উত্তরা আবাসিক শহর তৃতীয় পর্ব প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বর্তমান অগ্রগতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) হিসাবে ৮৩ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় মোট প্লট ৮ হাজার ২৯৫টি। বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯৫ শতাংশ প্লট। তবে ২৪ বছরে উন্নয়নের তেমন কোনো ছোঁয়া লাগেনি প্রকল্প এলাকায়। প্লটে আবাসনের বদলে কেউ কেউ গড়ে তুলেছেন নার্সারি। অধিকাংশ প্লটই পড়ে আছে খালি। গত ২৮ ডিসেম্বর স্বপ্নের মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন প্লটের মালিকরা।
Advertisement
রাজউক সূত্র জানায়, আবাসনের চাহিদা পূরণসহ মূল রাজধানীতে যানবাহন ও জনঘনত্বের চাপ কমাতে ১৯৯৯ সালে উত্তরা আবাসিক শহর (তৃতীয় পর্ব) প্রকল্প হাতে নিয়েছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। দীর্ঘ ২৪ বছরেও এ প্রকল্প এলাকায় আবাসন নির্মাণে গতি পায়নি। উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পকে চারটি সেক্টরে (১৫-১৮) ভাগ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৮ নম্বর সেক্টরে রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাকিগুলো আবাসিক সেক্টর।
আরও পড়ুন>> ‘বিশেষ সুবিধায়’ প্লট-ফ্ল্যাট পাচ্ছেন না এমপিরা
প্রকল্পভুক্ত প্লটের প্রায় সবই বরাদ্দ হয়েছে এক যুগেরও বেশি সময় আগে। কিন্তু অধিকাংশ প্লটেরই সীমানা চিহ্নিত বা নির্ধারণ করা হয়নি। অনেককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি প্লট। অনেক প্লটে যাতায়াতের রাস্তাও নেই। নেই কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বাজার। মাটি ভরাটের কাজও বাকি একেকটি ব্লকের একেক স্থানে। অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক ছাড়া কোনো ব্লকেই পুরোপুরি মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়নি। ১৬৫ কিলোমিটার রাস্তার কাজও শেষ হয়নি। কয়েকটি প্রধান সড়ক হয়েছে মাত্র। প্লটে প্লটে সংযোগ সড়ক এখনো হয়নি।
Advertisement
যেসব প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কয়েকটিতে ভবন উঠেছে। তবে নাগরিক সুবিধা না থাকায় বাসিন্দারা থাকতে পারছেন না। ১২টি সেতুর কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। মাটি ভরাটের কাজ ৪০ শতাংশ বাকি। স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডার কোনো কাজ হয়নি। কেবল একটি গির্জা তৈরি করা হয়েছে মাত্র। নেই কাঁচাবাজার। লেকের কাজও অসম্পন্ন। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নেই। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। প্লটপ্রাপ্তরা শুধু অপেক্ষায়, কবে তারা প্লট বুঝে পাবেন। তবে মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর নতুন করে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে প্রকল্প এলাকায়। কিছু কিছু সমস্যা ছিল এগুলো নিরসনে নতুন করে পদক্ষেপ নিয়েছে রাজউক।
আরও পড়ুন>> ৯ হাজার কোটির ভুতুড়ে আবাসনে আলো ছড়াবে মেট্রোরেল
উত্তরা মধ্য স্টেশন থেকে কয়েক মিনিটের পথ বউবাজার। এক সপ্তাহ হলো বাজারটি বসেছে। এখানে কাঁচাবাজার, স্টেশনারি, এসি-ফ্রিজ মেরামতসহ গড়ে উঠেছে কয়েকটি দোকান। চারদিকে যেন ধু ধু মাঠ। কয়েক জায়গায় গড়ে উঠেছে নার্সারি।
এখানে এসি-ফ্রিজ মেরামত করার দোকান দিয়েছেন প্রকাশ সরকার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন এখানে উন্নয়ন নেই। এখনো প্লট বরাদ্দ সম্পূর্ণ হয়নি। তবে মেট্রোরেল চলাচলের পর বউবাজার নামে এ বাজার গড়ে উঠেছে। এখানে কাঁচাবাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করা যায়। আশা করছি এখন এখানে মানুষের বসতিও শুরু হবে।
Advertisement
আরও পড়ুন>> জুনের পর আগারগাঁও-মতিঝিল মেট্রোরেলের ট্রায়াল চলাচল
সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তরা উত্তর স্টেশনের ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ নম্বর সেক্টরে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে নাগরিক সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে গ্যাস, স্যুয়ারেজ লাইন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পানি ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা। রান্না-বান্নায় বাড়তি দামে কেনা সিলিন্ডার গ্যাসই ভরসা।
উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে কথা হয় মো. গোলাম ফারুকের সঙ্গে। তিনি বটতলা গোলচত্বরে মেসার্স রাজিয়া ইলেকট্রিক অ্যান্ড হার্ডওয়্যারের নামে দোকান খুলেছেন। গোলাম ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, উত্তরা তৃতীয় ফেজ এখনো বসবাসের যোগ্য হয়ে ওঠেনি। এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো, রয়েছে বিদ্যুৎ সুবিধা। এর বাইরে গ্যাস, ওয়াসার পানি ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা নেই।
মশার কামড়ে অতিষ্ঠ উত্তরা তৃতীয় ফেজের বাসিন্দারা জানান, এখানে দিনের চেয়ে সন্ধ্যার পর মশার উৎপাত কয়েকগুণ বেশি। রাতে মশার কয়েল জ্বালিয়েও নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকার নালাগুলো পরিষ্কার করলে হয়তো মশা থেকে নিস্তার পাওয়া যেত। নেই ময়লা-আবর্জনা ফেলার নির্ধারিত স্থান। যে যেখানে পারছেন, সেখানেই বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
জমে থাকা পানি থেকে জন্ম নিচ্ছে মশা। চারদিক ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। ছোট-বড় অসংখ্য নালা। এসব নালায় বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ির নোংরা পানি জমা থাকে।
আরও পড়ুন>> ৯ হাজার কোটির ভুতুড়ে আবাসনে আলো ছড়াবে মেট্রোরেল
মেট্রোরেল উত্তরা উত্তর স্টেশনের কাছে একটি বাসায় বসবাস করেন আমিনুল ইসলাম। তিনি নবনির্মিত একটি বাসার কেয়ারটেকার। মশার উৎপাত প্রসঙ্গে আমিনুল বলেন, শুধু রাত নয়, দিনেও মশা কামড় দেয়। কয়েল জ্বালিয়েও কোনো কাজ হয় না।
নেই কাঁচাবাজাররাজউক উত্তরা তৃতীয় ফেজ এলাকায় কিছু বসতি গড়ে উঠলেও কাঁচাবাজারের তেমন কোনো সু-ব্যবস্থা নেই। উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টর ও বউবাজারে কাঁচাবাজার গড়ে উঠলেও রাজউক থেকে দুদিন পর পর ভেঙে দেওয়া হয়। ফলে এসব এলাকার বাসিন্দাদের যেতে হয় উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের খালপাড় অথবা ১২ নম্বর।
মিরপুর ১৫ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা হোসেন সিকদার জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এখানে বসবাসের অন্যতম সমস্যা পর্যাপ্ত কাঁচাবাজার নেই। মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে খালপাড়ে যেতে হয় বাজার-সদাই করতে। রিকশা অথবা অটোভাড়া লাগে ৩০-৪০ টাকা। ২০ টাকার কাঁচামরিচ কিনতে অনেক সময় ৪০ টাকা করে দুবার ৮০ টাকা যাতায়াত ভাড়া দিতে হয়।
রিহ্যাবের সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ
যা বলছে রিহ্যাবউত্তরা তৃতীয় ফেজের প্লটগুলোতে দ্রুত সময়ে বসবাসের যোগ্য করার আহ্বান জানিয়েছে দেশের আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)।
রিহ্যাবের সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, রাজউক জমি অধিগ্রহণ করে যেভাবে বরাদ্দ দিলো তাতে কি মানুষ বসবাস করতে পারবে? এই প্রশ্ন আমার নয়, এটা প্লট বরাদ্দ পাওয়া মানুষের প্রশ্ন। আমার মনে হয় দু-চার বছরেও এখানে কেউ বসবাস করতে পারবে না। মেট্রোরেল চালু হয়েছে, কিন্তু বসবাস যোগ্য হয়নি উত্তরা তৃতীয় ফেজের প্লটগুলো। মেট্রোরেল সরকারের বিরাট একটা অর্জন। অথচ মেট্রোরেল যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে নেই নাগরিক সেবা। কোনো উন্নয়ন হয়নি। এখানে এক হাজার প্ল্যান পাস করা হয়েছে, কিন্তু কোনো নাগরিক সুবিধা নেই। এখানে স্কুল-কলেজ নেই, চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই, পানি নেই, গ্যাসও নেই।
তিনি আরও বলেন, যখন মেট্রোরেল নির্মাণের গুঞ্জন শুরু হয়, তখন উত্তরা তৃতীয় ফেজে প্রতি কাঠা জমির দাম ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ছিল। মেট্রোরেল চলাচল করছে, এখন জমির দাম এক কোটি টাকার নিচে নেই। এখানে প্রজেক্ট তৈরি হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমরা মেট্রোরেলের অর্জন ঘরে তুলতে পারছি না। রাজউক যে থার্ড ফেজ তৈরি করলো, নিজেদের ভবনের ফ্ল্যাটগুলোও বিক্রি করতে পারলো না। রাজউক হাজার হাজার প্লট বরাদ্দ দিলো অথচ কোনো লোককে সেখানে নিতে পারলো না। বরাদ্দ দেওয়া প্লট এখনো বসবাসের যোগ্য হয়নি।
আরও পড়ুন>> পূর্বাচলে ৬২ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা
রাজউক জানায়, প্রকল্পটি ২০১০ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে তিন দফা। প্রকল্প শুরুর সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৪৪ কোটি টাকা। দীর্ঘসূত্রতার কারণে আরও ২৯৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে পরে ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। একে একে ২৪টি বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ অনেক প্লট এখনো খালি। কিছু প্লটে আবাসনের বদলে নার্সারি তৈরি করা হয়েছে।
২০০৯ সালে এ প্রকল্পের একাংশে ‘উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প’ হাতে নিয়েছিল রাজউক। ২০১৬ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এটিও শেষ করতে পারেনি। কিছু ফ্ল্যাটে বাসিন্দা উঠলেও নাগরিক সুবিধা না থাকায় হতাশ তারা। তবে এই আবাসন এলাকায় নতুন করে আলো ছড়াচ্ছে মেট্রোরেল।
প্রকল্পের সাবেক পরিচালক হাফিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের প্লটগুলোতে ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে। সামনে আরও অনেক বেশি ভবন হবে। ১৮ নম্বর সেক্টরে ভবনের কাজ চলছে। বি ও সি ব্লকেও কাজ চলমান। আগামী বছর আরও প্লটে নির্মাণকাজ শুরু হবে। বাণিজ্যিক কিছু প্লট দেওয়া হয়েছে। সাতটি ব্লকে নির্মিত হয়েছে সাতটি টাওয়ার।
‘এছাড়া ওয়াসার একটি খাল নির্মাণ করা হয়েছে। খালের কারণে কিছু প্লট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলো রিপ্লেস করা হচ্ছে। কিছু কিছু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখন ফুল সুইংয়ে কাজ চলছে। মেট্রোরেলের কারণে প্লটে বেড়েছে আবাসনের গতি।’
আরও পড়ুন>> উত্তরা তৃতীয় পর্বের কাজ ২০১৬ সালের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ
তিনি আরও বলেন, কিছু কাজ এখনো বাকি। লেকের কাজ ৩০ শতাংশ বাকি। মোট প্লট ৮ হাজার ২৯৫টি। বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯৫ শতাংশ। প্রকল্পের ১০০টি প্লটে আবাসন নির্মাণকাজ চলমান। মেট্রোরেল উদ্বোধনের কারণে প্রকল্পের প্লটে আবাসন নির্মাণের মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। তবে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়নি, কারণ সরকার নতুন করে গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে না।’
এমওএস/এএসএ/জেআইএম