জাতীয়

করোনায় বিশ্বে সবচেয়ে নিরাপদে ছিলেন কৃষকরা

করোনার প্রাদুর্ভাবের সময় বিশ্বে যখন একের পর এক মৃত্যু হচ্ছিল, তখন সবচেয়ে বেশি নিরাপদে ছিলেন কৃষকরা। তাদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন কম। গবেষণায় দেখা যায়, এসময় বিশ্বের ৯৯ শতাংশ কৃষক ও খামারিরা ছিলেন নিরাপদে। তবে কৃষকদের মধ্যে যারা করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে ছিলেন। যুবকরা কম আক্রান্ত হয়েছেন।

Advertisement

গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি এক হাজার করোনা আক্রান্ত কৃষক বা খামারির মধ্যে মারা গেছেন গড়ে মাত্র সাতজন। বাকি ৯৯৩ জনই বেঁচে ফিরেছেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। বুধবার (১১ জানুয়ারি) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস সম্মেলন কক্ষে এ সেমিনার হয়।

বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. কাজী ইকবালের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. আননিস চৌধুরী। তিনি তার রচিত ‘নুগেট ইন টু লকডাউন? বিহেভিয়ারাল ইকোনমিস, আনসার্টিনিটি অ্যান্ড কোভিড-১৯’ শীর্ষক বই থেকে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: করোনা নিয়ে ১১ মাস আগেই সতর্ক করেছিলেন উহানের গবেষক

তার গবেষণায় বলা হয়, কোভিডের সময় বেশি সমস্যা হয়েছে উন্নত দেশগুলোতে। যাদের সবারই যে কোনো মহামারি নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কারো পরিকল্পনাতেই ছিল না লকডাউন।

ড. আননিস চৌধুরী বলেন, কোভিডে লকডাউনে কারোই তেমন লাভ হয়নি। সুইজারল্যান্ড কোনো লকডাউন দেয়নি, তারাও মৃত্যু ঠেকিয়েছে। ব্রিটেনে যারা কোভিডে মারা গিয়েছেন তারা অধিকাংশই ঘরে ছিলেন। সুইডেনে যারা মারা যান তারাও বেশিরভাগ ঘরেই ছিলেন।

তার মতে, প্রথম দিকে স্বল্প মেয়াদে লকডাউন ছিল। তখন বোঝা যাচ্ছিল না যে কোথা থেকে কি হচ্ছে। কিন্তু যখন সব কিছু পরিষ্কার হলো, তখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লকডাউন দেয়। এর ফলে বন্ধ হয়ে যায় সব কার্যক্রম। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং শিক্ষায় ক্ষতি হয়েছে, যা পূরণ হতে লাগবে দুই প্রজন্ম।

Advertisement

ড. আননিসের গবেষণায় বলা হয়, লকডাউন যে জীবন রক্ষা করতে পারেনি তার উদাহরণ হচ্ছে ইউরোপের ২৪টি দেশে কঠিন ও হালকা লকডাউন। কিন্তু সেসব দেশে মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুও কমে গেছে। লকডাউনের কারণে অনেক সুযোগ নষ্ট হয়েছে। সেগুলোর দিকে নজর দেওয়া হয়নি। নীতি নির্ধারকদের এটা বোঝার দরকার ছিল যে সম্পদ সীমিত।

তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী যে মূল্যস্ফীতি তা শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বেড়েছে সেটি নয়। এর পেছনে করোনার জন্য নেওয়া উদ্যোগগুলোর প্রভাবও দায়ী।

আরও পড়ুন: রাজধানীর ড্রেনের পানিতে করোনার জীবাণু

করোনা টিকা প্রসঙ্গে এই গবেষক বলেন, দুই থেকে চার ডোজ টিকা নিয়েও অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাহলে টিকার পেছনে এত সম্পদ ব্যয় করার দরকার কি ছিল?

গবেষণার মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, ১৯১৩-১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা গিয়েছিল ২১৯ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন মানুষ। আর ২০১৯-২০ সালে কোভিডে মারা গেছে ৬ দশমিক ৩১ মিলিয়ন মানুষ। তাহলে দেখা যাচ্ছে স্প্যানিশ ফ্লুর চেয়ে কোভিড কোনোভাবেই বড় দুর্যোগ ছিল না। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, স্প্যানিশ ফ্লুতে সব বয়সের মানুষই মারা গিয়েছিল, আর কোভিডে একটু বয়স্ক মানুষই বেশি মারা গেছেন।

প্রবন্ধে আরও বলা হয়, ১৯৫৭ সালের এশিয়ান ফ্লুতে মারা যায় ৪ দশমিক ৮১ মিলিয়ন মানুষ। ১৯৬৮ সালের হংকং ফ্লুতে মারা যায় ২ দশমিক ১৮ মিলিয়ন মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে কোভিড-১৯। আরও বলা হয়েছে করোনা মহামারির আগেও অন্যান্য রোগসহ স্বাভাবিক মৃত্যুও বিশ্বব্যাপী কম হয়নি। হিসাব করলে দেখা যায়, কোভিডের চেয়েও সেসব মৃত্যু ছিল অনেক বেশি।

মহামারি চলার সময় বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার, কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগেও মানুষ মারা গেছেন বলে গবেষণা বলা হয়। এতে বলা হয়, এসব রোগের সঠিক চিকিৎসা ছিল না। এদিকে এসব মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমসহ সবার মাঝে খুব বেশি আলোচনায় ছিল ন। সবাই ব্যস্ত ছিলেন কোভিডের মৃত্যুর হিসাব নিয়ে।

আরও পড়ুন: চীনে বাদুড় নিয়ে গবেষণা চালানোর চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ

ইংল্যান্ড ব্যাংকে কর্মরত অর্থনীতিবিদ ডেভিড মাইলসের উদাহরণ দিয়ে গবেষণার প্রবন্ধে বলা হয়, চার লাখ ৪০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে যদি ৯ শতাংশ জিডিপির ক্ষতি হয়, তাহলে ইংল্যান্ডের ক্ষতি হবে ৬৮ বিলিয়ন পাউন্ড। আবার মাত্র ২০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে যদি ৯ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হয় তাহলেও ক্ষতি হবে ১৯৪ বিলিয়ন ডলার। যদি ২০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে ১৫ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হয়, তাহলে নীট ক্ষতি হবে ৩২৪ বিলিয়ন পাউন্ড। সুতরাং ক্ষতির বিষয়গুলো মাথায় নেওয়ার দরকার ছিল।

ড. কাজী ইকবাল বলেন, কোভিডের সময় দেশগুলোর রাজনৈতিক চিন্তা হলো সরকার জনগণের জন্য কিছু একটা করছে। এটা দৃশ্যমান কিছু। যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে সরকার তাদের পাশে আছে। তবে যদি নির্ধারণ পর্যায়ে তরুণরা থাকতো তাহলে হয়তো এত লকডাউন হতো না।

এমওএস/জেডএইচ/