নতুন বছরের প্রথম কূটনৈতিক সফরে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফ্রিকায় যাওয়ার রীতি চলে আসছে প্রায় ৩২ বছর ধরে। দেশটির নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং ২০২৩ সালেও এই ধারা অব্যাহত রাখার কথা ছিল। তিনি ৯ থেকে ১৬ জানুয়ারি ইথিওপিয়া, গ্যাবন, অ্যাঙ্গোলা, বেনিন, মিশর, আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর দপ্তর ও আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রধান কার্যালয় সফর করবেন, এমনটাই নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ইথিওপিয়ায় পৌঁছানোর আগে কিন আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশে যাত্রাবিরতি করেন।
Advertisement
গত সোমবার (৯ জানুয়ারি) মধ্যরাতে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বহনকারী উড়োজাহাজ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এসময় বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এরপর দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বৈঠক হয়।
আরও পড়ুন>> ঢাকায় যাত্রাবিরতিতে মোমেনের সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটিকে ‘টেকনিক্যাল স্টপওভার’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তারা বলেছে, ‘বৈঠকে দুই পক্ষ চীন-বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করেছে এবং নতুন বছরে লেনদেন জোরদার করতে ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন অগ্রগতির জন্য যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।’ তবে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে এর বেশি কিছু জানানো হয়নি।
Advertisement
মার্কিন সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাটের দৃষ্টিতে, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অপ্রত্যাশিত ঢাকা সফরটি বেশ অদ্ভুত ছিল। কারণ প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম দিকে আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে চীনের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের বিরোধী এটি। সেই জটিলতা এড়ানোর চেষ্টায়ই হয়তো চীন ও বাংলাদেশ উভয়েই জোর দিয়ে বলেছে, এটি কোনো ‘অফিসিয়াল’ সফর ছিল না। এটি নিছক ‘যাত্রাবিরতি’।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও কিন গ্যাং। ছবি: সংগৃহীত
কিন্তু তার পরও এটি সত্য যে, নতুন বছরে কিনের প্রথম ব্যক্তিগত বৈঠক, কার্যত দায়িত্বগ্রহণের পর তার এ ধরনের প্রথম বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে, কোনো আফ্রিকান রাষ্ট্রের কর্মকর্তার সঙ্গে নয়।
আরও পড়ুন>> বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র-চীন উভয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায়
Advertisement
সফরের সময়টিও জরুরি প্রয়োজনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশি গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিনগত রাত ১টা ৫৮ মিনিটে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান বাংলাদেশের মন্ত্রী। এরপর দুজনের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে রাত ২টা ৫০ মিনিটে ঢাকা ত্যাগ করেন কিন গ্যাং।
প্রশ্ন হলো, এমন কী জরুরি বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন পড়লো যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মধ্যরাতে বিমানবন্দরে ছুটতে হলো?
আরও পড়ুন>> অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ঢাকা কোনো দেশের হস্তক্ষেপ চায় না
এ বিষয়ে বেইজিংয়ের দিক থেকে খুব সামান্যই জানা যায়। তবে ড. মোমেন বৈঠকের পর গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, কিনের সঙ্গে তার কথোপকথনে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি উঠে এসেছে। বাংলাদেশ প্রতি বছর চীন থেকে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে। বিপরীতে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি ৮০ কোটি ডলারের নিচে আটকে রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নড়বড়ে অবস্থার কারণে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য ঘাটতি ঢাকার জন্য বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে চীনের পূরণ না করা প্রতিশ্রুতিগুলোর বিষয়ে হতাশা স্পষ্ট ছিল। তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরে অনেক বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ছয় বছর পরেও তার অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। মোমেন আরও অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ পণ্য চীনে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের বিষয়ে আগের চুক্তিও বাস্তবায়িত হয়নি।
আরও পড়ুন>> ভাসানচরে ১০ মাসে ৫২৫ রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম
বাংলাদেশের দিক থেকে আরেকটি শীর্ষ অগ্রাধিকার হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চাওয়া। মিয়ানমার থেকে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাস করছে। এমন অতিরিক্ত বোঝার নিচে চাপা পড়া ঢাকা যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে এগিয়ে নিতে চায়। তবে মিয়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সম্ভাবনা আগের চেয়ে আরও দূরে সরে গেছে বলে মনে হয়।
মিয়ানমারে নতুন সামরিক জান্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা বিদেশি সরকারগুলোর মধ্যে চীন অন্যতম। এ অবস্থায় বাংলাদেশ চায়, বেইজিং রোহিঙ্গা ইস্যু উত্থাপনে তার প্রভাব ব্যবহার করুক। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধানে চীনের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা চেয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।’
চীনের স্বার্থ কী?
বিনিময়ে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার বিষয়ে চীনকে আশ্বাস দিয়েছেন ড. মোমেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি বজায় রাখি। এটিই আমাদের নীতি।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিনকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘সময়ে সময়ে আপনাদের প্রতি সমর্থন বাড়াবে বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সমস্যা থাকতে পারে। সেটি তাদের মাথাব্যথা। আমরা উভয়ের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাই।’
আরও পড়ুন>> যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্ক গড়তে চায় বাংলাদেশ: মোমেন
বৈশ্বিক শক্তিগুলোর এই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে সব পক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশের সামনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। ঢাকা এটি ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। মোমেনের কথায়, ‘এটি ভালো খবর যে, আমরা অনেক দেশ থেকে যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছি।’
সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার ঠিক আগে ঢাকায় এই সংক্ষিপ্ত সফর করলেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হোয়াইট হাউজের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর আইলিন লাউবাচার গত ৭ জানুয়ারি চারদিনের সফরে ঢাকায় আসেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আগামী ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফরে আসার কথা রয়েছে।
সম্ভবত মার্কিন কর্মকর্তাদের এসব সফরই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঢাকায় নামতে অনুপ্রাণিত করেছিল। একইভাবে কিনের সঙ্গে মধ্যরাতের কথোপকথন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনায় কিছু বাড়তি গোলাবারুদ জোগান দিতে পারে।
কেএএ/