জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মামলাসহ যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও তদন্ত সংস্থার অদক্ষতা, অযোগ্যতা এবং দুর্বলতার জন্য তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।মঙ্গলবার জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেমের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপনের সময় একটি অভিযোগ থেকে পড়ে শোনান অ্যাটর্নি জেনারেল; যার ঘটনাকাল ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর। তখন অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আপনাদের ডকুমেন্টেই তো রয়েছে উনি ২৩ নভেম্বর ঢাকা ছিলেন।ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা শুধু ব্যস্ত টিভিতে চেহারা দেখানো নিয়ে- এমন কড়া ভাষায় প্রসিকিউটরদের ভর্ৎসনা করে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থার পেছনে রাষ্ট্রের টাকা খরচ হচ্ছে। কিন্তু তারা এসব কী মামলা পরিচালনা করছেb? তারা (প্রসিকিউটররা) দামি দামি গাড়িতে চরেন আর পুলিশের হুইসেল দিয়ে ঘুরে বেড়ান।’মীর কাসেম আলীর আপিলে মঙ্গলবার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের যুক্তি পেশ করার সময় প্রধান বিচারপতি এভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রসিকিউশনের অদক্ষতার বিষয়ে তিনি বলেন, মামলার এভিডেন্স দেখলে, এগুলো পড়লে আমাদের খুব কষ্ট লাগে। মামলাগুলো যখন আমরা পড়ি তখন আমাদের গা ঘিন ঘিন করে তাদের মামলা পরিচালনা দেখে।আগামীকাল বুধবার এ মামলার পরবর্তী শুনানি করে কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আজ রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। অন্যদিকে মীর কাসেম আলীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম প্রমুখ।অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন রাখেন- এত ‘হাফ হার্টেড’ হয়ে আপনারা মামলা চালান কেন?মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনীত ২নং অভিযোগের বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন। ২নং অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষের মাত্র একজন সাক্ষী রয়েছেন।এ সময় আসামিপক্ষ আদালতকে বলেন, সাক্ষীর বক্তব্যের সমর্থনে (করোবোরেশন) আর কোনো সাক্ষী হাজির করা হয়নি। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, করোবেরশন নেই বলে সাক্ষীর সাক্ষ্য অবিশ্বাস করা যায় না। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনার (অ্যাটর্নি জেনারেল) দায়িত্ব হচ্ছে অভিযোগ প্রমাণ করা। সারা চট্টগ্রামে একজন ছাড়া আর কোনো সাক্ষী পেলেন না? এ রকম হাফ হার্টেড মামলা চালান কেন আপনারা? এমন যদি দেখা যেত যে, বিরূপ পরিস্থিতি বিরাজমান তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু এখন নিজেদের সরকার ক্ষমতায়। চাইলে আপনি প্রটেকশন দিতে পারতেন। সেখানে কেন সাক্ষী আনতে পারবেন না? যখন অন্য সাক্ষী আনার সম্ভাবনা রয়েছে, রুল অব ল বলছে অন্য সাক্ষী দরকার।’শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চান, প্রসিকিউশনে রাষ্ট্রপক্ষে কতজন আইনজীবী এবং তদন্ত সংস্থায় কতজন তদন্ত কর্মকর্তা আছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমার জানা নেই।অ্যাটর্নি জেনারেল অভিযোগ থেকে পড়ে শোনানোর সময় প্রধান বিচারপতি যখন বলেন, আপনাদের ডকুমেন্টেই তো রয়েছে উনি ২৩ নভেম্বর ঢাকা ছিলেন, মাহবুবে আলম তার জবাবে বলেন, ঢাকার বাইরে অবস্থান করেও পত্রিকায় বিবৃতি দেয়া যায়। ২৪ নভেম্বর পত্রিকায় বিবৃতি প্রকাশিত হলে তার মানে এই নয় যে, তিনি ২৩ নভেম্বর ঢাকায় ছিলেন। এটা যেকোনো স্থান থেকে দেয়া যায়। এটা কোনো বিষয় নয়।আদালত তখন অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, মনে রাখবেন তখন নভেম্বর মাস, পরিস্থিতি খেয়াল করবেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত। ব্রিজ-কালভার্ট প্রায় সব ধ্বংস হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা জেঁকে বসেছে প্রায় সবখানে। এয়ার সার্ভিসও তখন বন্ধ। দেশের ভেতরে যাদের দূরের পথে যাতায়াত করতে হতো তাদের ভেঙে ভেঙে যেতে হতো। ট্রেন কিছুদূর গিয়ে থেমে যেত। নৌকায় পার হতে। তাছাড়া মিডিয়াও এত শক্তিশালী ছিল না যে, ঢাকার বাইরে থেকে যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু পাঠানো যেত।একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা জসিম ও জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে হত্যার দায়ে (১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ) তাকে ওই দণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া আরো কয়েকটি অভিযোগে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।এরপর ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন মীর কাসেমের আইনজীবীরা। আপিলে তার খালাসের পক্ষে ১৮১টি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। এই আপিলেই রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হতে পারে বুধবার।এফএইচ/এনএফ/বিএ
Advertisement