মতামত

বাগদাদ বেশি দূরে নয়!

কয়েকদিন ধরে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখে মনে হচ্ছে দেশে মাহফুজ আনাম ছাড়া আর কোনো খবর নেই। মঙ্গলবার একরাতেই অর্ধডজন চ্যানেল এই এক মাহফুজ আনামকে নিয়ে আলোচনা করলো। আরো কত খবর যে আছে সেই খবর কে রাখে? এরই মাঝে একটি খবর চোখে পড়লো, সেটি হলো আমাদের জীবনযাত্রার মানের খুবই খারাপ দশা। যদিও কোনো টেলিভিশন চ্যানেল এই ইস্যুতে টকশো করতে আগ্রহী নয়, কারণ এতে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কথা বলা হয়ে যাবে, যা কিনা তারা সযত্নে এড়িয়ে চলে। যা-ই হোক খবরটি খারাপ হলেও সত্যি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জরিপ প্রতিষ্ঠান মার্সার প্রকাশিত ‘কোয়ালিটি অব লিভিং র্যাং কিং ২০১৬’ শীর্ষক সমীক্ষায় দেখা গেছে বিশ্বের ২৩০টি শহরের মধ্যে জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান ২১৪তম।  জরিপে জীবনযাত্রার মান নির্ধারণে শহরে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এই জরিপের পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা নিরপেক্ষ সূত্র দ্বারা যাচাই করতে পারিনি।ঢাকাবাসীর জীবনযাত্রার মান যদি এত খারাপই হয় তাহলে বিশ্বব্যাংক যে বলল, বাংলাদেশ নিম্নবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত হয়েছে। আর সেটা ঘটা করে আমরা বলা শুরু করলাম। প্রচারযন্ত্রগুলোও খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। টকশো চললো কয়েকদিন। যেমনটা চলছে এখন মাহফুজ আনাম ইস্যুতে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখলাম না বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে হয়ে উঠলেও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান আসলে বাড়ল কিনা? যেমনটি এখনো আমরা কনফিডেন্টিল মিথ্যা বলার মাধ্যম টকশোতে যে যা বলছে তা আদৌ সত্যি কিনা সেটি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্টলি ভেরিফাই’ করে দেখি না।  মার্সার জরিপটি মঙ্গলবার তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের জরিপে জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে সবার ওপরে আছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। আর জরিপ অনুয়ায়ী, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সবচেয়ে কম ইরাকের রাজধানী বাগদাদে, জীবনযাত্রার মানও সবচেয়ে কম। শহরটির অবস্থান ২৩০তম। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দিক থেকে ২২৯তম, তবে জীবনযাত্রার মানে ২২৪তম। দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থান শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর। এর পরে রয়েছে ভারতের কয়েকটি শহর এমনকি কলকাতাও। পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, লাহোর ও করাচির অবস্থানও ঢাকার চেয়ে অনেক উপরে। সবচে খারাপ বাগদাদ থেকে ঢাকার দূরত্ব কেবল ১৬টি শহর। জরিপে মূল্যায়িত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যে ব্যাংকিং সুবিধা ও মুদ্রা বিনিময়ে শর্ত, সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে গণমাধ্যমের উপস্থিতি ও বিধিনিষেধ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, স্কুল ও শিক্ষা, গণপরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা, বিনোদন, গৃহায়ণ ও আবাসনব্যবস্থা এবং শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ। অর্থনীতির সাধারণ জ্ঞানে, জীবনযাত্রার মান সাধারণত মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকা বা স্থিতিশীল থাকা, গড় আয়ু বাড়া, জন্ম ও মৃত্যু হার কমা, কর্মসংস্থান বাড়া, আবাসিক সমস্যা না থাকা এবং মুক্ত ও স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ বাড়লেই জীবনযাত্রার মান বাড়ছে বলে ধরে নেয়া হয়। এসব সূচকে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু আমরা খোঁজ নেয়নি এদেশে গরিব আরও গরিব হয়েছে। ধনী আরও ধনী হচ্ছে। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার বিষয়টি আসলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক নয়, সেটি আসলে গড় আয়বর্ধক একটি সূচক। এই সূচকে অনুযায়ী আমার ঢেকুর গিলছি এই ভেবে যে ২০২১ সালের মধ্যে আমরা উচ্চ মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছে যাবো। মুক্ত ও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের মাধ্যমে উন্নয়নে প্রভাব সৃষ্টি করাও যে জীবনযাত্রার মান বাড়ার সাথে সম্পর্কিত সেটি বোধ হয় আমরা ভুলেই গেছি। বর্তমানে যেভাবে গণমাধ্যম চলছে একই অবস্থা চলতে থাকলে সব সূচকে অগ্রগামী হলেও এই ইস্যুতে সর্বনিন্মে নেমে যাবো হলফ করেই বলতে পারি। ২০২১ সালে হয়তো টকশো হবে সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে বলেই আমরা কিছুদিন পর উন্নত দেশের ধাপে ওঠে যাবো। শিগগিরই আমরা ভিয়েনাকে ছাড়িয়ে যাবো। আর আন্তর্জাতিক কোনো জরিপ সংস্থা হয়তো বলবে জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে আরো পেছালো বাংলাদেশ। আমরা ওই খবরটি প্রচার করবো না। টকশোতে আলোচনাও হবে না। এইচআর/পিআর

Advertisement