয়ে পড়বে।’

জেলার গৌরীপুর উপজেলা রামগোপালপুর গ্রামের কৃষক আল আমিন দুই একর জমি আবাদ করছেন। তিনি বলেন, ‘শুধু হালচাষ, সেচের খরচ না। ধান চাষ করতে গেলে কীটনাশক দিতে হয়। যে কীটনাশক গত মৌসুমে ১০০ টাকা ছিল। সেই কীটনাশকের দাম বেড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষ ক্ষেতে খামারে কাজ করেই দিন গেলো। কোনদিন লাভের মুখ দেখিনি।’

একই গ্রামের আরেক কৃষক মোসলেম উদ্দিন। তিনি গত বছর দু একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। এবার খরচ বাড়ায় চাষ কিছুটা কমিয়েছেন।

আরও পড়ুন: জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় খরচ বেড়েছে বোরো চাষে, অস্বস্তিতে কৃষকরা

মোসলেম বলেন, ‘বিদ্যুৎবিল, সেচ, হালচাষ খরচ, শ্রমিক, সার ও কীটনাশক খরচসহ সবই বেড়েছে। কিন্তু ধানের দাম তো তেমন পাই না। তাই, ধান চাষ এ বছর কিছুটা কমিয়েছি। সরকার যদি আমাদের সহায়তার হাত বাড়ায় তাহলে ভালো হতো।’

চর ঈশ্বরদিয়া মেরী আগলা কান্দাপাড়া এলাকায় জমিতে চারা রোপণ করছেন এবাদুল মিয়া। তারা সঙ্গে আছেন আরও পাঁচজন। কাঠা প্রতি ৫৫০ টাকায় বোরো ধানের চারা রোপণ করছেন তারা।

এবাদুল মিয়া বলেন, ‘সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে তীব্র শীতে কাদা-পানিতে কাজ শুরু করি। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বাজারে নিত্যপণ্যের যে দাম তাতে সারাদিন কাজ করে ৫৫০ টাকায় সংসার চলে না। এরপরও পেটের দায়ে করতে হয়।’

তারাকান্দা উপজেলার কাশিগঞ্জ থেকে কাজ করতে সাতজন এসেছেন সদর উপজেলার চর ঈশ্বরদিয়া গ্রামে। ৫০০ টাকা কাঠা করে সারাদিনে আট কাঠা জমিতে ধান রোপণ করেছেন।

ওই দলের সাহাবুল ইসলাম নামে এক শ্রমিক বলেন, ‘এ শীতে ভোর ৪টার দিকে ঘুম থেকে উঠে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ হেঁটে এখানে এসেছি। ৫০০ টাকা করে কাজ করতে হচ্ছে। আসা যাওয়া করতেই ১০০ টাকার মত খরচ হয়ে যায়। বাজারের যে অবস্থা, বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালানো খুব কঠিন।’

ময়মনসিংহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মতিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় মোট দুই লাখ ৬২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬৬ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে চারা রোপণ করা হয়েছে। এখনো প্রায় ৭৫ শতাংশ ধান রোপণের কাজ বাকি আছে। বাকি সময়ের মধ্যে চারা রোপণের কাজ শেষ হবে আশা করছি। আমরা কৃষকদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছি।

এসজে/এমএস