পারভেজ রাকসান্দ কামাল
Advertisement
প্রতিদিন সকালে ফরহাদ সাহেবের বাথরুম থেকে বের হতে দেরী হয়। মাঝে মধ্যে বাইরে বসে বাথরুম থেকে চাপা হাসির শব্দ শোনেন ফরহাদ সাহেবের স্ত্রী তনিমা। এমনিতে সকালের এই সময়টাতে দুজনেরই যথেষ্ঠ তাড়া থাকে। এদিকে ফরহাদ সাহেবের অফিসের নিয়ম কানুন বেশ কড়া। পাঁচ মিনিটের বেশি দেরী হলে আর রক্ষা নেই, অর্ধেক দিনের বেতন কাটা যায়। এত কড়া প্রকৃতির অফিসের কর্মচারী হয়েও প্রতিসকালে ফরহাদ সাহেবের প্রকৃতির কর্মে এত দেরী কেন যে হয় তনিমা বুঝতে পারে না। অন্যদিকে তনিমা একটি বেসরকারী কলেজের সদ্য ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল হয়েছে, ফলে তাকেও সকাল সকাল কলেজ ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে হয়। কিন্তু ঐ একই ঝামেলা! প্রতিদিন সকালে ফরহাদ সাহেব আগে ভাগে বাথরুমে গিয়ে গ্যাট হয়ে বসে থাকবেন আর তনিমা বাইরে বসে গজর গজর করতে থাকবেন। এই চলছে রুটিন।
তনিমা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে স্বামীকে বলছেন, ‘কী হলো! শুনছো! ভিতরে বসে হাসাহাসি না করে বের হও। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।’ ভেতর থেকে ফরহাদ সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! এই তো, এই তো হয়ে এলো বলে।’ ভেতর থেকে উত্তর দিলেন ফরহাদ সাহেব।
কিছুক্ষণ পর সত্যিই ফরহাদ সাহেব হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন বাথরুম থেকে। হাসি দেখে তনিমার মাথাটাই গরম হয়ে যায়। সকালের ব্রেকফাস্ট টেবিলে তনিমা জিজ্ঞেস করেন, ‘বাথরুমে বসে এত হাসাহাসির কারণ কী তোমার?’ ফরহাদ সাহেব বলেন, ‘কই কিছু না তো।’ তারপর মনে পড়তেই আবার হেসে উঠে বললেন, ‘ফেসবুকে একটা মজার জিনিস পড়ে হাসছিলাম।’
Advertisement
তনিমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী সেটা?’। ফরহাদ সাহেবের উত্তর,‘বাংলা ভাষাটা বড়ই অদ্ভূত বুঝলে।’ তনিমা নিজেই বাংলার শিক্ষক। কথাটা শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। বললেন, ‘অদ্ভূত মানে?’ ফরহাদ সাহেব বললেন, ‘দেখ, কেউ যদি বলে যে, সত্যবাবু ছেলেমেয়ে নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করছে। তাহলে কথাটা শুনতে খারাপ লাগছে বলো?’
তনিমা মাথা নেড়ে বললেন, ‘না। শুনতে খারাপ লাগবে কেন?’ ‘এবার সেই একই কথাকে কেউ যদি ঘুরিয়ে বলে, সত্যবাবু মেয়েছেলে নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করছে। তাহলে শুনতে কেমন লাগবে?’ একে তো ফরহাদ সাহেব বাথরুমে বসে ফেসবুকিং করে তনিমাকে দেরী করিয়ে দিয়েছেন তার উপর আবার এই সাত সকালে বাংলা ভাষা নিয়ে এই হাসাহাসি তার আর ভালো লাগলো না।
তনিমা তাই ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকে উঠতে উঠতে বললেন, ‘এই সকাল সকাল মাথা গরম করিয়ে দিও না বলছি। ভুলে যেও না আমি বাংলার শিক্ষিকা। আর কোনো ভাষাতে এরকম নেই শুনি?’ ফরহাদ সাহেব বললেন,‘কেন ইংরেজি। একটি মহান ভাষা। প্রত্যেক শব্দ চমৎকার! কী তার উচ্চারণ আর কী তার মিনিং!’
‘থামো!’ তনিমা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন। এতই যদি ইংরেজির প্রতি দরদ তাহলে যাও না! যাও! ওসব দেশে গিয়ে থাকো না কেন! বারবারতো আইইএলটিএসে ফেল করছো। ইংরেজি তোমার মুরোদে কুলাবেনা বুঝলে!’ এই কথা বলে তনিমা আর দাঁড়ালেন না। গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।
Advertisement
কথাটা ফরহাদ সাহেবের খুব গায়ে লাগল। ‘কী! এত বড় কথা ইংরেজিতে ফরহাদ সাহেবের দক্ষতা নেই! অথচ স্কুলে একবার তিনি ইংরেজিতে হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছিলেন। কত পেয়েছিলেন তা আজ আর মনে নেই। তবে স্কুলের সবাই ডাব্বা পেলেও তিনিই একমাত্র পাশ করেছিলেন। আর তাকেই কি না শুনতে হলো এসব কথা। ফরহাদ সাহেব ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে ভাবতে লাগলেন, এবার থেকে কথায় কথায় তিনি একটু আধটু ইংরেজি বলবেন। বলবেনই।’
২)বাসা থেকে বেরিয়ে অফিস যেতে হলে বাসের লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। ফরহাদ সাহেব লাইনে যথারীতি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বেশ ভাল গরম পড়েছে। সকালের কাঠফাটা রোদে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা সকলেই হাঁপিয়ে উঠেছে। কেউ কেউ ছাতা মাথার উপর তুলে নিজেকে রোদের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। আর ফরহাদ সাহেব একটানা বলেই চলেছেন, ‘উহঃ কী হট! উহঃ কী হট!!’
ভাবখানা এমন যেন এই কথাটি জপ মন্ত্রের মতো বলতে পারলেই গরম লাগা কমে যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস চলে এলো। সবাই একরকম হুড়মুড় করে বাসে উঠে পড়লেন। বাসের ভেতরেও গরমের শেষ নেই। বরং মানুষের গায়ের গরমে আরও বেশি গরম লাগছে। ফরহাদ সাহেব নিজের গা বাঁচিয়ে বাসের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন। মাঝে মাঝে যখন বাস ব্রেক কষছে তখন বলছেন, ‘প্লিজ কোশন’। পাশে ছিল কতগুলো স্কুল পড়ুয়া ছাত্র। তারা ফরহাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ কোশন মানে কী?’ ফরহাদ সাহেবের প্রশ্নটি শুনে ভালই লাগল। আজকালকার ছেলে ছোকরাদের তো জ্ঞানের আগ্রহ কমেই গিয়েছে। ফরহাদ সাহেব উত্তর দিলেন, ‘প্লিজ কোশন মানে সাবধান।’
ছাত্রগুলো হেসে উত্তর দিল,‘থ্যাংকু কাকু।’ এইবার ফরহাদ সাহেব একটু মনে আঘাত পেলেন, ওরা তাকে কাকু বললো? কী এমন বয়স ফরহাদ সাহেবের। এটা কোন কথা হলো! যাকে তাকে কাকু বলা? নাহ! ছেলে ছোকরারা কিছুই শেখেনি দেখছি। ‘তাহলে কি বিয়ের পর তিনি একটু মুটিয়ে গেছেন?’ ফরহাদ সাহেব ভাবতে থাকেন।
অফিসে তার এক জুনিয়র কলিগ ইমন নিয়মিত জিম করে। ইয়া বড় বড় মাসল গজিয়েছে ওর হাতে। সে অবশ্য সেদিন ফরহাদ সাহেবকে জীমে যাবার কথা বলছিল। সেটা কী তাহলে এই কারণেই? বাসে এতক্ষণে ফরহাদ সাহেব বসার সুযোগ পেয়েছেন। পকেট থেকে ফোন বের করে তিনি ইমনকে ফোন করলেন, ‘ইমন কেমন আছো ভাই?’
ইমন ওপাশ থেকে বলল, ‘এই তো বস ভাল আছি। অফিস আসছেন তো?’ ‘হ্যা, আসছি, অন দ্য ওয়ে’ নিজের মুখে অন দ্য ওয়ে কথাটা শুনে ফরহাদ সাহেব যারপরণায় আনন্দিত। উত্তেজনায় তিনি শিহরিত হয়ে উঠছেন। হবে হবে, এইবার আইইএলটিএসে হবেই হবে।
ওদিক থেকে ইমন বলতে লাগল, ‘কী ব্যাপার বস! এই সাত সকালে কী মনে করে ফোন?’ এবার ফরহাদ সাহেব আবার তার ইংরেজি মোড অন করে দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘ইয়েস ইয়েস, আই, আই ওয়ান্ট টু অ্যাডমিশন ইন জিম’। ওদিক থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসল, ‘ফরহাদ ভাই, কী বললেন? বুঝি নাই।’
ফরহাদ সাহেবের মনটা খারাপ হলো। একটা ব্রাইট বয় ইমন। অথচ ইংরেজির অবস্থা দেখো! তথৈবচ। এবার তিনি বাংলায় বললেন, ‘আমি জীমে ভর্তি হতে চাই ইমন। অফিসে এসব নিয়ে আলাপ করা যাবে না, তাই ফোন করলাম।’ ‘আচ্ছা আচ্ছা। এই ব্যাপার!’ ইমন এবার একটু রসিকতা করেই বলল, ‘ডু ইউ ওয়ান্ট সিক্স প্যাক অর এইট প্যাক?’
ইমনের ইংরেজি শুনে ফরহাদ সাহেবের কিন্তু চোখ চকচক করে উঠল। তিনি জীমের এসমস্ত সিক্স প্যাক-ট্যাক অতশত বোঝেন না এবং জানেনও না। তাই তিনি ভাবলেন এটা বোধহয় কোনো অফার। এখনতো সব কিছুতেই সবাই অফার দেয়। প্রায়ইতো দেখা যায় টুথপেষ্টের সাথে টুথব্রাশ ফ্রী। এখন যদি জীমে তনিমাসহ কোনো অফার বাগাতে পারেন তাহলে খারাপ হয় না। তনিমার দিকে ইদানিং তাকালে মনে হয় একটি আলুর বস্তা। ফিগার টিগারের কী যে বাজে অবস্থা করেছে! ইমনের আবার জীমের সঙ্গে ভালোই যোগাযোগ।
তিনি তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন, ‘নো নো, আই, আই ওয়ান্ট নো সিক্স প্যাক, অনলি অনলি ফ্যামিলি প্যাক।’ ইমন কথাটি শুনে আর না হেসে পারলনা। বলল, ‘ভাই, অফিসে আসেন, লাঞ্চের সময় কথা হবে।’ ফরহাদ সাহেব এ যাত্রায় কয়েকটি ইংরেজি কথা বলতে পেরে বেজায় খুশি।
যথারীতি ফরহাদ সাহেব অফিসে পৌছে গিয়েছেন। ফরহাদ সাহেবদের অফিস বিল্ডিং এর ১৩ তলায়। নীচে গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফটের জন্য অপেক্ষা করেছেন। নানা রকম ফেস্টুন, বেলুন ও রংবেরঙের লেইস ফিতা ইত্যাদি দিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোর আজ খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। একটু বাদে ফরহাদ সাহেবের অফিসের কলিগ রাখি এসে লিফটের লাইনে দাঁড়ালেন রাখি আজ সুন্দর করে সেজেছেন। লাল পাড়ের সাদা শাড়ি ও খোঁপায় গোঁজা কাঠবেলির ফুলে অপূর্ব লাগছে তাকে। তবে গরমে বেশ ঘেমে উঠেছেন। মুখের ঘাম মুছে ফরহাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখেন যে, ফরহাদ সাহেব গ্রাউন্ডফ্লোরের সুন্দর ডেকোরেশন দেখছেন।
রাখি বললেন, ‘অফিসের নিচের তলা আজ খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। কয়েকদিন পর পহেলা বৈশাখ তো তাই। ইট’স ভেরি কুল! হুহ!’ আর যায় কোথায়। ফরহাদ সাহেব ইংরেজি বলার মওকা পেয়ে গেলেন। তারপর রাখির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভাবলেন। এ মেয়ে বলে কী! ইট’স কুল! মানে ঠান্ডা!! নির্ঘাত গরমে ও অফিসের কাজের চাপে রাখির মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তা না হলে এত গরমে কেউ ইট’স কুল বলে নাকি? ফরহাদ সাহেব আর নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারলেন না। রাখির সঙ্গে লিফটে উঠতে উঠতে বললেন, ‘ আই ক্যাননট কন্ট্রোল মি। বাট ইউ আর লুকিং ভেরি হট!’
রাখি ততক্ষণে একটু হোঁচট খেয়েছে ফরহাদ সাহেবের কথা শুনে। বাড়িতে বউ রয়েছে তাও অন্য নারীকে হট বলা? রাখি ফরহাদ সাহেবের দিকে চোখ গরম করে তাকালেন। লিফট এতক্ষণে ১৩ তলায় চলে এসেছে। দুজনেই নেমে পড়লেন লিফট থেকে।তারপর “আজ আপনার হচ্ছে” এরকম একটি চাহনী দিয়ে রাখি চলে গেল নিজের ডেস্কে।
সারাদিন যতবার রাখির সঙ্গে অফিসে দেখা হলো ফরহাদ সাহেবের ততবারই রাখি কেমন যেন রাগি রাগি চোখে তাকাচ্ছে ফরহাদ সাহেবের দিকে। আসলেই কাজের চাপে রাখির মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। ফরহাদ সাহেব মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন। দুপুরে লাঞ্চের সময় রাখির ম্যানেজারের সঙ্গে বসে খাওয়ার সময় ফরহাদ সাহেব তাকে অনুরোধ করলেন যেন রাখিকে কম কাজের চাপে রাখা হয়। মানুষকে একটু উপকার করতে পারলে নিজের কাছেও ভালোই লাগে।
এদিকে একটু ফুরফুরে মেজাজে মাঝে মাঝে কিছু টুকটাক ইংরেজি ঝেড়েছেন তার নিজের বস এর সঙ্গেও। বসকেও মনে হলো তার মুখে ইংরেজি শুনে বেশ খুশি। এভাবে ভালোমন্দ মিশিয়ে সারাদিনটা পার হয়ে গেল ফরহাদ সাহেবের।
৩)গত কয়েকদিন ধরেই তনিমা মুখ ভার করে ঘুরছে। ফরহাদ সাহেবের সাথে ঠিকমত কথা বলছেনা। যা কিছু বলার মেয়েকে দিয়ে বলাচ্ছে। ফরহাদ সাহেব কিছুতেই বুঝতে পারছেন না বিষয়টা কি! ফরহাদ সাহেবদের শোবার ঘর ও তাদের মেয়ের ঘরের মাঝে একটি দরজা আছে। তনিমা সাধারণত মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর নিজেদের বেডরুমে শুতে আসেন। তনিমার ফিরতে ফিরতে ফরহাদ সাহেব সাধারণত ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু আজ ফরহাদ সাহেব না ঘুমিয়ে জেগে বসে আছেন।
ফরহাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোমার? তনিমা ঝাঁঝাল কন্ঠে উত্তর দিলো, কী আবার হবে? কিছু হয়নি। বেশি কথা না বলে ঘুমাও। কাল আমার কলেজ আছে। ফরহাদ সাহেব মন খারাপ করে বললেন, তাহলে এমন ভাব নিয়ে ঘুরছো কেন কয়দিন? ঠিকমত কথা বলো না। মেয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করছ। ব্যাপারটা কি?
তনিমা আর থাকতে পারলেন না। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, অফিসের রাখিকে হট লাগে তোমার, তাই না? ফরহাদ সাহেব কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। ফরহাদ সাহেব বললেন, ঠিক বুঝলাম না। আর অফিসের ব্যাপার তুমি জানলে কি করে? তোমার ঐ হট রাখিই ফোন করেছিল আমায়। তোমাদের অফিসের পার্টিতে একবার আলাপ হয়েছিল আমার সঙ্গে। তাই এইচআর এ যাবার আগে আমাকে ফোন করে তোমার কীর্তির কথা জানিয়েছে।
ফরহাদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তা তোমার ফোন নম্বর পেল কি করে? তনিমা ঝাঁঝাল কন্ঠে বললো, কেন আমাকে ফোন করে তোমার খুব অসুবিধায় ফেলে দিল? ফরহাদ সাহেব, না। তা হবে কেন? কিন্তু আমি তো কিছু করিনি। তাহলে আমার নামে হোয়াই কপ্লেইন?
তনিমা ঝাঁঝাল কন্ঠে বললো, উঃ কিছুই করোনি। ধোয়া তুলশি পাতা! তুমি বলোনি রাখিকে যে, ইউ আর হট? ফরহাদ সাহেব হ্যা বলেছি। তাতে কি হয়েছে? তনিমা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো, ছিঃ ছিঃ তুমি এত নীচ। মেয়ে বড় হচ্ছে আর তুমি অন্য মেয়েকে হট বলো। আবার বড় মুখ করে বলছো যে, কি হয়েছে?
ফরহাদ সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কিছুতেই বুঝতে পারছেন না তিনি অপরাধটা কি করেছেন। রাখি মেয়েটা সত্যিই পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি। তনিমা বলতে লাগল, তারপর তুমি রাখির বসকে বলেছো যে, রাখিকে যেন কাজ কম দেয়। এসবের মানে কি! ঘরের বউকে বুঝি আর ভাল লাগছে না?
ফরহাদ ঠিক করলেন পুরো ঘটনা খুলে বলবেন তনিমাকে। দেখ তনিমা। সেইদিন খুব গরম পড়েছিল। আমি আর রাখি লিফটের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। গরমে তখন সবাই অতিষ্ট। এরমধ্যে রাখি বলে কি না ইট’স ভেরি কুল! হুহ!’ আমি ভাবলাম গরমে ঐ মেয়ের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তা না হলে এই গরমে কেউ ‘ঠান্ডা লাগছে’ বলে? তাই ওই কথাটি বলেছিলাম ইংরেজিতে। কিন্তু তাতে সমস্যা কি হলো যে, তুমি ও রাখি রেগে গেলে?
তনিমা তার স্বামীকে চেনেন দীর্ঘদিন ধরে। যথেষ্ঠ ভালো মানুষ তিনি। তনিমা এবার বললেন, তুমি যা বলেছো এর মানে জানো? ফরহাদ সাহেব বললেন, হ্যাঁ জানি। এর মানে ‘তোমাকে দেখে গরম লাগছে’। তোমার মাথা! ভাষা একটি চলমান বিষয়।কিছুদিন পর পর চেঞ্জ হয় এর মানে। তুমি যা বলেছো এর মানে হলো তোমাকে সেক্সি লাগছে। তুমি যৌন হয়রানির মত অপরাধ করে ফেলেছো।
ওহ! মাই গড! ইংরেজি কি বিদঘুটে ভাষারে বাবা! ফরহাদ সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বললেন। তনিমা একটু হেসে বলল, সেদিন যে খুব বললে বাংলা ভাষা যেন কিরকম! ইংরেজি খুব স্মার্ট ভাষা। দেখলে তো? সত্যিই বলছি তনু, আমি এই রকম বাজে কথা রাখিকে বলতে চাইনি। ছিঃ ছিঃ আমি রাখিকে মুখ দেখাব কি করে?” ফরহাদসাহেব আদর করে তনিমা কে তনু ডাকেন।
সে আমি কি জানি? এই জন্যই রবিঠাকুর বলেছিলেন, আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনী তারপর ইংরেজী শেখার পত্তন।যাইহোক তোমার এই অপরাধের শাস্তি হবে। শাস্তি! সে আবার কী? কী শাস্তি? শোন মা ফোন করেছিল। তোমার শালী প্রেম করছে, তনিমা একটু আদুরে গলায় বললেন।
ফরহাদ সাহেব প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, রিনিতা! বলো কি! কার সঙ্গে? সেই গোয়েন্দাগিরিই করতে হবে তোমাকে। মা ঐ ছেলের ছবি পেয়েছে রিনিতার ঘর থেকে। আমি? আমি কিভাবে করব? আমার অফিস আছে না?
সে আমি জানি না। সিক লীভ নিয়ে নাও। তুমি রিনিতাকে ফলো করে ছেলেকে দেখে নিবা। তারপর ছেলের সঙ্গে আলাদা গল্পটল্প করে কি করে, কেমন পরিবার সব বের করে নিবা।
ফরহাদ সাহেব বললেন, এ আমি পারবনা তনু। আমার অফিস আছে। আর অফিসে প্রচুর কাজ ও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে।” এবার তনিমা হুমকি দিলেন, শোন। আমি বলে কয়ে রাখিকে এইচআর এর কাছে যাবার ব্যাপারে আটকিয়ে রেখেছি। বলেছি আমি দেখছি বিষয়টা। রিনিতা এইচআর এ গেলে তোমার চাকরি থাকবে?
ফরহাদ সাহেবের নিজের স্ত্রী ও রাখির উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু কিচ্ছু বলবার নেই। কি আর করা! পরেরদিন দাঁতে ব্যাথা, ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে দাঁত তোলা লাগতে পারে এই বলে ছুটি নিলেন অফিস থেকে।তারপর শালীর পিছনে ঘুরে ঘুরে এবং সেই ছেলের সাথে ভাব জমিয়ে সব খবর বের করে ফেললেন।
রাতের দিকে নিজের বাসায় না ফিরে সোজা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেন। সেখানে তনিমাও আছে। সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে ফরহাদ সাহেবের। প্রাণ জল করে টো টো করে শালী ও তাঁর প্রেমিকের পিছনে ঘুরে বেরিয়েছেন। তাই তিনি প্রাণ জল করে ঘোরার রিপোর্ট প্রাঞ্জল ভাষায় সবার সামনে বলতে শুরু করলেন। হঠাৎ করে ইংরেজিতে বলে ফেললেন, রিনিতা লাভস অ্যা প্লেবয়। রিনিতা ভেবেছিল সে বিষয়টি এড়িয়ে যাবে কিন্তু দুলাভাইয়ের মুখে প্লেবয় শুনে আর চুপ করে থাকতে পারলনা।
সে চমকে উঠে বলল, কি যা তা বলছেন দুলাভাই? ও প্লে-বয় হতে যাবে কেন? এই রেঃ আবার ফরহাদ সাহেব ইংরেজিতে ভুল কিছু বলে ফেলেছেন। তনিমা রিনিতার কথা শুনে বললেন, তাহলে স্বীকার করলি যে, তুই প্রেম করছিস? রিনিতা একটু লজ্জা পেল।
ফরহাদ সাহেব বললেন, প্লে-বয় মানে ছেলে খেলাধুলা করে। ছেলে একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়। জাতীয় দলে চান্স পাবার খুবই সম্ভাবনা আছে। ছেলের বাবা বড় ব্যাবসায়ী মানুষ।
সবাই এ কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক প্লে-বয় বলতে অন্য সবাই যা বোঝে ছেলেটি আসলে তা নয়। হঠাৎ ফরহাদ সাহেবের তনিমার দিকে চোখ পড়ল। গরম চোখে তনিমা তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে অপ যোগে পদার্থ মানে অপদার্থ মনে হচ্ছে তার। আবার ভুলভাল ইংরেজি বলার খেসারত বোধহয় দিতে হবে। প্লেয়ারকে তিনি প্লে-বয় বলে ফেলেছেন। ভয়ে ফরহাদ সাহেবের রক্ত হিম হয়ে এলো। পুরুষমানুষ রাগী বাঘ বা সিংহের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে কিন্তু চোখ গরম করা বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা? কাভি নেহি! তনিমার এরকম চাহনী দেখলে ফরহাদ সাহেবের বাথরুম পায়। এখন সেটাই পাচ্ছে তার। তিনি ছুটলেন বাথরুমের দিকে।
তবে আর যাই হোক, রাখির উপর খুব রাগ হচ্ছে ফরহাদ সাহেবের। রাখির নির্বুদ্ধিতার জন্যই এসব হচ্ছে। ফরহাদ সাহেবের কথা ভাল না লাগলে রাখি তো তাকেই বলতে পারত বা জিজ্ঞেস করতে পারত। ওর আবার তনিমাকে ফোন করার বা এইচআরে যেতে চাইবার কী দরকার ছিল! খুব প্রয়োজন ছিল তিল কে তাল করবার! সবকিছুতেই রাখির বাড়াবাড়ি।
হঠাৎ ফরহাদ সাহেবের ফোনে একটি মেসেজ আসলো। রাখির মেসেজ। তাতে লেখা- কেমন আছেন ফরহাদ ভাই। সব খবর কি ভালো? কেমন চলছে দিন কাল? শক্ত, নরম, নাকি জমকালো? বিয়োগের পর কেমন আছে? আপনার মাড়ি ও দাঁত? এখন কি খেতে পারছেন? একটু একটু ডাল ভাত? চিবুতে পারছেন ঠিকঠাক? মাছের কাঁটা বা মুরগী দু’চারটি? দাঁতে বেশি চাপ দিয়েন না খুলে আসবে বাকি দাঁত কপাটি! খবর জানাবেন কেমন? বাই।
(পুনশ্চঃ এইচআর এর কাছ থেকে আপনার দন্ত বিয়োগের কথা শুনে এই মেসেজ লিখছি। যদিও ভাবির কাছ থেকে আসল খবর আমি জানি। হি হি … কেমন হলো শালির পিছনে গোয়েন্দাগিরি?)
রাখির এই মেসেজ পেয়ে রাগে ক্ষোভে ফরহাদ সাহেবের গা পিত্তি জ্বলে গেল!
ছবি: সংগৃহীত
প্রিয় পাঠক, আপনিও অংশ নিতে পারেন আমাদের এ আয়োজনে। আপনার মজার (রম্য) গল্পটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়। লেখা মনোনীত হলেই যে কোনো শুক্রবার প্রকাশিত হবে।
কেএসকে/জিকেএস