মতামত

শীতার্তদের পাশে দাঁড়াই

দেশজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ আর ঘনকুয়াশায় জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। তীব্র শীতে ভাসমান, ছিন্নমূল ও শ্রমজীবী মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতেও বাড়ছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। এ অবস্থায় শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। ঋতু বদলের পরিক্রমায় প্রকৃতিতে যেন স্বরূপে ফিরেছে শীত। কিন্তু ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে এবারের শীতের আবির্ভাব বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও অসময়ে ঋতু বদলের ধারাবাহিকতায় এবারের শীতের প্রকোপ কয়েকগুণ বাড়বে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীর মার্কেটগুলোতে শীতের পোশাক বিক্রির ধুম পড়েছে।

Advertisement

গত কয়েক দিন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে শীতের তীব্রতা অনেক বেড়েছে। বর্তমান শৈত্যপ্রবাহ আর ঠান্ডা দেশের উত্তরাঞ্চলের নিম্ন আয়ের জনগণ অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করছে, সেই সাথে ডায়রিয়া, জ্বর, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।

শীতকালে দেশের কোথাও শীত বেশি কম হতেই পারে, এতে কারও হাত নেই, এটি প্রাকৃতিক। তবে এক্ষেত্রে শীতার্তদের জন্য আমাদের অনেক কিছুই করণীয় আছে। সরকারের পাশাপাশি আমরাও পারি শীতার্তদের জন্য আমাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে।

আমরা দেখতে পাই, প্রতি বছরই এ সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গরিব, অসহায় মানুষ শীতের তীব্রতায় খুব কষ্ট করেন। যাদের কাছে শীতের মোকাবিলা করার মতো তেমন কোনো বস্ত্র থাকে না, যার ফলে বিভিন্ন অসুখ-বিসুখেও তাদের ভুগতে হয়। এসব লোককে সাহায্য করাই হলো বান্দার অধিকার আদায় করা আর এমনটা করাই ইসলামের শিক্ষা। এর মাধ্যমেই সৃষ্টিকর্তা তার বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হোন। যারা আল্লাহর বান্দার কষ্টের সময় সহযোগিতা করে আল্লাহপাক তাকে তার বন্ধু বানিয়ে নেন। তাই আল্লাহকে লাভ করতে হলে অসহায়দের সাহায্য করা একটি বড় মাধ্যম। আমরা সহজেই আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি এসব অসহায় শীতার্ত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে। এ জগতে কেউ যদি বস্ত্রহীন, ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্তকে আহারের ব্যবস্থা করে তাহলে আল্লাহপাক তাকে অসংখ্য নেয়ামতে ভূষিত করেন। যেভাবে হাদিসে বর্ণিত আছে, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, সেদিন তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে’ (আবু দাউদ)।

Advertisement

এই শীতে হাজার হাজার গরিব মানুষ অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে, সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে ছোট ছোট শিশু ও বৃদ্ধাদের। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সমাজ ও দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। শীতের এই দিনগুলোতে যেই যেই স্থানের জনগণ সবচেয়ে বেশি কষ্ট করছে আমাদের সবার দায়িত্ব হবে সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের সহযোগিতা করা।

আমাদের সবার একটু সহযোগিতার ফলে একটি পরিবার, একটি শিশুর মুখে হাসি ফুটতে পারে। আমরা কী পারি না এসব শীতার্তের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে? আমরা কী পারি না তাদের দুঃখের দিনের বন্ধু হতে? মানুষ হিসেবে কী আমাদের ওপর এই দায়িত্ব বর্তায় না তাদের সাহায্য করা? সমাজে অনেক এমন মানুষও রয়েছেন যারা সবসময় অন্যের সাহায্যের জন্য নিবেদিত থাকে, চলুন না তাদের সাথে নিজেকেও সম্পৃক্ত করে নেই। শীতার্তদের সাহায্যের জন্য দেশের বিত্তশালী, বিভিন্ন এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ সাধারণ মানুষকে পাশে দাঁড়ানো উচিত। আসলে এই প্রচণ্ড শীতে যারা বেশি কষ্ট করেন তারা নিতান্তই গ্রামের সহজ-সরল দরিদ্র মানুষ। আমরা যদি সবাই মিলে এদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই তাহলে হয়তো তারা এই শীতটা হয়তো কিছুটা আরামে অতিবাহিত করতে পারবে। অবুঝ শিশুদের মুখেও হাসি ফুটে উঠবে। এসব লোকদের জন্য আমাদের অনেক কিছুই করার আছে, আমাদের সবার সম্মিলিত সহযোগিতার ফলে হাজারো মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সহায়ক হতে পারে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক মানুষকে স্বার্থপর ও কৃপণ হতে নিষেধ করেছেন। স্বার্থ ছাড়া কোনো কাজেই হাত দেব না বলে যারা প্রতিজ্ঞা করে, তাদের চিন্তা করে দেখা উচিত। মানুষ যদি বাস্তবিক মানুষকে ভালোবেসে থাকে তবে সবার ব্যথায় ব্যথিত হবে ও সবার দুঃখে দুঃখিত হবে এটাই সত্য। কারও শরীরের কোনো অঙ্গ যদি আঘাত পায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে তবে সে কী আনন্দ পায়? বরং কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক। সমাজের এক অংশ ক্ষুধার্ত, ব্যাধিগ্রস্ত, বস্ত্রহীন হলে অপর অংশ তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে। এটাই প্রতিটি ধর্মের শিক্ষা আর এর ফলেই সুষ্ঠু ও বলিষ্ঠ জাতি গড়ে উঠবে।

প্রত্যেহ সৃষ্টি সেবার কত সুযোগই না পাওয়া যায়, যেগুলো পালনের জন্য আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কিন্তু আমরা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করি না বরং অবহেলা করি, অবজ্ঞার চোখে দেখি। স্রষ্টার সৃষ্টিকে অবহেলা করে স্রষ্টা তুষ্ট করা যায় না। মানুষের দুঃখ ও ব্যথায় ব্যথিত হয়ে, তাকে মনে প্রাণে অনুভব করে, তার প্রতিকার করার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই হচ্ছে ধর্মের শিক্ষা।

প্রত্যেক ব্যক্তি যদি তার দায়িত্বের প্রতি সজাগ থাকে তবেই সৃষ্টি সেবার মহান এক সংঘ গড়ে উঠবে। অপরের প্রতি অনুকম্পা, সহানুভূতি, উদারতা ও দয়া প্রদর্শন করা আজ আমাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দয়া হতে দানশীলতার সৃষ্টি হয়। দানশীলতা ও সেবা করা মানবচরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য আর নির্দয় ব্যক্তি পাষাণবৎ। অপরের অশ্রু দর্শনে যার হৃদয় বিগলিত হয় না, সে জনসেবার দাবি করতে পারে বটে, কিন্তু কার্যত কোনো উপকারই করতে পারে না। দুঃখীর দুঃখমোচন, বিপন্নকে উদ্ধার, শোকাতুরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা সৃষ্টি সেবার অন্তর্ভুক্ত। লোক দেখানো দয়া, দান, উপাসনাকে সৃষ্টিকর্তা পছন্দ করেন না। কর্তব্যানুসারে জনসেবা করতে হবে প্রকাশ্যে ও গোপনে। তবে এতে বিনয় অবলম্বনই শ্রেয়। সব ধর্মই মানবসেবার কাজকে পুণ্য বলে আখ্যায়িত করেছে। সেবার উৎসাহ না থাকলে অন্ধ, খঞ্জ বধিররা করাল গ্রাসে নিপতিত হতো। মানবসেবায় মন উদার হয়। এতে আনন্দ লাভ করা যায়।শীতজনিত রোগব্যাধি থেকে মানুষজনকে রক্ষার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তীব্র শীতে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ যাতে কষ্ট না পায় সেজন্য গরম কাপড় সরবরাহ করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সরকার নয়, সমাজের বিত্তবানরা এজন্য এগিয়ে আসতে পারেন। শীতের কবলে কাঁপতে থাকা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে, তাদের প্রতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে আমার-আপনার-আমাদের সবাইকে। তাই আসুন, আমরা আমাদের সাধ্য অনুসারে নিজেদের প্রতিবেশী গরিব ও অসহায়দের পাশে দাঁড়াই।

Advertisement

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।masumon83@yahoo.com

এইচআর/ফারুক/জিকেএস