সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দামে ফ্লোর প্রাইস (সর্বনিম্ন দাম) নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখন সেই ফ্লোর প্রাইসই পরিণত হয়েছে শেয়ারবাজারের গলার কাঁটা। বাজার স্বাভাবিক করতে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার পক্ষে বিশ্লেষক ও বিনিয়োগকারীরা।
Advertisement
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে ফ্লোর প্রাইস থাকায় শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে একদিকে বিনিয়োগকারীরা তাদের কাছে থাকা শেয়ার ও ইউনিট বিক্রি করতে পারছেন না, অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নতুন বিনিয়োগের পথ। ফলে শেয়ারবাজারের লেনদেন কমেছে আশঙ্কাজক হারে।
আরও পড়ুন>> বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ, স্বস্তি মিলবে শেয়ারবাজারে?
তারা বলছেন, যদি কোনো মানুষের শরীরে ক্যানসার হয়, তাহলে অবশ্যই কেমোথেরাপি দিতে হবে। কেমোথেরাপি দিয়ে ক্যানসারের কোষ ধ্বংস করা হয়। চুল পড়ে যাওয়ার ভয়ে যদি কেমোথেরাপি না দেওয়া হয়, তাহলে ক্যানসারের বিস্তার বেড়ে যায়। বর্তমান শেয়ারবাজারের অবস্থা হয়েছে ক্যানসারে কেমোথেরাপি না দেওয়ার মতো। ফ্লোর প্রাইসের কারণে মূলত সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দিন যত যাবে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মাত্রা তত বাড়বে।
Advertisement
তারা আরও বলছেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে প্রথম হয়তো শেয়ারবাজারে একটা দরপতন দেখা দিতে পারে। এতে কিছু বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়বেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বাজার তার গতি ফিরে পাবে। তখন সব ধরনের বিনিয়োগকারীই লাভবান হবেন। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস ধরে রাখলে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির মাত্রা বাড়তেই থাকবে। বিশেষ করে যারা মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, সেই বিনিয়োগকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ দিন যত যাবে তাদের ঋণের সুদের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।
আরও পড়ুন>> ‘ক্রান্তিকালে পুঁজিবাজার’
শেয়ারবাজারে টানা দরপতন দেখা দিলে গত বছরের ২৮ জুলাই এক নির্দেশনা দিয়ে প্রতিটি সিকিউরিটিজের ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয় বিএসইসি। ৩১ জুলাই ফ্লোর প্রাইস কার্যকর হওয়ার পর থেকেই শেয়ারবাজারে লেনদেন খরা দেখা দেয়। দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে উঠে যাওয়া লেনদেন ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে এখন দুইশ কোটি টাকার ঘরে এসে ঠেকেছে।
শেয়ারবাজারে লেনদেন খরা প্রকট হয়ে উঠলে গত ২১ ডিসেম্বর ১৬৯ প্রতিষ্ঠানের ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয় বিএসইসি। ফ্লোর প্রাইস তুলে এসব প্রতিষ্ঠানের সার্কিট ব্রেকারের (দাম বাড়া বা কমার সীমা) ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম চালু করা হয়। দাম বাড়ার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সার্কিট ব্রেকার দেওয়া হলেও দাম কমার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া হয় এক শতাংশ। ফলে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার খুব একটা লেনদেন হচ্ছে না। যে কারণে লেনদেনের চিত্রেও খুব একটা উন্নতি হয়নি।
Advertisement
টানা দরপতন ও লেনদেন খরা চলায় সম্প্রতি শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ওই বৈঠকে ফ্লোর প্রাইস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারের স্বাস্থ্য ভালো না হওয়া পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইস তোলা হবে না।
আরও পড়ুন>> দুই’শ কোটি টাকার নিচে নামলো লেনদেন
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে ফ্লোর প্রাইসের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তার উত্তরে চেয়ারম্যান স্যার স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন শেয়ারবাজারের স্বাস্থ্য ভালো না হওয়া পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইস তোলা হবে না।
ফ্লোর প্রাইস শেয়ারবাজারের কী ধরনের ক্ষতি করছে জানতে চাইলে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, ফ্লোর প্রাইস এখন শেয়ারবাজারের ক্যানসারে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্যানসার হলে যেমন কেমোথেরাপি দিতে হয়, এখন শেয়ারবাজারেও সে রকম কেমোথেরাপি দিতে হবে। এই কেমোথেরাপি হলো ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া। বাজার পড়ে যাওয়ার ভয়ে যদি ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া না হয়, তাহলে শেয়ারবাজার আরও খাদের কিনারে চলে যাবে।
তিনি বলেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হলে শুরুতে কিছু দরপতন হবে। যেসব বিনিয়োগকারী বাড়তি দামে শেয়ার কিনেছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে দর সংশোধন হওয়ার পর আবার বাজার ঘুরে দাঁড়াবে এবং নতুন ফান্ড আসবে। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস ধরে রাখলে যেসব বিনিয়োগকারী সাইড লাইনে চলে গেছেন, তারা নতুন করে বিনিয়োগ করবেন না। ফলে শেয়ারবাজারেও গতি ফিরবে না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ফ্লোর প্রাইসের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং সাধারণ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা শেয়ার কেনা-বেচা করতে পারছেন না। ফলে বিনিয়োগকারীরা এখন শেয়ারবাজারমুখী হচ্ছেন না। ফ্লোর প্রাইস এখন শেয়ারবাজারের গলার কাঁটায় রূপান্তরিত হয়েছে। কোনো বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক ফ্লোর প্রাইস সমর্থন করে না।
আরও পড়ুন>> ১৬৯ প্রতিষ্ঠানের ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলো বিএসইসি
‘যেসব বিনিয়োগকারী ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তারা এখন সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছেন। প্রতিনিয়ত তাদের ঋণের সুদ যোগ হচ্ছে। ২০১০ সালে ফোর্সড সেল বন্ধ করে শেয়ারবাজারের যেভাবে ক্ষতি করা হয়েছিল, এখন ফ্লোর প্রাইস দিয়ে সেভাবে বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। শেয়ারবাজার ভালো করতে হলে অবশ্যই ফ্লোর প্রাইস তুলে দিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, আমাদের শেয়ারবাজারে দুটি শ্রেণি আছে। একটা হলো বিনিয়োগকারী, অন্যটি জুয়াড়ি। ফ্লোর প্রাইসের কারণে জুয়াড়িরা লাভবান হচ্ছেন। বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভ হচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগকারীরা সাইড লাইনে চলে গেছেন। ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হলে শেয়ারবাজারে কিছুটা মূল্য সংশোধন হবে। মূল্য সংশোধনের পর শেয়ারের দাম যখন যৌক্তিক মূল্যে চলে আসবে, তখন বিনিয়োগকারীরা আবার বিনিয়োগ করবেন। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস না তুললে যারা সাইড লাইনে আছেন, তারা বিনিয়োগ করবেন না।
আরও পড়ুন>> শেয়ারবাজারে বড় দরপতন, আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা
শেয়ারবাজার ভালো করতে হলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিতে হবে বলে মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি বুঝি না বিনিয়োগকারীরা কেন এত ফ্লোর প্রাইসের পক্ষে। তারা কি ফ্লোর প্রাইসে বিক্রি করতে পারবেন? স্ক্রিনে দাম দেখে তারা কী সান্ত্বনা পাচ্ছেন, এটা আমার বোধগম্য নয়। যে কোনো বাজারে এত দীর্ঘ সময় ফ্লোর প্রাইস থাকলে বাজার ধ্বংস হয়ে যায়।
‘আমার মনে হয় সুবুদ্ধি হবে। ফ্লোর প্রাইস ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হবে এবং বাজার তার গতি ফিরে পাবে সাময়িক ধাক্কা খেলেও। এই বাজারে টাকা কোনো সমস্যা নয়। আমরা দেখেছি বাজার ইমপ্রুভ করলে টাকা কোথা থেকে আসে কেউ জানে না।’
তিনি আরও বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে প্রায় দুই-আড়াইশ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে না। এখানে যে সূচক দেখানো হচ্ছে, আমার মনে হয় তা কৃত্রিম। কারণ যেখানে আসল কোম্পানিগুলোর লেনদেন হচ্ছে না, সেখানে এই সূচকের কোনো মূল্য আছে বলে আমার মনে হয় না। ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হলে সাময়িক হয়তো বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তারপর বর্তমান যে অবস্থা আছে তার চেয়ে সামনে ভালো হবে।
ফ্লোর প্রাইস কীভাবে শেয়ারবাজারের ক্ষতি করছে তার ব্যাখ্যায় মিডওয়ে সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আশিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, যতদিন ফ্লোর প্রাইস থাকবে, ততদিন বাজারে একটা নেতিবাচক প্রেশার থাকবে। কারণ পিই হিসাব করা হয় দাম এবং আয় দিয়ে। আয় কিন্তু পড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকলে আয় অবশ্যই পড়বে। অপরদিকে ফ্লোর প্রাইসের কারণে দাম কমতে পারছে না। যতদিন ফ্লোর প্রাইস থাকবে, ততদিন কৃত্রিমভাবে পিই বেড়ে যাবে। আয় পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু দাম একই থেকে যাচ্ছে। সুতরাং ক্যালকুলেশনে পিই ১৭-১৮ হয়ে যাচ্ছে। তখন কিন্তু বোঝায় বাজার অতিমূল্যায়িত এবং এটা কৃত্রিম।
তিনি বলেন, বাজার ইতিবাচক হওয়ার একটাই উপায় আছে। সেটা হলো স্টকের দাম ফেয়ার ভ্যালু হতে হবে। আপনি কিন্তু এখন বলতে পারবেন না, কোনো স্টক ফেয়ার ভ্যালুতে আছে। কৃত্রিমভাবে দাম ধরে রাখা হয়েছে। স্টকের মূল্য যখন ফেয়ার ভ্যালুতে আসবে, তখন সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারী আসবে। বাংলাদেশে বড় বড় হাই নেটওয়ার্কের অনেক বিনিয়োগকারী আছেন। ফ্লোর প্রাইস যখন তুলে দেওয়া হবে, যারা অতিরিক্ত দামে কিনে রেখেছেন তাদের জন্য ক্ষতিকর হবে। কিন্তু সাইড লাইনে যারা টাকা নিয়ে আছেন, তারা যখন দেখবেন পছন্দের কোম্পানি ফেয়ার ভ্যালুতে চলে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে কিনে ফেলবেন।
এমএএস/এএসএ/এমএস