শেরপুর সীমান্তে থামছেই না হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব। দেড় দশকেও স্থায়ী কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে বন্যহাতি, আক্রমণের শিকার হয়ে প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যপ্রাণির বিচরণের জায়গায় আবাসভূমি গড়ে তোলায় হাতি ও মানুষের এ দ্বন্দ্ব থামানো সম্ভব হচ্ছে না।
Advertisement
বন বিভাগের তথ্যমতে, স্থানীয়দের আক্রমণে দেড় দশকে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২৮টি হাতির। অপরদিকে হাতির আক্রমণে প্রাণ গেছে অর্ধশতাধিক মানুষের। লোকালয়ে হাতির বিচরণ ঠেকাতে সোলার ফেন্সিং, সার্চ লাইট ও জেনোরেটর বসিয়েও কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
সম্প্রতি সীমান্তে ফের বন্যহাতির তাণ্ডব শুরু হয়েছে। গারো পাহাড়ে প্রতি বছর শীত মৌসুমে দেখা যায় বন্যহাতি। এছাড়া বোরো আবাদসহ ধানের মৌসুমে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসে বন্যহাতির পাল। এতে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামের মানুষদের আতঙ্ক বাড়ে। নিজেদের জানমাল রক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় তাদের। ঢাকঢোল পিটিয়ে, পটকা ফুটিয়ে আর মশাল জ্বালিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না হাতির তাণ্ডব।
এদিকে নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় সরকারের কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক বেড়া স্থাপন প্রকল্প অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ফলে অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি পাহাড়ি জনগণ এর থেকে কোনো সুফলও পাচ্ছে না।
Advertisement
গারো পাহাড়ের পাকা সড়কের পাশে হাতি পারাপারের রাস্তা লেখা সাইনবোর্ড দেখে অবাক হতে পারেন যে কেউ। এই রাস্তা দিয়েই আমন ও বোরো মৌসুমে বন্য হাতির দল লোকালয়ে প্রবেশ করে। দীর্ঘ সময়ে পাহাড়ি এলাকায় লোকালয় গড়ে ওঠায় মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়ছে বন্যহাতির।
হাতির আক্রমণ থেকে ফসল ও জানমাল বাঁচাতে হাতি ঠেকাতে মরিয়া স্থানীয়রা। সরকারের পাইলট প্রকল্প সোলার ফেন্সিং, সার্চ লাইট বিতরণ ও জেনোরেটর বসিয়েও হাতি ঠেকাতে ব্যর্থ স্থানীয়রা। তাই এলাকা বিদ্যুতায়িত করে, মশাল জ্বালিয়ে, আগুনের ঢিল ছুড়ে ও হাতির শরীরে আগুন লাগিয়ে হাতি ঠেকাচ্ছে মানুষ। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা, মারা পড়ছে হাতি। আতঙ্ক ও ক্ষোভে মানুষেরও ক্ষতি করছে বন্যহাতির পাল।
গেলো বছর দশ দিনের ব্যবধানে দুই হাতির মৃত্যুতে কঠোর অবস্থানে যায় বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন। হাতির মৃত্যুর তদন্ত ও জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করে পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন।
এদিকে হাতি হত্যার অভিযোগে শেরপুর সীমান্তে প্রথমবার চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বন বিভাগ। সম্প্রতি সরকারের বন বিভাগ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বন্যহাতি দ্বারা নিহত পরিবারকে ৩ লাখ টাকা, আহতকে ১ লাখ টাকা ও ফসলের ক্ষতি হলে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। তবে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এই ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়েও শঙ্কা রয়েছে স্থানীয়দের।
Advertisement
ছোট গজনী এলাকার রিপন কোচ বলেন, পাহাড়ে ধান পাকা শুরু হলেই হাতির আনাগোনা শুরু হয়। আগে হাতি এলে দুই-তিন দিন থাকতো, কিন্তু এখন হাতি দেড়-দুই সপ্তাহ করে লোকালয়ে অবস্থান করে। এসময় হাতির ধ্বংসযজ্ঞে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আবাদি ফসল ও সবজি।
নালিতাবাড়ি উপজেলার নাকুগাঁও এলাকার বাসিন্দা ছমির মিয়া বলেন, ‘এমন একটা অবস্থা হইছে, হাতির আক্রমণ থেকে ধান বাঁচাইতে আমাদের রাত জেগে ধানক্ষেত পাহারা দেওয়া লাগে। নইলে একবার ক্ষেতে হাতি নামলে সব ধান নষ্ট হয়ে যায়। সীমান্তের সব কৃষকেরই একই অবস্থা।’
পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের আহ্বায়ক মেরাজ উদ্দিন বলেন, শেরপুর সীমান্তে দীর্ঘদিন ধরে বন ও বন্যপ্রাণির জায়গায় মানুষ বসবাস করে আসছে। হাতি চলাচলের জায়গায় আমরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছি বলেই আমরা হাতির আক্রমণের শিকার হচ্ছি। এই দ্বন্দ্ব নিরসনে বন বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় মানুষের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর কবির বলেন, এই এলাকায় হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। পাহাড়ি এলাকায় বন্যহাতি বাড়ি-ঘর ও ফসলের মাঠে তাণ্ডব চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করে আসছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের নানা প্রণোদনা ও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বন্যহাতির তাণ্ডবে যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। আমরা হাতি আক্রান্ত এলাকায় খোঁজখবর রাখছি ও ফসল রক্ষায় কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আল মাসুদ বলেন, হাতি মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় আমরা কাজ করে আসছি। ইতোমধ্যে সীমান্তের মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে হাতি ঠেকাতে নানা ব্যবস্থা নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। সোলার ফেন্সিং স্থাপন ও সার্চ লাইট দেওয়া হয়েছে সীমান্তের কৃষকদের।
বন বিভাগের বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল ঢাকার প্রধান বন সংরক্ষক মোল্ল্যা রেজাউল করিম বলেন, বন্যপ্রাণির বিচরণের জায়গায় লোকালয় না গড়ে বন্যপ্রাণি সম্পদ রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি স্থানীয়দেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমরা এ বিষয়ে স্থানীয়দের নিয়ে পরামর্শমূলক সভা সেমিনারের আয়োজন করছি।
লোকালয়ে হাতির প্রবেশ ঠেকাতে কাঁটাযুক্ত গাছ রোপণ, এলিফেন্ট রেসপন্স টিম, বৈদ্যুতিক ফেন্সিংসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের দাবি স্থানীয়দের।
এফএ/এমএস