দেশে শিক্ষা পদ্ধতি আর শিক্ষানীতি নিয়ে বিতর্ক বেশ জমজমাট। যে শিক্ষা মানুষ জাতির মেরুদণ্ড, সেই মেরুদণ্ড এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে নড়বড়ে, ভঙ্গুর ও প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও তার উন্নয়ন নিয়ে পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করে চলেছি।
Advertisement
প্রবাসী হলেও বাংলাদেশের শিক্ষার মান ও সার্বিক নড়বড়ে অবস্থা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। আমার মতে সু এবং সঠিক শিক্ষা অর্জিত না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনোই আসতে পারে না। দেশের বিভিন্ন পেশার গ্রুপের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষাকেও এখনো একমুখী সর্বজনীন রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। নানা বিভেদ, বিভাজনের বিষে জর্জরিত হয়ে গেছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা।
বলা হয়ে থাকে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশীয় শিক্ষার মান উন্নয়ন করতেই নাকি গ্রেডিং পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা হোক। কিন্তু এই বিষয়ে বাস্তবে কী করা হলো? কী করা হচ্ছে! সাম্প্রতিক কয়েকটি নমুনা এবং এই আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার সর্বশেষ দশা বা পরিস্থিতি খেয়াল করা যাক। রাষ্ট্রপতি নিজেও দেশের এই আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার বেহাল দশায় চরম উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।
দেখা গেছে, গ্রেডিং পদ্ধতিতে জিপিএ’র জোয়ার বইতে শুরু করেছে। প্রতিটি বোর্ডে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হচ্ছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। এখন আন্তর্জাতিক মানেও সন্তুষ্ট হতে পারলোনা দেশ! পাসের হার বৃদ্ধি করতে হবে। শুরু হয়ে গেলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতভাগ পাসের হার নিশ্চিত করার প্রতিযোগিতা। অসম আর অসুস্থ এই প্রতিযোগিতার বলি হতে শুরু করলো মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা।
Advertisement
খোদ শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই এবং অনেক বেকার যুবক শিক্ষার নামে কোচিং ব্যবসা শুরু করলেন। পাসের হার ও জিপিএ-৫ এর শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থী ধরা শুরু হলো। কোচিংয়ে কিছু অসাধু শিক্ষক ও কিছু অসাধু চক্র প্রশ্ন ফাঁস করে দিতে শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়লো দেশজুড়ে প্রশ্ন ফাঁস ও তার আতঙ্ক। পরীক্ষার আগেই ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ভাইবার ও হোয়াটস অ্যাপে প্রশ্ন বিক্রি শুরু হয়।
বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীরাও গণহারে জিপিএ-৫ পেতে শুরু করে। পরীক্ষার পর পাসের হার বৃদ্ধির জন্য উত্তরপত্র মূল্যায়নকারী শিক্ষকদের জানিয়ে দেওয়া হয়, যাই লিখবে তাতেই নম্বর দিতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় পাশের উচ্চ হার এবং জিপিএ’র বন্যা বইয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এই জিপিএ-৫ এর করুণ দশা লক্ষ্য করা গেলো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও।
আরও পড়ুন: সন্তানদের সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
ফল হলো এই যে, আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে মানের শিক্ষার্থী পাওয়া যেত এখন সেই গুণগত মানের শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা ইংরেজি এমনকি বাংলাও ভালো জানে না। অন্যদিকে জিপিএ-৫ পাওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে গণহারে অকৃতকার্যও হয়। এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এরপর থেকে এই জিপিএ-৫ এর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন এবং বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
Advertisement
এমনকি রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রশ্নফাঁস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অভিভাবক ও শিক্ষকদের উদ্দ্যেশ্যে বলেছেন; আমি বুঝি না এ কেমন শিক্ষক যে ছাত্র-ছাত্রীদের নকল সরবরাহ করে। মা-বাবারাই বা কেমন যারা নিজেরাই নিজেদের সন্তানদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ছাড়াও নিয়োগ পরীক্ষা থেকে শুরু করে সব পরীক্ষায় এই প্রশ্নফাঁস এক কঠিন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাধি ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেশে। এখন এই ব্যাধি থেকে মুক্তির উপায় খোঁজা শুরু হয়েছে। কিন্তু উপায় যে আর মেলে না।
এরই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি অনেকে এই ব্যাধির প্রতিকার নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। আমি প্রবাসী হলেও গোটা শিক্ষা পদ্ধতির গলদ খুঁজে বের করে এর স্থায়ী প্রতিকারের জন্য সরকার ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান রেখেছি। মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও নিবিড় প্রশাসনিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেশে সুশিক্ষার পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে। তা বাস্তবায়নের জন্য আমি দেশে একটি বা একাধিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষকদের মধ্যে বুনিয়াদি, কার্যকর ও আধুনিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার এক নতুন চিন্তা সরকার ও দেশবাসীর কাছে উপস্থাপন করেছি।
সেখানে যেন আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক এক অগ্রণী চিন্তায় আমার পৃথিবী উদ্ভাসিত হয় আমার জ্ঞানের আলোকে! এই শিক্ষা হবে আমাদের উপার্জনের হাতিয়ার। আমি মনে করি, শিক্ষা গ্রহণের পরেই প্রতিটি মানুষের সব ব্যস্ততা আবর্তিত হয় প্রত্যাশিত একটি চাকরিকে ঘিরে। এক্ষেত্রে দেশে এমন অবস্থা যেখানে উচ্চশিক্ষিত হতে যত বছর সময় লাগছে চাকরি পেতে সেই ছাত্রকে এর চেয়েও বেশি সময় অপচয় করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমি একাধিক আধুনিক ধারণা দিয়েছি।
আরও পড়ুন: শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে শিক্ষকের নৈতিক নিরপেক্ষতা
আমার মতে, বর্তমান বিশ্বে চলছে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং গোটা বিশ্বের শিল্পকারখানা, প্রযুক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পৃথিবীর উন্নত দেশে এখন আজীবন চাকরি বলে কিছু নেই, চাকরি আছে ততদিন যতদিন কাজ আছে এবং কাজ আছে ততদিন যতদিন চাহিদা আছে। শেয়ার মার্কেট নির্ধারণ করছে বর্তমান কর্মসংস্থান ও চাকরির স্থায়িত্ব। শেয়ার হোল্ডার, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ক্লাইমেট পরিস্থিতি, এসব বিশাল আকারে প্রভাব বিস্তার করছে শিল্প কারখানা এবং অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে।
শিক্ষা ও শিক্ষার মান নির্ভর করছে গ্লোবাল চাহিদার ওপর এবং তাও হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট লেভেলে। সেক্ষেত্রে নিশ্চিত করে বলা কঠিন কী পড়লে সারা জীবন চাকরির গ্যারান্টি মিলবে। তবে সারাজীবন টেকসই ইন্ডাস্ট্রি প্রোভাইডার এবং যোগ্য নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকতে হলে দরকার সময়োপযোগী সুশিক্ষা। বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে ঊর্ধ্বমুখী এক দেশ। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ও সময়ের স্রোতে এ দেশের সব সেক্টরেই লেগেছে আজ ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। কিন্তু আমাদের ধ্যানে-জ্ঞানে এ ছোঁয়া আজও লাগেনি! চাহিদা বলছে কী পড়তে হবে এবং কেন পড়তে হবে।
এ সময়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এবং প্রত্যেকটি শিক্ষককে জানতে হবে চাহিদাগুলো কী এবং তার জন্য কী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সব শিক্ষকদের সুশিক্ষার আওতায় আনতে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হলে বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প নেই। দেশের সব শিশু শিক্ষা বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সর্বস্তরের শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান ও গ্রহণের একটি সমন্বিত কার্যক্রমের আওতায় থাকবে।
যেখানে দেশ, বিদেশের বড় বড় কোম্পানি বা সংস্থার মালিক বা সিইও, কর্মকর্তা, গবেষক, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা একত্রিত হয়ে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধি ও যুগোপযোগীকরণে সহায়তা দান করা এবং শিক্ষকদের ব্যক্তিত্ব, উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি এবং নেতৃত্বের গুণাবলি জাগ্রত করা, নতুন নতুন শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে দক্ষতা ও কৌশল বৃদ্ধি করা হবে এই বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য।
এমতাবস্থায় শিশু শিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত নিবিড় নজরদারি চালু রাখতে হবে। কী শিক্ষা, কেন শিক্ষা, শিক্ষার উদ্দেশ্য কী এবং তা কীভাবে মনিটরিং করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। শিশুদের ১-১৫ বছর বয়সের মধ্যের সময়টা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। মানবতার ফর্মে আনতে হলে তাদের মানসম্পন্ন পরিবেশের মধ্যে শিক্ষা দান করে গড়ে তুলতে হবে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরে পর্যায়ক্রমে গড়ে তুলতে হবে সুশিক্ষার সার্বিক অবকাঠামো।
যেখানে থাকতে হবে জানার থেকে শেখা। দুর্নীতি বা অনিয়ম যেন কলুষিত করতে না পারে শিক্ষা প্রশাসনকে, শিক্ষাঙ্গণকে। একই সাথে গণতন্ত্রমনা ও সৃজনশীল নাগরিক হিসাবে নিরাপদে ও গর্বের সঙ্গে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করবে এবং মতামতের ভিন্নতা সত্ত্বেও খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে তারা সামাজিক ঐক্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।
শিশু বিদ্যালয়, শিশুদের জন্য অনুকরণ এবং অনুসরণের জায়গা, সেজন্য এই সব শিক্ষাঙ্গনে থাকা চাই মনোবিজ্ঞানী, সমাজকর্মী। সেখানে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদির সাহায্যে বিজ্ঞান মনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে শিক্ষা দান ও প্রশিক্ষণ চলবে। যেখানে মননশীলতা চর্চা ও বৈশ্বিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে শিশুদের প্রারম্ভিক জীবন। এই শিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে একে অপরের থেকে জানা। এসব প্রস্তুতির জন্য সহায়ক মাধ্যম হচ্ছে প্রশিক্ষণ, অথচ এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দেশে খুবই সামান্য ও দায়সারা গোছের।
এই ব্যাপারে শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন- আছে কি বাংলাদেশের শিশু বিদ্যালয়ে এমন শিক্ষক বা শিক্ষা পদ্ধতি, যেখানে চর্চা হচ্ছে এমন মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা? বা সেই ভাবে তৈরি হচ্ছে কি তেমন শিক্ষক যিনি পারবেন মোকাবিলা করতে ভবিষ্যতের এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে? তাহলে কি আমরা যেভাবে আছি ঠিক সেভাবেই থাকব?
নাকি চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রজন্মকে শুধু বাংলাদেশি নয় গোটা বিশ্বের নাগরিক করে গড়ে তুলবো সুশিক্ষার মাধ্যমে! প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ধারার একমাত্র বাহক শিক্ষক সমাজই যদি মজবুত না হয়, শিক্ষার্থী অভিযাত্রীরা কি নির্বিঘ্নে শিক্ষা নামক বৈতরণী পাড়ি দিতে পারবেন? সে প্রশ্ন সব নাগরিকের, সব অভিভাবকের।
আমরা জানি, শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দরকার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। গতানুগতিক, অসম্পূর্ণ, সনদপত্রসর্বস্ব, তত্ত্বীয় বিদ্যাপ্রধান, অপর্যাপ্ত ব্যবহারিক শিক্ষা, মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল এবং পুরনো পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসারী, তাই আশানুরূপ ফল লাভ হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: সন্তানের সুশিক্ষা ও পিতা-মাতার ভূমিকা
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে একটা বিষয় বেশ পরিষ্কার যে, বাংলাদেশে সুশিক্ষার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ পরবর্তী ফলোআপ খুবই জরুরি। দেশে তার জন্য পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আলাদা আলাদা ভাবে কিছু শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সেগুলো মানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়েরও ব্যবস্থা নেই। আবার শিশু বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষকদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে দেশে দিনে দিনে শিক্ষিতের হার বাড়লেও বাড়ছে না শিক্ষার মান। তাই দেশের জনশক্তিকে দ্রুত জনসম্পদে রুপান্তর করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
তাই আর দেরি না করে এই বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক। বর্তমান যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা জানে না কি ধরনের শিক্ষা দেওয়া দরকার একজন শিশু বিদ্যালয়ের শিক্ষককে। পুরো শিক্ষাঙ্গন খুঁজলে পাওয়া যাবে খুব কম সংখ্যক এইসব গুণসম্পন্ন শিক্ষক, নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক। মানুষের মত দেখতে হলেই মানুষ গড়ার কারিগর হওয়া যায় না, তার জন্য দরকার মিশন, ভিশন এবং পলিসি। সঙ্গে ডেডিকেশন, প্যাশন, মোটিভেশন, গোলস এবং অবজেকটিভস।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রদবদল করতে হবে প্রথমে এবং জনগনের মনোনীত প্রার্থী ও স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে এ কাজ শুরু করতে হবে। দেশকে বহিঃশত্রুর থেকে মুক্ত করলেই তো দেশ মুক্ত হলো না? দেশকে খাদ্যের অভাবমুক্ত, অন্ন-বস্ত্রের অভাবমুক্ত, কুশিক্ষা মুক্ত, পরাধীন চেতনা মুক্ত, দুর্নীতি মুক্ত করতে হবে। সোনার বাংলা গড়তে হলে যারা বর্তমানে নানা দায়িত্বে আছেন তাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
দেশের শিক্ষাঙ্গনের এই দুর্দিনে সামরিক বাহিনী পরিচালিত ক্যাডেট কলেজগুলো থেকে আমরা তাদের প্লানিং টুল ফর অ্যাডমিনিসট্রেশন, ডিসিপ্লিন, সোর্স ইন্টিগ্রেশন, সিনক্রোনাইজেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। একটি বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে তা হল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো স্তরেই যেন এমন কিছু শিক্ষা দান করা না হয় যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায়ের বিভেদ জ্ঞানে কলুষিত হয়ে পড়ে। জ্ঞানদান যেন এমন হয় যে সবকিছু জানার মাধ্যমে বৈচিত্র্যের মাধ্যমে মানুষে মানুষে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে।
বাংলাদেশের সবাই শিক্ষার বিষয়টি দেখছে, জানছে, জল্পনা-কল্পনা করছে কিন্তু কীভাবে শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন করা যায় তা নিয়ে খুব কমই কথা হচ্ছে। এখনো চলছে সেই সনাতন শিক্ষাদান পদ্ধতি যা বয়ে আনছে দেশে শুধু অন্ধকার ও বেকারত্ব। আজ জাতি সত্যিকারের শিক্ষা হারিয়ে ফেলেছে। সুশিক্ষা, মানসম্মত শিক্ষার অভাবে যে সামান্য সুযোগ সুবিধা দেশে রয়েছে তার দিকে চেয়ে আছে লাখ লাখ বেকার যুবক।
চাকরিতে লোক নিয়োগ হবে একজন, হাজার প্রার্থী তাতে আবেদন করছে। ‘কোটা’ থাকা সত্ত্বেও হবে কি চাকরি সবার? যারা চাকরি পাবে না তাদের কর্মসংস্থানের জন্য কী ভাবা হচ্ছে? দেশে লাখ লাখ বেকার তৈরির এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কি কোনো জবাবদিহীতা আছে? সরকারের কী বক্তব্য এই ব্যপারে? এসব ঘটনার পর, ভাবনা একটাই মনের মধ্যে- কীভাবে সম্ভব একটি বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যেখানে জাতি তার উত্তর খুঁজে বের করবে- কী পড়াব, কতটুকু পড়াব,
কতজনকে পড়াব, দেশের কতটুকু কী দরকার? চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মানসম্পন্ন প্রয়োজনীয় শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি করতে হবে সুশিক্ষিত জাতি। সচেতন জাতি খুঁজে বের করে সমাধান, অজুহাত নয়। সাবধানতাই একমাত্র সুশিক্ষার পথ।
সুশিক্ষার কারিগর পেতে হলে এবং মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হলে দরকার এই বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্টের মধ্যে জানতে হবে, জানতে হলে শিখতে হবে, শিখতে হলে পড়তে হবে, আর পড়তে হলে চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষকদের।
তবেই হবে শিক্ষার সার্থকতা আর শিক্ষক হবে সুশিক্ষার কারিগর। বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে তার সমাধান। তাই শিক্ষাঙ্গনে এক বিরাট পরিবর্তনের জন্য চাই সংশ্লিষ্ট সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/এমএস