ফিলিপিন্স, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন গ্রীষ্ম-মন্ডলীয় দেশের সাগরের প্রবাল দ্বীপে, জলা-জঙ্গলের গাছে ‘কোন শেল’ নামে খুনি বা খুনে শামুকের বাস। এ শামুকগুলো ওঁৎ পেতে থাকে শিকারের সন্ধানে। ৫০০ প্রজাতির খুনে শামুকের মধ্যে দু’টো প্রজাতি খুবই ভয়ংকর। এদের কামড়ে মাছতো কোন ছার, ’মানুষের প্রাণ পর্যন্ত সংশয় হতে পারে। এই শামুকরা বিষাক্ত পোকা-মাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। তবে কখনো কখনো আবার নিজেদের জাত ভাইদেরও খেতে কসুর করেনা। কোনো কোনো খুনে শামুকের প্রধান খাবার হচ্ছে মাছ। মাছ শিকার এবং গলাধ:করণ কাজটি ওরা সারে অত্যন্ত সুচারুভাবে।
Advertisement
এই শামুকগুলো লম্বা টিউবের মত একটি বিষাক্ত নল বের করে দেয় মুখ থেকে। বোকা মাছ বা কীটপতঙ্গ ওটাকে খাবার ভেবে গপ করে গিলতেই বেঁধে যায় বিপত্তি। বর্শার মত নলটা গেঁথে যায় মাছের শরীরে। প্রচন্ড বিষে মুহূর্তে আক্রান্ত হয় মাছ। হয় তাৎক্ষণিকভাবে মারা যায় নচেৎ বর্শা বিদ্ধ হয়ে প্যারালাইসিস রোগীর মত অসহায়ভাবে ঝুলতে থাকে। অনেক সময় শিকার আয়তনে বড় হলেও খুন করতে কসুর করে না এই খুনে শামুক। এই শামুক নলের ডগায় বিদ্ধ শিকারকে টেনে নিয়ে আসে মুখের কাছে। তারপর শুরু হয় ভোজন পর্ব। কয়েক ঘণ্টা পর শিকারের হাড় এবং কঙ্কাল উগরে দেয় মুখ থেকে। ততক্ষণে বাকি সব হজম হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: তীক্ষ্ণ চোখের ৯ ফুটের সাগর ঈগল
সম্প্রতি ওষুধ তৈরির কাজে এই খুনে শামুকের বিষের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। পোকা-মাকড় বা মাছের জন্য যা ক্ষতিকর, কখনো কখনো মানুষের জন্য তাই-ই উপকারী। বেশিরভাগ বিষাক্ত প্রাণীর শরীরের টক্সিন বা জৈব বিষের মাত্রা থাকে খুবই কম। কিন্তু ‘কোনশেল’ বা খুনে শামুকদের শরীরের এই টক্সিনের পরিমাণ প্রচুর। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, শামুকের এই বিষ ব্যবহারে যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা, মস্তিষ্কের ভয়ানক ক্ষত, ব্রেন স্ট্রোক ইত্যাদি ঠেকানো এবং উপশম করা সম্ভব। এছাড়াও কুষ্ঠরোগ, ডিপ্রেশন এবং সিজোফ্রেনিয়া রোগের মহৌষধ এই প্রজাতির শামুকের বিষ। খুনে শামুকের বিষের এমন ব্যবহার জেনে এটাকে বর্তমানে ‘ডাক্তার শামুক’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিগুলো রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু করেছে কোন শেলের বিষ ব্যবহার করে কে কত নতুন ওষুধ আবিষ্কার করতে পারে। পাশাপাশি সবাই বস্তা ভরা টাকা হাতে লাইন দিয়ে বসে আছেন গবেষণাগারের দরজায়। শামুক থেকে কে কখন কোন টক্সিন আবিষ্কার করে ফেলেন আর তার স্বত্ব কিনে নেবে ওষুধ কোম্পানিগুলো।
Advertisement
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ রাজ্যের সল্টলেক সিটির ‘ইউনিভার্সিটি অব ইউটাহ’র ল্যাবরেটরির গবেষকরা দেখেন, এই শামুকের বিষ গোখরো সাপের বিষের চেয়েও মারাত্বক শক্তিশালী। এই বিষ শরীরে ঢুকলে মৃত্যু নিশ্চিত। প্রথমে পেশী সব অসাড় হয়ে যায়। তারপর বন্ধ হয়ে যায় রক্ত চলাচল। ফলাফল মৃত্যু। আবার কিছু খুনে শামুকের বিষ জাপানি ফুগুপাফা মাছের মতো। এর বিষে শিকারের শরীরে সোডিয়াম আয়নের প্রবাহটুকু বন্ধ হয়ে যায়। যদিও বিষের কারণে প্রাণীর শরীর অসাড় হওয়ার ঘটনা নতুন কিছু না। তবে গবেষকদের কাছে ‘কোনশেল’ এর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ এদের বিষে অ্যামিনো অ্যাসিড চেইনের পরিমাণ কম। একটি গোখরো সাপের বিষে যেখানে অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিমাণ ষাট থেকে আশি, একটি মাকড়সার অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিমাণ যেখানে এক হাজার সেখানে এই শামুকের অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিমাণ সবচেয়ে কম। নিচে দশ উপরে ত্রিশ। অ্যামিনো অ্যাসিড শরীরে কম থাকার সুবিধা হলো, এতে সংশ্লেষণ করা যায় দ্রুত। টক্সিন লেভেল কম থাকায় এই ধরনের শামুকের বিষ ওষুধ হিসেবে কাজে লাগে। যে সব রোগী মরফিন, পেথিডিন ইত্যাদিতে সাড়া দেয় না বা ড্রাগ রি-অ্যাকশন হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই কম টক্সিন লেভেলের বিষ ব্যবহার করে দ্রুত আরোগ্যলাভ সম্ভব।
বিষাক্ত খুনে শামুকদের টক্সিন ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যাচ্ছে ব্যাপক। যেমন আমেরিকার ড্রাগ কোম্পানি ওর্য়ানার ল্যামবার্ট জানায়, এই টক্সিন ব্যবহারের ফলে রোগীর স্ট্রোক বা সিরিয়াস হেড ইনজুরির মাত্রা হ্রাস পেয়েছে আশাব্যাঞ্জকভাবে। বিজ্ঞানী অলিভেরা মনে করেন, খুনে শামুকের বিষ দিয়ে কুষ্ঠরোগও একদিন পুরোপুরি সারানো যাবে। এমনকি এইডস এবং ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য ব্যাধি দূর করার কাজেও এই টক্সিনটি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন গবেষকরা। এখন দরকার এ বিষয়ে আরও ব্যাপক গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
আরও পড়ুন: ফ্যান ধীরে ঘুরলে কি বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়?
বিশ্বে যদিও সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরাই এই খুনে শামুক থেকে বিষ আলাদা করার কাজে সফল হন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এই বিষকে এরইমধ্যে রোগ নিরাময়ের কাজে ব্যবহার শুরু করেছেন। সম্প্রতি ‘ন্যাচার’ সাময়িকী জানিয়েছে, ইউটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অলিভেরা এই বিষ ইঁদুরের দেহে প্রয়োগ করে ভিন্নতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছেন। কিছু ইঁদুর ঘুমিয়ে পড়ে। বাকিগুলোর মাথা ঝাকানো, দৌড়াদৌড়ি, প্রাণ চাঞ্চল্য আরও বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা প্রত্যাশা করছেন, খুনে শামুকের বিষ ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথির চিকিৎসায় কাজে লাগানো যাবে। এমনকি মৃগী রোগীকেও সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে খুনে শামুকের বিষ দিয়ে। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল কেমিস্ট্রির গবেষকরা ‘সায়েন্স ডেইলি’কে জানান, রোগ নিরাময়ে এটি হাজারগুণ বেশি কার্যকর। তদুপরি এটি মরফিন, হিরোইন বা আফিমের মত আসক্ত করে তোলে না। মানে এই ওষুধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু খুনে শামুকের বিষের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এজন্য এই কনোটক্সিন বিষ এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) অনুমোদন দিয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা নিরাময়ে এটি সরাসরি মেরুদণ্ডে ইনজেকশন আকারে দেওয়া হচ্ছে।
Advertisement
তবুও গবেষকদের সতর্ক পরামর্শ-ডাক্তারের কাছে বিপদজনক অবস্থায় যেতে না চাইলে, যতই সুন্দর দেখা যাক না কেন কোনশেল এড়িয়ে চলুন। কারণ এর ভয়ানক বিষ আপনার তাৎক্ষনিক মৃত্যু ঘটাতে পারে। তাই সাগরের উপকূল বা জলা-জঙ্গলে বেড়াতে গেলে প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানতা ও সচেতনতার সঙ্গে ফেলুন। এই খুনে শামুকের দৃষ্টিনন্দন খোলক বা খোসা সংগ্রহ করতে ইচ্ছে হলেও খুব সাবধানে স্পর্শ করুন। শখ করে বা অতি সাহস করে কোনশেল বা খুনে শামুক ধরবেন তো, হাত-পায়ে এই শামুকের নড়াচড়াই হয়তো হতে পারে আপনার হাত-পায়ের শেষ নড়াচড়া।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।
কেএসকে/এএসএম