ভ্রমণ

মহাকাশে বেড়াতে যাবেন?

মহাকাশ জয় করার স্বপ্ন মানুষের বহু দিনের। এ পর্যন্ত মোট ৫৮০ জন মানুষ মহাকাশে গেছেন। এবার মহাকাশে বেড়াতে যাচ্ছেন আমেরিকান ডিজে স্টিভ আওকি, টপ নামে এক কোরিয়ান পপ র্যাপার তারকা ও একজন স্পেস ইউটিউবার।

Advertisement

তারা চাঁদের চারপাশে বেড়াবেন। ফ্লাইটটি উড়বে চলতি বছর। ১৯৭২ সালের পর এটিই হবে সাধারণ মানুষের প্রথম চাঁদে বেড়াতে যাওয়া। মহাকাশে বেড়াতে যাওয়া সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিতে অনলাইন সুপারমার্কেট অ্যামাজনের মালিক জেফ বেজোস প্রতিষ্ঠা করেছেন স্পেস কোম্পানি ব্লু অরিজিন।

মহাকাশ থেকেও দেখা যায় বিশ্বের যে ৭ স্থান

এ মাসেই তাদের নিজস্ব রকেটে করে মহাকাশে বেড়াতে যাওয়ার কথা আছে। ওদিকে আরেক প্রযুক্তি ব্যবসায়ী ইলন মাস্কও মহাকাশে যাওয়ার জন্য তার স্পেস এক্স কোম্পানি থেকে কম খরচে মহাকাশে যাওয়ার রকেট তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

Advertisement

এরই মধ্যে বিশ্বের বিত্তশালীরা মহাকাশে পর্যটন ব্যবসা শুরু করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্র্যানসন সম্প্রতি তার কোম্পানি ভার্জিন গ্যালাকটিকের ইউনিটি রকেটে চড়ে মহাকাশের দ্বারপ্রান্ত থেকে ঘুরে এসেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো থেকে আরো পাঁচজন আরোহীকে নিয়ে মহাকাশ অভিমুখে উড়ে যান রিচার্ড ব্র্যানসন। তার রকেটের গতি ছিলো ঘণ্টায় তিন হাজার কিলোমিটার।

মহাকাশ সম্পর্কে জানতে ঘুরে আসুন বিশ্বসেরা ৭ প্ল্যানেটারিয়ামে

এক পর্যায়ে তারা কয়েক মিনিট ধরে ভরশূন্যতার অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন। এসময় তাদেরকে মহাশুন্য যানের ভেতরে ভেসে বেড়াতে দেখা গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমজনতা কি মহাশূন্যে বেড়াতে যেতে পারবেন?

Advertisement

স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন মহাকাশে উঁকি দিয়ে আসার পর নিজে থেকেই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, হ্যাঁ, অবশ্যই পারবেন। তবে এরকম অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনে একবারই হয়।

এ পর্যন্ত মহাকাশে যারা গেছেন, তারা মাত্র গুটিকয়েক ভাগ্যবান। তবে এমনটি আর বেশিদিন থাকবে না। আজকের তরুণ প্রজন্ম যখন বড় হবে, তখন আরও অনেক মানুষ মহাকাশে বেড়াতে যাবেন।

নিয়মিতই মহাকাশে যাতায়াত হবে। হয়তো আপনার উত্তরসূরী প্রজন্মের কেউ না কেউ সেদিন মহাকাশে পাড়ি দেবেন নানান কাজে। এমনই দিনের শুরু হিসেবে মহাকাশে একটি পাকাপোক্ত ল্যাবরেটরি তৈরি কাজও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

নারী নভোচারী হিসেবে প্রথমবার চাঁদে পা রাখবেন তিনি

ওটা মহাকাশে থাকবে আর পৃথিবী থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞানী দরকার মতো সেখানে গিয়ে কিছুদিন থেকে ওষুধপত্র, কেমিক্যাল তৈরি করার কাজ করে আবার ফিরে আসবেন। যেমন করে দেশের বিজ্ঞানী বিদেশের ল্যাবরেটরিতে কিছুদিন কাটিয়ে আসেন, অনেকটা তেমনই।

মহাকাশে কীভাবে যাত্রা করবেন? আপনার যাত্রা শুরু হবে এক ধরনের ফেরী রকেটে। পুরো সফরের তুলনায় এটি আপনাকে নিয়ে যাবে সামান্য পথ। পৃথিবী থেকে কাছেই একটি মহাকাশ ষ্টেশনে। এটি পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে চাঁদের মতো।

তবে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানটুকু কাটানোর জন্য ফেরী রকেটটিকে অবশ্যই খুব শক্তিশালী হতে হবে। মহাকাশ যানে বসতেই আসনের সঙ্গে বেল্ট দিয়ে আপনাকে ভালো করে বাঁধা হবে। যাতে কিছুতেই ছিটকে না যেতে পারেন। এবার রকেটের দরজা বন্ধ হতেই, মহা গর্জনে প্রচণ্ড বেগে উপরে ওঠার পালা।

ওঠার শক্তিটি এমন বেশি হবে যে, তা আপনাকে আসনের ওপর একদম চেপে রাখতে চাইবে। অবশ্য বেগ একবার বেড়ে যাওয়ার পর আর ততোটা খারাপ লাগবে না। মহাকাশ ষ্টেশনের কাছাকাছি এলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বেশ মজার মজার দৃশ্য উপভোগ করবেন।

আর আপন মনেই বলবেন, ওরে বাহ! ওই বিরাট বলের মতো ওটা কি? চিনতে মোটেই ভুল হবে না। নীল-সবুজ রঙের ওই বলটিই আমাদের পৃথিবী!

মহাদেশ আর মহাসাগরগুলো যেখানে বেশ আলাদা চোখে পড়বে। ঠিক ভূগোল বইয়ের গ্লোবের ছবির মতো। অবশ্য এর ওপরের মেঘগুলো দেখানোর কাজে কিছু গোলমাল করতে পারে।

ঘাটে লঞ্চ ভিড়াবার মতোই একটু কায়দা কসরত করে আপনার ফেরী মহাকাশযানটি গিয়ে লাগবে মহাকাশ ষ্টেশনের সঙ্গে। আপনি যদি আরও দূরের যাত্রী হন, তবে ষ্টেশনে যেমন আপনাকে গাড়ি বদলাতে হয়।

চড়তে হয় আরেকটি যানে। ঠিক তেমনই দূর পাল্লার রকেটে আপনাকে উঠতে হবে। যদি কাছেই চাঁদে যেতে চান, তাহলে রকেটটি ছোটই হবে।

তবে অন্যান্য গ্রহ যদি হয় আপনার গন্তব্য, তবে রকেটটি হতে হবে যথেষ্ট বড়। তবে যেখানেই যান, মহাকাশ ষ্টেশন থেকে যাত্রা করায় আগুনের ছটা আর তর্জন গর্জন তেমন কিছুই হবে না। যেমনটি হয়ে থাকে পৃথিবী ছাড়ার সময়।

কারণ মহাকাশে পৃথিবীর মতো মাধ্যাকর্ষণ টানটুকু না থাকাতে শব্দ হবার ঝামেলাও মহাকাশে নেই। তাই অনায়াসে প্রচণ্ড গতিতে পৌঁছে যাবে আপনার মহাশুন্য যান। হয়তো বা ঘণ্টায় লাখ মাইল বেগে।

আপনি অবশ্য এই প্রচণ্ড বেগের কিছুই টের পাবেন না। শুধু বেগ বাড়া বা কমার সময়টুকু ছাড়া। অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের পৃথিবী যে আমাদেরকে নিয়ে প্রচণ্ড বেগে সূর্যের চারিদিকে ছুটছে। তা কি আমরা টের পাই?

এবার রকেট জাহাজের ভেতরে আপনার কেবিনের অবস্থা কেমন হবে এক নজরে জেনে নেওয়া যাক। আগেই বলা হয়েছে- যদিও বাইরে জোরালো রকেট ইঞ্জিন চলছে। তার শব্দ কিন্তু মোটেও আপনার কানে আসবে না। কারণ ওখানে শব্দ বয়ে আনার বাতাস নেই। শুধু মহাশুন্যযানের ভেতরের ছোটখাটো যন্ত্রগুলোর শব্দই কানে টের পাবেন। ওখানে অবশ্য একটি বড় অসুবিধা বোধ করবেন।

তা হলো, আপনার ওজন বলতে কিছুই থাকবে না। দেখবেন আসনের বেল্ট থেকে নিজেকে মুক্ত করলেই পালকের মতো ভেসে বেড়াচ্ছেন। ঠেলা খেয়ে একবার চলবেন কেবিনের ছাদের দিকে তো আরেকবার দেওয়ালের দিকে। হাঁটাচলার জন্য বিশেষ ধরনের জুতা আপনাকে পায়ে দিতে হবে।

চুম্বকের টানে হয়তো জুতা জোড়া মেঝের সঙ্গে লেগে থাকতে চাইবে। অথবা চটচটে কোনো আঠার টানে লেগে থাকবে। আপনাকে খাড়া রাখার জন্য ওখানে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ টান নেই। ওই চটচটা জুতা ছাড়া আপনার খাড়া থাকার আর কোনো গতিও নেই।

খাবার-দাবারের কথা ভাবছেন? বিমানে ভ্রমণের সময় যেমন ট্রেতে খাবার সামনে নিয়ে আসা হয়। ওখানে কিন্তু তেমনটি হবার জো নেই। কারণ খাবারগুলো ট্রে থেকে উঠে এদিক-ওদিক চলে যেতে পারে। পানিও যে গ্লাসে থাকবে এমন নিশ্চয়তা নেই।

তাই বিশেষভাবে তৈরি খাবার টুথপেষ্টের টিউবের মতো জিনিসের মধ্যে পরিবেশন করা হয়। ওটা টিপে টিপে খাবার বের করে তারপর মুখে পুরতে হয়। কিংবা পকেট থেকে একটি ট্যাবলেট বের করে মুখে পুরলেই হলো, ব্যাস।

আরও একটি অসুবিধার বিষয় ঘটবে, কোনো কিছু ঘোরাতে গেলে। যেমন দরজার হাতল ডান দিকে ঘোরাতে চাইবেন। অমনি ওর প্রতিক্রিয়ায় আপনার পুরো শরীর বাম দিকে চাকার মতো ঘুরতে শুরু করবে।

এতসব হাঙ্গামার মধ্যেই আপনাকে মহাকাশযানে কাটানোর অভ্যাস করে নিতে হবে। গন্তব্য সন্ধানে এই মহাকাশ যান আপনাকে সরাসরি পৌঁছে দেবে না।

চাঁদ বা অন্য গ্রহের কাছাকাছি যখন পৌঁছে যাবেন, তখন আবার মহাকাশযান বদল করে আরেকটি ফেরী রকেট ধরতে হবে। এই বদলা-বদলির জন্য ওখানেও আছে মহাকাশ ষ্টেশন। ফেরী রকেট আপনাকে নিয়ে আলতো করে নামিয়ে দেবে চাঁদেও মাটিতে।

কিংবা গ্রহের বুকে বা কোনো এক নির্দিষ্ট জায়গায়। ওই জায়গায় তখন হয়তো থাকবে কিছু মানুষের বসতি। অন্তত কিছু মহাকাশ বিজ্ঞানী, গবেষকদের বসতি তো থাকবেই।

মহাকাশে পাঠানো প্রাণিদের সঙ্গে যা ঘটেছিল

অদ্ভূত এই সফরের পর ওখানে শুরু হবে আপনার আরো বহু মজার মজার অভিজ্ঞতার। এই সফরের শেষে গিয়ে আকাশে তাকিয়ে দেখে চমকে উঠে বলবেন- পৃথিবী গ্রহ এখন আপনার কাছ থেকে কতো দূরে?

অনেক অনেক দূর। আর আকাশ? রোজ ওটা আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে সুন্দর একটি গোলকের আকারে। আপনি দেখবেন আর বলবেন ওই যে পৃথিবী গ্রহ! ওই তো ওইখানে আমার বাড়ি। হ্যাঁ, ওই সুন্দর আলো বাতাস পানিতে ভরা গ্রহটিই আমার! ওটাই আমাদের পৃথিবী।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক; এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

জেএমএস/এমএস