রফিকুল ইসলাম জসিম
Advertisement
কাং খেলা একসময়ে ছিল মণিপুরিদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। মণিপুরিদের নববর্ষের মণিপুরি পাড়াগুলোতে এই খেলার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত।
কাং খেলার জমজমাট আয়োজন উপভোগে দুর দূরান্তে ছুটতো মানুষ। মণিপুরিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাং খেলা প্রতিযোগিতা ঘিরে জমে উঠত উৎসব।
আরও পড়ুন: ১৪ দিন ধরে চলে তেলেগুদের বিয়ের আয়োজন
Advertisement
এই খেলা বাদ দিয়ে মণিপুরি ঐতিহ্যের পূর্ণতা কল্পনাও করা যেত না। তবে কয়েক বছর যাবত তথ্য প্রযুক্তির কারণে বাস্তবতায় বাংলাদেশে এই খেলা ক্রমশ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
বাংলাদেশ মণিপুরী কাং ফেডারেশনের মাধ্যমে কাং খেলার পুনরুজ্জীবন ঘটানোর প্রয়াসে এখন চেষ্টা করছেন সেই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে।
কং খেলার উৎপত্তি
প্রাচীনকাল থেকেই মণিপুরী সমাজে কাং খেলার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতের মণিপুরে রাজত্বকারী রাজা লোইতোংবার শাসনামলে এই ‘কাং’ খেলার উদ্ভব ঘটে।
Advertisement
আরও পড়ুন: বরের জুতা চুরি
তবে প্রচলিত মিথ অনুযায়ী তারও অনেক আগে দেবতা মারজিং এর নেতৃত্বে দেবতাদের মধ্যে এই খেলা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে উনবিংশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা চন্দ্রকীর্তি কাং খেলাকে সর্বজনগ্রাহ্য একটি রূপ দেন।
তিনি কাং খেলার নিয়ম, কাং এর সাইজ ও ডিজাইন, কাং খেলার কোর্ট সমস্ত কিছুতে প্রয়োজনীয় নীতিনিয়ম প্রণয়ন করে খেলাটিকে সার্বজনীন করে তোলেন।
‘কাং’ খেলার উপকরণ
বিধি-বিধান আর নীতি-নিয়ম যুক্ত হয়ে কাং খেলা একটি আধুনিক ক্রীড়ার রূপ পরিগ্রহ করে। কাং খেলার প্রধান উপকরণ ‘কাং’ হিসেবে ব্যবহৃত হয় হাতির দাঁত, কচ্ছপের বুকের খোল, মহিষের শিং দিয়ে তৈরি কাং।
১৮৫১ সালে মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তি সিংহ মণিপুরের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি কাং খেলার জন্য নির্দিষ্ট কোর্ট তৈরি করা, দল গঠন প্রক্রিয়া ও খেলার নিয়মাবলী সুনির্দিষ্ট করে এই খেলাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
কাং খেলা ছড়িয়ে পড়ে মণিপুরের সর্বত্র, এমনকি মণিপুরের বাইরে মণিপুরী অধ্যুষিত সব অঞ্চলে। সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত কাং খেলার নিয়মাবলীতে বা কাং হিসেবে ব্যবহৃত ক্রীড়া উপকরণের আকার বা প্রকৃতিতেও কিছু কিছু ভিন্নতা দেখা দেয়।
কাং খেলার নিয়ম
কাং খেলায় প্রতিটি দলে ৭ জন করে খেলোয়াড় থাকেন। পুরুষ ও মহিলা যৌথ দল হতে পারে। পৃথকও দল গঠন করা যায়। ৭টি সরলরেখায় উভয় দলের ৭ জন করে খেলোয়াড় পরষ্পরের বিপরীতে থাকেন।
দু’জন আম্পায়ার খেলা পরিচালনা করেন। ক্রিকেট খেলার স্কোরবোর্ডের মতো কাঙেও স্কোরবোর্ড থাকে। মসৃণ কোর্টে কাং (এক ধরনের ফাইবারের তৈরি প্লেট) বিপক্ষের খেলোয়াড়দের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়।
কাং খেলার ঘর ‘কাংশং’
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলাধীন আদমপুর ইউনিয়নের নয়াপত্তন গ্রামে অবস্থিত ‘কাংশং’ (কাং খেলার জন্য নির্ধারিত মণ্ডপ জাতীয় বিশাল হল ঘর)। সেখানে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতি বছরের মতো এবারেও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বাংলাদেশ মণিপুরি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী কাং টুর্নামেন্টে আয়োজন করে বাংলাদেশ মণিপুরি কাং ফেডারেশন।
কাং খেলার স্বীকৃতির দাবী
বাংলাদেশ মণিপুরি কাং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ইবুংহাল সিংহ শ্যামল ও নিংতম কাং টুর্নামেন্ট ২০২১ এর সদস্য সচিব আওয়াংতাবম সমরেন্দ্র বলেন, এ বছর নিংতম কাং টুর্নামেন্টে মণিপুরি সম্প্রদায়ের চালু রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি।
তবে পাড়ায় পাড়ায় মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী খেলা হারিয়ে গেছে। এগুলো কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সেজন্য আমাদের কিছু পরিকল্পনা আছে।
মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী কাং খেলা বাংলাদেশের বাইরে ও ভারতের আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মণিপুর রাজ্যেও মণিপুরি সম্প্রদায়ের এই খেলাটির প্রচলন আছে। খেলাটি পরিচিতি পেয়েছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশেও।
ঐতিহ্যবাহী কাং খেলাকে আন্তর্জাতিক বলয়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে মণিপুরি কাং ফেডারেশনের সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছেন।
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
জেএমএস/জেআইএম