সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা বেশ টেনশনে আছেন। টানা তিনটি নির্বাচন আয়েশ করে জেতার পর এখন তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভূমিধস জয় পায় আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনরায় পায় আওয়ামী লীগ। অনেক আসনে ১৯৭৩ সালের পর প্রথম জয়ের মুখ দেখে আওয়ামী লীগ।
Advertisement
বহুল আলোচিত ১/১১ সরকারের অধীনে সে নির্বাচনের জয়টি ছিল আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ। অঙ্কের হিসাবে পরের দুটি নির্বাচন মানে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ফলাফল আরও ভালো হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগাররাও ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে যতটা গর্ব করেন, ২০১৪-২০১৮ নিয়ে ততটা নয়। পারলে তারা এ দুটি নির্বাচনের আলোচনা এড়িয়ে যেতে চান।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে, দেশ শাসন করছে। কিন্তু এ দুটি নির্বাচনই দীর্ঘমেয়াদে আওয়ামী লীগের বড় ক্ষতি করেছে। আত্মপ্রসাদ বা আত্মসন্তুষ্টি রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের ঘরে ঘরে এখন আত্মসন্তুষ্টির ঘুণ।
এমনিতে আওয়ামী লীগের মূল শক্তি হলো তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা ত্যাগী ও পোড় খাওয়া নেতাকর্মীরা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগকে একেবারে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের পোড় খাওয়া নেতাদের ত্যাগের বিনিময়ে ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় ফিরতে পেরেছিল। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে তো আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগ নানা চড়াই-উৎরাই, লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে এগিয়েছে। মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে। কিন্তু কখনো মাঠ ছাড়েনি।
Advertisement
১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। মাত্র ৩৯টি আসন পেলেও সেই একেকটি আসন আওয়ামী লীগের ভবিষ্যতের লড়াইয়ের একেকটি পিলার হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালের একতরফা নির্বাচনে পাওয়া অনায়াস জয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ফাঁপা আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে।
এ দুটি নির্বাচনে জয় পেতে তাদের ভোটারদের কাছে যেতে হয়নি। ফলে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও দলের এমপি ও নেতাদের সাথে জনগণের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। পোড় খাওয়া নেতাদের শরীরে এখন ক্ষমতার মেদ।
বিপদটা সবচেয়ে ভালো জানেন শেখ হাসিনা। তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে গেলেও সেই সাফল্যের বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়নি। শেখ হাসিনা এখন দলের এমপি-নেতাদের বারবার জনগণের কাছে যাওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন।
গত ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায়ও শেখ হাসিনা একই বার্তা দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আগামী নির্বাচনে বিতর্কিত এমপিদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না।’ শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কে কী করছে তার সব তথ্য আমার কাছে আছে। যাদের বদনাম আছে, নানা অপকর্মে নাম জড়িয়েছে, তাদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। জনগণের সঙ্গে যাদের সুসম্পর্ক রয়েছে, জনগণের পাশে যারা দাঁড়ায় তারাই নমিনেশন পাবে। আর যারা জনবিচ্ছিন্ন, এলাকার মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই তাদের দলের মনোনয়ন দেওয়া হবে না।’
Advertisement
আগামী নির্বাচন কঠিন এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে জানিয়ে শেখ হাসিনা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি কারও দায়িত্ব নিতে পারব না। বিভিন্ন মাধ্যমে খবর নিচ্ছি। সবার আমলনামা আমার কাছে আছে। মাঠ জরিপের ভিত্তিতেই মনোনয়ন দেওয়া হবে।’
গত ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত নতুন দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশের শীর্ষ সংবাদ ছিল, ‘লাল তালিকায় ১০০ এমপি।’ সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। ‘শেখ হাসিনা কোনো না কোনোভাবে জিতিয়ে দেবেন’- এই আশায় যারা বসে আছেন, তাদের আশার গুড়ে বালি পড়তে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের এমপিরা কে, কোথায়, কী করছেন সেটা শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো আর কেউ জানেন না। দলের মাধ্যমে তো বটেই, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমেও এমপিদের আমলনামা তৈরি হচ্ছে। এই আমলনামার খবরে এখন আওয়ামী এমপিদের ঘুম হারাম। শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি তো তারা নিজেরা জানেন, নিজেদের অপকর্মের খবর।
সমস্যা হলো, ঠগ বাছতে গেলে তো গাঁ উজাড় হয়ে যেতে পারে। জনগণের কাছে যাননি, সেটা না হয় আগামী দিনে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারবেন। কিন্তু যারা এই ১৪ বছরে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, যারা এলাকায় চাঁদাবাজি করেছেন, নানা অপকর্ম করেছেন; তারা এখন মানুষের কাছে যাবেন কোন মুখে। শেখ হাসিনার অনেক সাফল্য নেতাদের অপকর্মে ম্লান হয়ে গেছে।
নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের আরেকটা বড় সমস্যা-দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। রাজনীতিতে এখন আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগই। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব এখন ছড়িয়ে পড়েছে তৃণমূলেও। ‘আওয়ামী লীগ ২৯৯ আসনে পাস করুক, আমার আসন ছাড়া’ এমন ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এখন প্রত্যেক আসনেই আছে।
একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনের আগেই দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের কাছে যেতে হবে। সরকারের সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি নিজেদের ভুল-ত্রুটির জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন ও জয়ের সহজ সূত্রটা বলে দিয়েছেন শেখ হাসিনাই, ‘আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে হলে জনগণের ঘরে ঘরে, দ্বারে দ্বারে যেতে হবে। জনগণের দ্বারে দ্বারে না গেলে জনগণ ভোট দেবে না। সেজন্য আমিও মনোনয়ন দেব না। এলাকার সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকলে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। আমি পরিবর্তন করে দেব। সবাই নিজ নিজ এলাকায় চলে যাও।’
এখন এই সূত্রটা দলের মাঠের নেতারা মানলেই হয়।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম