অর্থনীতি

এক বছরে নির্মাণসামগ্রীর দাম আকাশ ছোঁয়া

গত এক বছরে নির্মাণশিল্পের অপরিহার্য উপকরণ রডের দাম ভেঙেছে অতীতের সব রেকর্ড। সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে সিমেন্ট। দাম বাড়ার রেকর্ড গড়েছে ইট, বালু, ভরাট বালু, পাথরও। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নির্মাণে জড়িত শ্রমিকের খরচও। মূল্যবৃদ্ধির এ প্রভাব পড়েছে আবাসন প্রকল্পগুলোতে। কনস্ট্রাকশন খরচ বাড়ায় বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে ফ্ল্যাট। চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। চাপ পড়েছে বাড়ি ভাড়ায়।

Advertisement

নির্মাণ খরচ বাড়ায় দাম বেড়েছে সব ধরনের ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের। বর্ধিত দামের কারণে গত বছর বিক্রি নেমে আসে অর্ধেকে। যদিও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম কমলে আবারও ফ্ল্যাটের দাম কমে আসবে। তবে চলমান বা শেষ পর্যায়ের প্রকল্পের ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট বর্ধিত দামেই বিক্রি হবে। মূলত খরচের সঙ্গে সমন্বয় করেই এ দরে তারা বিক্রি করছেন।

আরও পড়ুন>>ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে রড-সিমেন্ট

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের এক তথ্য বলছে, দুই বছরের ব্যবধানে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। ২০২০ সালে এক টন রড ছিল ৬৪ হাজার টাকা, ২০২১ সালে ৬ হাজার টাকা বেড়ে হয় ৭০ হাজার টাকা। আর ২০২২ সালে কয়েক ধাপে ২৪ হাজার টাকা বেড়ে সর্বোচ্চ ৯৪ হাজার টাকায় ঠেকে।

Advertisement

একইভাবে বেড়েছে সিমেন্ট, বালু, পাথর, ইট, থাই অ্যালুমিনিয়াম, গ্রিল ও রেলিং, জেনারেল ইলেকট্রিফিকেশন, স্যানিটেশন, টাইলস ও শ্রমিক খরচ। এতে ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতি স্কয়ার ফুটে বেড়েছে ৫৪১ টাকা ৩৮ পয়সা।

দুই হাজার ফুট কনস্ট্রাকশনের ক্ষেত্রে এর মধ্যে শুধু রডের দাম বাড়ার কারণে ফ্ল্যাটের প্রতি স্কয়ার ফুটে নির্মাণখরচ বেড়েছে ১২০ টাকা। একইভাবে সিমেন্টের কারণে ৪৪ টাকা, বালুর কারণে ২৩ টাকা, ইটের কারণে ৪০ টাকা, পাথরের কারণে ৬৭ টাকা ৫০ পয়সা, থাই অ্যালুমিনিয়ামের কারণে ৩৫ টাকা, শ্রমিক খরচের কারণে বেড়েছে ৭০ টাকা পর্যন্ত।

আরও পড়ুন>> মধ্যবিত্তের ফ্ল্যাট কেনার ‘স্বপ্নভঙ্গ’, হিমশিম ব্যবসায়ীরাও 

সিমেন্টদুই বছর আগে প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট পাওয়া যেত ৩৭৫ থেকে ৪০৫ টাকায়, ২০২১ সালে ছিল ৩৯০ থেকে ৪২৫ টাকা। যেটা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭৫ থেকে ৫৬০ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট বেড়েছে ৮৫ থেকে ১৩৫ টাকা। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে দাম বেড়েছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। যেটা এর পরের বছর সর্বোচ্চ ১৩৫ টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে।

Advertisement

বালুদাম বেড়েছে বিভিন্ন (লাল, সাদা ও ভরাট বালু) বালুর। ২০২০ সালে লাল বালু প্রতি সিএফটি ছিল ৮ টাকা, ২০২১ সালে হয় ১৫ টাকা আর ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ টাকা। সাদা বালু প্রতি সিএফটি ২০২০ সালে ছিল ২৫ টাকা, পরের বছর ৩৫ টাকা আর ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৬০ টাকা। অর্থাৎ, লাল ও সাদা বালুর দাম শুধু এক বছরেই বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

ভরাট বালুর দামও এক লাফে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এক বছর আগে ২০২১ সালে এক গাড়ি ভরাট বালু ছিল ১ হাজার ২শ টাকা, পরের বছর ২০২২-এ এসে তা ২ হাজার ২শ টাকা হয়। আর সিএফটি হিসাবে এর আগে যেটা ৫০ থেকে ৭০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে এখন তা আড়াই থেকে তিন টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বালুর দাম বাড়ায় প্রতি স্কয়ার ফুটে খরচ বেড়েছে ২৩ টাকা।

পাথরএক বছরের মধ্যে শুধু পাথরের দাম ৬০ টাকা, দুই বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৮০ টাকা। দুই বছর আগে প্রতি স্কয়ার ফুট পাথরের দাম ছিল ১৬০ টাকা, পরের বছরে তা বেড়ে হয় ১৮০ টাকা। আর ২০২২-এ তা ৬০ টাকা বেড়ে হয় ২৪০ টাকা। দুই হাজার ফুট কনস্ট্রাকশনের ক্ষেত্রে স্কয়ার ফুটে খরচ বেড়েছে ৬৭ টাকা ৫০ পয়সা টাকা।

ইটইটের দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত। দুই বছর আগে একটি ইটের দাম ছিল ৬ থেকে ৮ টাকা, পরের বছর ২০২১-এ হয় ৮ থেকে ১০ টাকা। আর বিদায়ী ২০২২ সালে সেখানে আরও ৪ টাকা বেড়ে হয় সর্বোচ্চ ১৪ টাকা। ইটের দাম বাড়ায় এক বছরের ব্যবধানে স্কয়ার ফুটে খরচ বেড়েছে ৪০ টাকা।

আরও পড়ুন>> অর্ধেকে নেমেছে ফ্ল্যাট বিক্রি 

অ্যালুমিনিয়ামদুই বছরে থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম বেড়েছে ১৭০ টাকা পর্যন্ত। শুধু থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালে ফ্ল্যাটের দাম প্রতি স্কয়ারে বাড়ে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম দুই বছর আগে প্রতি স্কয়ার ফুট ছিল ২৫০ টাকা, ২০২১ সালে ২৮০ এবং পরের বছরে তা ১৪০ টাকা বেড়ে হয় ৪২০ টাকা। দুই হাজার ফুট কনস্ট্রাকশনে ২০২২ সালে প্রতি স্কয়ার ফুটে খরচ বেড়েছে ৩৫ টাকা।

গ্রিল ও রেলিংগ্রিল ও রেলিংয়ের দামও বেড়েছে ৫৫ টাকা পর্যন্ত। ২০২০ সালে গ্রিল ও রেলিংয়ের স্কয়ার ফুটের দাম ছিল ১০৫ টাকা, ২০২১ সালে ছিল ১২০ টাকা আর ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬০ টাকা। গ্রিল ও রেলিংয়ের দাম বাড়ার কারণে দুই হাজার ফুট কনস্ট্রাকশনে প্রতি স্কয়ার ফুটে খরচ বেড়েছে সাড়ে ৭ টাকা।

জেনারেল ইলেকট্রিফিকেশনের দামও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। দুই বছর আগে প্রতি স্কয়ার ফুটের (এল.এস) দাম ছিল ১০০ টাকা, পরের বছর ১০ টাকা বেড়ে হয় ১১০ টাকা এবং ২০২২ সালে তা ৪০ টাকা বেড়ে দাম হয় ১৫০ টাকা।

স্যানিটারিস্যানিটারি পণ্যের দামও বেড়েছে। দুই বছর আগে স্যানিটেশনে প্রতি স্কয়ার ফুটের (এল.এস) দাম ছিল ১০০ টাকা, পরের বছর ২০২১ সালে ১২০ টাকা এবং পরের বছর ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ১৫০ টাকা। স্যানিটেশনের কারণে নির্মাণ খরচ বেড়েছে ৩০ টাকা পর্যন্ত।

আরও পড়ুন>> সহসা শঙ্কা কাটছে না আবাসন খাতে 

শ্রমিক খরচশ্রমিকের মূল্যও বেড়েছে। দুই বছর আগে প্রতি স্কয়ার ফুটের জন্য শ্রমিক খরচ হতো ১৪০ টাকা, ২০২১ সালে সেটা হয় ১৬০ টাকা। এর পরের বছর প্রতি স্কয়ার ফুটে শ্রমিক খরচ ৭০ টাকা বেড়ে হয় ২৩০ টাকা। শ্রমিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় দুই হাজার স্কয়ার ফুট ফ্ল্যাটের কনস্ট্রাকশনের জন্য বাড়তি খরচ হয় প্রতি স্কয়ার ফুটে ৭০ টাকা।

সব মিলিয়ে দুই হাজার স্কয়ার ফুটে কনস্ট্রাকশন এরিয়ায় খরচ বেড়েছে প্রতি স্কয়ার ফুটে ৫৪১ টাকা ৩৮ পয়সা।

নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন ফ্ল্যাট মালিকরা। এতে সংকটে ভাড়াটিয়ারা। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামে সব শ্রেণির মানুষ বিপাকে। উল্লেখযোগ্য হারে তাদের আয় বাড়েনি। এ কারণে সংসার চালাতে হচ্ছে খরচ কাটছাঁট করে। রাজধানীতে যাদের আয় ২০ হাজার টাকার মধ্যে তারা সংসার চালাতে এখন ঝুপড়ি ঘরে থাকছেন। আর ৩০ হাজারের মধ্যে আয় হলে তাদের ভরসা এখন ১০ হাজার টাকার মধ্যে সাবলেট। বাড়তি খরচ থেকে বাঁচতে অনেকেই পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে ব্যাচেলর জীবন-যাপন করছেন। অনেকেই আবার বড় সাইজের ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেছে নিচ্ছেন ছোট ফ্ল্যাট বা ঝুপড়ি ঘর।

আরও পড়ুন>> নতুন ড্যাপের কারণে আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে 

এসব নিয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, ২০২০ সাল থেকে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে। ২০২২-এর বছরজুড়েই দাম ছিল বেশি। এতে আবাসন ব্যবসায় শঙ্কাও তৈরি হয়। ফ্ল্যাট বিক্রি কমে যায়। সদ্য বিদায়ী বছর ব্যবসাবান্ধব হয়নি।

তিনি বলেন, নতুন ড্যাপের কারণে আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবার জন্য মানসম্মত আবাসন কঠিন হয়ে যাবে আগামীতে। এসব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।

রিহ্যাব সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, নতুন ড্যাপের প্রজ্ঞাপনের পর দীর্ঘ সময় জমির মালিকের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা কোনো চুক্তিতে যেতে পারেননি। নতুন করে প্ল্যান পাস হচ্ছে না। পুরোনো প্রকল্পগুলো নিয়েই কাজ করছে বেশিরভাগ কোম্পানি। ফলে এ বছর ফ্ল্যাটের সংকট তৈরি হবে, দামও বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, নতুন ড্যাপের ‘ফার’ হ্রাসের ফলে বেশিরভাগ ভবন হবে চার-পাঁচতলা। এ কারণে নতুন বছরে আবাসন সংকট আরও বাড়বে। সমস্যা সমাধানে নির্মাণসামগ্রীর দাম কমাতে হবে, ড্যাপ নিয়ে আরও ভাবতে হবে। এটা না হলে উচ্চহারে বাড়বে ফ্ল্যাটের দাম এবং আকাশচুম্বি হবে বাড়িভাড়া। আবাসনখাতেও শঙ্কা তৈরি হবে।

ইএআর/এএসএ/জিকেএস