মতামত

প্রয়োজন গণতন্ত্রের ইতিবাচক চর্চা

কয়েক মাস ধরে দেশে একটা গণতন্ত্র গণতন্ত্র ভাবের উন্মেষ ঘটেছে। সে ভাবটা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। দেশের বৃহৎ বিরোধীদলীয় শক্তি পরপর নয়টি বিভাগীয় জনসমাবেশ করে এই ভাবটাকে অনেকটা চাঙ্গা করে তুলেছে। পাল্টাপাল্টি বড় বড় সমাবেশেও কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

Advertisement

দেশের গণতন্ত্রের জন্য এই চাঙ্গাভাব জাতিকে অনেকটা আশাবাদী করে তুলেছে। কিন্তু একটি দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হলে যাদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে শুরু হওয়ার কথা এই পরিস্থিতি তাদের ব্যাপকভাবে শঙ্কিত করে তোলায় হঠাৎ করে এই গতিতে ছেদ শুরু হওয়ার উন্মত্ত ঢেউ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

যারা গণতান্ত্রিক ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে এই ঢেউকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন তারা অনেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন কোনো কিছুতেই মানুষের চোখ এড়ানোর উপায় নেই। ৩০ বছর আগেও কোনো তথ্য পেতে পরবর্তী দিনের পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতে হতো। নয়তো শুধু গোলাম-বিবির বাক্সের কিছু নির্বাচিত বয়ানের ওপর নির্ভর করতে হতো। এখন সেসব যুগের অবসান হয়েছে। এখন কারও ফাঁকা বুলিকে কেউ পাত্তা দিতে চায় না।

কারও মিথ্যা, হাম্বরা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা আস্ফালনকেও গুরুত্ব দেয় না। এধরনের কিছু করা হচ্ছে বুঝে ফেললেই মিনিটেই ভিন্ন দশ চ্যানেল পাল্টিয়ে ফেলে আসলটা খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। সেটাও না পেলে বিভিন্ন মুখবইয়ের পাতায় নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মনের ক্ষোভ মেটানোর চেষ্টা করে। এতে সেখানে তার মতো হাজারো সত্যান্ধনুসারীর দেখা মেলে। অনলাইন পরিচিতিতে গঠিত হয়ে যায় নতুন পথের দিশা। ডিজিটাল যুগের এই সুবিধা গ্রহণ করে মানুষ অন্যায়-অসত্যটাকে ছুড়ে ফেলে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

Advertisement

আজকাল মানুষ কোনো কিছু শুধু শুনেই ক্ষান্ত হয় না। শোনার সাথে বাস্তব চিত্র দেখে সেটার পেছনে প্রমাণ হাজির করে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট হয়। বাস্তবতার মধ্যে গড়মিল বা জালিয়াতি পেলে সেটাকে বর্জন করে। আন্তজাল তথ্যপ্রবাহে দেখার এ যুগের গণমানুষেরা তাদের কার্যকলাপ দেখে অতি সহজেই তাদের চিহ্নিত করতে পেরেছেন। এতে অচিরেই তাদের অবৈধ আয় ও সুযোগ প্রাপ্তির দুয়ার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এজন্য তারা বেশি আতঙ্কিত হয়ে আরও বেশি বেশি কুপরামর্শ দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার হরণে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

জনগণ এদের খালি চোখে দেখতে পায় না বলে এদের অস্তিত্বই খুঁজে পায় না। আর জনগণ এদের খুঁজে পায় না পাওয়ার আরেকটি কারণ হলো- আসলে এদের কোনো দায়বদ্ধতা ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার বালাই নেই।

তাই জনগণ বিভিন্নভাবে হোঁচট খেতে খেতে নানা দুঃখ-কষ্ট ও পেটের ক্ষুধায় নিরুপায় হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হতে থাকলেও সেসব মেধাবী কুপরামর্শকরা চিরদিন অধরা থেকেই যায়। তারা যেটা প্রকাশ ও প্রচার করে তার সাথে সমাজের বাস্তবতা ভিন্ন হওয়ায় জনরোষের আতঙ্কে সবসময় ভুগতে থাকে।

এজন্য জনরোষের বার্তা ঠেকাতে গণজমায়েত পণ্ড করতে শুরু হয় নানা অপকৌশল। ঘন ঘন পরিবহন ধর্মঘট, রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বা তল্লাশি করে হয়রানি, মিথ্যা মামলার নাটক সাজিয়ে গ্রেপ্তার ও জেলখানায় প্রেরণ এগুলো স্বৈরাচারের নবরূপ ছাড়া আর বিশেষ কিছু কি?

Advertisement

দেশের বৃহৎ বিরোধীশক্তি পরপর নয়টি জনসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করেছে। সেগুলোতে কোন বিশৃঙ্খলা হয়নি তবুও কেন এত বেশি উৎকণ্ঠা ছিল? এজন্য সর্বশেষ রাজধানী ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশ করতে গিয়ে বিরোধীরা অনেকটা হোঁচট খেয়েছে। শাসক দলের ইঙ্গিতে পুলিশি বাধার সন্মুখীন হয়ে তাদের জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছে ব্যাপকভাবে।

মানুষ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চায়। তারা এর মাধ্যমে একটি কল্যাণরাষ্ট্র তৈরি হওয়ার পথকে প্রশস্ত করতে চায়। মানুষ তাদের অপূরিত মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ করতে চায়। যেহেতু অভাবের ঐতিহাসিক তত্ত্ব বলে যে মানুষের গণদারিদ্র্যকে একবারেই নির্মূল করা অসম্ভব তাই একটি উন্নয়নকামী দেশে বাস করে কোনোরকমে একটি কাম্য জীবনমান পেতে চায়।

চিরঅভাবীরা ক্রমাগত ব্যাপক আয়বৈষম্যের মধ্যে বসবাস করে নিজের হতদরিদ্রকে কমাতে চায়। এজন্য তারা কাজ করে নিজেদের ক্রয়ক্ষমতাকে বাড়াতে চায়। ন্যূনতম পুষ্টিমান, ন্যূনতম স্বাস্থ্যকর বাসগৃহ, কাপড় ও বাক সুবিধা পেতে চায়। আর এজন্যই কয়েক মাস ধরে অনুষ্ঠিত নয়টি বৃহৎ সমাবেশ ও এর জবাবে আরও অনেকগুলো জনসমাবেশ খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

কিন্তু হঠাৎ করে ২০ হাজার পুলিশ, পৌনে পাঁচ হাজার আনসার ও অগণিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করে আতঙ্কের আবহ তৈরি করে একটি বিভাগীয় জনসমাবেশ ঠেকিয়ে দেশের এই গণতান্ত্রিক আবেশ অর্জনের পথ সংকুচিত করে তোলার হেতু কি ছিল? সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ তো কোনো পুলিশি রাষ্ট্র নয়!

একটি দেশে যত বেশি গণসমাবেশ হবে ততই মানুষ জেগে থাকবে, সচেতন হবে। মানুষ সচেতন হলে অপরাধ কমে যায়। সাধারণ মানুষ নিজেরা আঘাত না পেলে কখনও//// মব হয়ে উঠে না অথবা উচ্ছৃঙ্খতা প্রদর্শন করে না। তাই তাদের চাপে ফেলে সেদিকে জোর করে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা করা দেশের জন্য অমঙ্গলজনক।

আমাদের দেশে গণতন্ত্র গণতন্ত্র ভাবের যে ইতিবাচক আমেজ তৈরি হয়েছে তা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচণের মাধ্যমে আরও সুদৃঢ় হোক এটাই সবার কামনা হওয়া উচিত। সেটা আদতে বাস্তবায়িত হলে পেশাদারি ‘হোয়াইট কালার ক্রাইম’ ও পেশিশক্তির বাহাদুরি কমবে। অবৈধ নিয়ম-কানুন, উপরি কামাই বা ঘুস, দুর্নীতি, জালিয়াতি, মাদকাসক্তি, আয়-বৈষম্য ইত্যাদি অতি দ্রুত কমে যাবে।

তাহলে সব মানুষ নতুন আধুনিক গণপরিবহন মেট্রো রেলে চড়ার সুযোগ বা অধিকার না পেলেও বা সবাই দামি রেস্তোঁরায় একবেলা বসে খেতে সাহস না করলেও নিজ ঘরে দু’বেলা পেটপুরে খেতে তো পারবে, একটি শেডের নিচে সারা রাত ঘুমাতে তো পারবে, চিকিৎসকের কাছে যেতে সাহস তো করতে পারবে। আর এতে আমাদের মেগা প্রজেক্টগুলোতে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করার সার্থকতা ফুটে উঠেবে। সেগুলোর উপকারভোগী দেশের সব মানুষ। বেকার ও স্বল্পআয়ের মানুষের জন্য বিনা টিকিটে গণপরিবহন মেট্রোরেলে চড়ার সুযোগ আছে কি? আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই যেন সেই জোছনা উপভোগ করতে পারে, সেটাই গণতন্ত্র।

সেজন্য প্রয়োজন একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও সেখানে ক্রমাগতভাবে গণতন্ত্রের ইতিবাচক চর্চ্চা। এছাড়া এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অস্তমিত আবহে পৃথিবীর অপরাপর মানুষ যখন পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের কথা ভাবছে তখনও আমরা নিজেরা অহেতুক ফ্যাসাদ করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলছি।

গত ২৮ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর জামানত হারানো কি তাদের জন্য বড় ইঙ্গিত নয়? বড়রা অতি বেশি হাম্বরা হলে ছোটরা বেয়াড়া হয়ে যায়। পরস্পরকে এ নিয়ে জরুরিভাবে ভাবার অবকাশ রয়েছে। অন্যথা পারস্পরিক অসহিষ্ণুতায় শুধু শোনার সাথে সাথে দেখার যুগে পদার্পণ করেও এখনও আমাদের গণতন্ত্র গণতন্ত্র ভাবের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/ফারুক/এমএস