রফিকুল ইসলাম জসিমবিয়ে হলো একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সামাজিক রীতিতে বিয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই সম্পর্কে জাতিভেদে বিভিন্ন রীতিনীতির পার্থক্যও থাকে অনেক। বাংলাদেশে চা বাগানে বসবাসরত প্রায় ৯৮টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রয়েছে। তবে এই সব জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণে চা বাগানগুলো সমৃদ্ধ। চা বাগানে অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর পৃথক ভাষা, রীতিনীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সব রয়েছে।
Advertisement
চা বাগানে তেলেগু জনগোষ্ঠীর বিয়ের রীতিনীতি খুব আকর্ষণীয় এবং অনন্য। তেলেগুরা তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানকে তেলুগিন্তি পেলি বলে। এই সম্প্রদায়ের আগেকার সময়ে বিয়ের অনুষ্ঠান তাদের ঐতিহ্যগতভাবে ১৪ দিন ধরে পালন করা হলেও কিন্তু আধুনিক যুগের সাধারণ এখন ৫ দিন বা ৩ দিন লাগে। এটি পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। জাগোনিউজের বিশেষ আয়োজন বিয়েশাদির আজকের পর্বে জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের চা বাগানে বসবাসরত তেলেগু জনগোষ্ঠীর বিয়ের রীতিনীতি-
চা বাগানে বসবাসরত নাইডু, রাও, রেড্ডি, কুর্মী, ছালিয়া, অলমিক, তাঁতি, রেলি, তেলেঙ্গা, তেলি, গোয়ালা ও মান্দ্রাজি এই গোত্রগুলো তেলুগু জনগোষ্ঠী হিসেবেই পরিচিত। এদের বিয়ের রীতিনীতি বেশ বিচিত্র। তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে বর এবং কনের উভয় পক্ষের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা একসঙ্গে বিয়ের সব কাজ করেন। তেলেগুরা বিশ্বাস করেন যে বিয়ে দুটি মানুষের মিলন নয়, দুটি পরিবারের মিলন। তাদের বিয়ের সজ্জায় বেশিরভাগই থাকে উজ্জ্বল রঙের ফুল এবং আম পাতা। বিয়ের আগে দুই পরিবারই তাদের বাড়িঘর সংস্কার করেন এবং পরিবার ও সম্প্রদায়ের সবাইকে আমন্ত্রণ জানান।
বিয়ের প্রস্তাব ও পাকাকথাতেলেগু জনগোষ্ঠীর বিয়ের আগে পাকাকথার আয়োজন করা হয় চৌধুরী বাড়িতে। বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের কয়েকদিন পূর্বে এটি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া ও বিয়ে সংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনা করা হয়। বর ও কনে উভপক্ষের আত্মীয় স্বজনরা উপস্থিত থাকেন। এ পর্ব থেকে থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলে বিয়ের সম্ভাব্য দিনক্ষণ এবং এই অনুষ্ঠানেই বিয়ের যাবতীয় কথা পাকা করা হয়। এখানেও মুখরোচক খাবারের বিশেষ আয়োজন করে থাকে।
Advertisement
‘মঙ্গলা স্নানম’ ও পোশাক পরিধানতেলেগু রীতিতে বিয়ের অনুষ্ঠানে বর ও কনেকে প্রথমে শুভ সময়ে নিজ নিজ বাড়িতে হলুদ মাখানো হয় এবং তারপর বিয়ের আচারের আগে তাদের শরীর ও মনকে পরিষ্কার করার জন্য হলুদ জল দিয়ে পবিত্র স্নান বা গোসল করানো হয়। এই অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় ‘মঙ্গলা স্নানম’ (‘মঙ্গলা’ মানে পবিত্র, ‘স্নানম’ মানে স্নান)। স্নান বা গোসলের পর বর ও কনেকে বিয়ের পোশাকের প্রথম সেট পরানো হয়। এর পরে ‘মঙ্গলা আর্থি’, একটি ছোট প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং একটি থালায় হলুদ, সিঁদুর এবং চন্দন কাঠে নিয়ে বর ও কনের সামনে প্রদক্ষিণ করা হয়। এটা করা হয় তাদের মন্দ চোখ থেকে সুরক্ষিত রাখতে এবং বিয়ের সব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য।
গণেশ ও গৌরী পূজাগৌরী পূজা করেন কনে তার নিজের বাড়িতে এবং গণেশ পূজা করেন বর, বিয়ের অনুষ্ঠানস্থলে। নববধূ দেবী গৌরির কাছে প্রার্থনা করেন কারণ তিনি উর্বরতা এবং মাতৃত্বের প্রতীক এবং দেবীর স্বামী শিবের সঙ্গে একই ধরনের আদর্শ সম্পর্কের জন্য প্রার্থনা করেন। গৌরী পূজা করা হয় বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যায় বিবাহের শুরু রীতির অংশ হিসেবে যার নাম ছিল প্রধানম। কনে মণ্ডপে প্রবেশ করার আগে (যে মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্মে বিবাহ হয়), বর গণেশ পূজা করে। সব শুভ অনুষ্ঠানগুলো হিন্দু ধর্মে গণেশ পূজা দিয়ে শুরু হয় যেহেতু তারা বিশ্বাস করেন গণেশ শুভ কাজের যে কোনো বাধা দূর করে বলে বিশ্বাস করা হয়। তাই গণেশ পূজা হলো প্রথম অনুষ্ঠান যা অনুষ্ঠানস্থল বা মণ্ডপে হয়।
বর-কনের প্রবেশ এবং তেরসালাতেলেগু জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যে অনুযায়ী নববধূকে একটি খড়ের ঝুড়িতে বসানো হয় এবং কনের মামা তাকে মণ্ডপে নিয়ে যায়। কনের ভাই প্রথমে প্রবেশদ্বারে বরের পা ধুয়ে দেয় এবং তাকে ও তার পরিবারকে মণ্ডপে নিয়ে আসে। বিয়ের মূল অনুষ্ঠান রীতি সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত, বর এবং কনে একে অপরের দিকে তাকাতে পারবে না তাই তাদের মধ্যে একটি পর্দা স্থাপন করা হয় যাকে বলা হয় আদ্দুতেরা বা তেরসালা (‘তেরা’ মানে পর্দা)।
কন্যাদান এবং পানিগ্রহন পর্বকন্যাদান অর্থ ‘বধূকে দান করা’ (‘কন্যা’ অর্থ যুবতী এবং ‘দান’ অর্থ প্রদান/দান)। এই অনুষ্ঠানে কনের পরিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বরের হাতে তার হাত দেয়। প্রথমত, কনের বাবা-মা বরকে ভগবান বিষ্ণুর প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করে বরের পা ধুয়ে দেন, যিনি তাদের মেয়েকে দেবী লক্ষ্মী হিসেবে বিবেচনা করবেন। তাদের পবিত্র মন্ত্র এবং ‘সানাই মেল্লাম’ (ক্লারিনেটের সংগীত) উচ্চারণের মধ্যে কনের বাবা-মা তাদের মেয়ের হাত বরের হাতে রাখেন এবং তাদের মেয়েকে বিসর্জন দেন। সনাতনধর্ম অনুসারে, ‘কন্যাদান’ অত্যন্ত মহৎ একটি কাজ হিসেবে বিবেচিত হয় যা একজন পিতা সম্পাদন করতে পারেন। এরপর বরকে কনের হাত ধরে রাখতে বলা হয় যাকে বলা হয় ‘পাণিগ্রহনম’ এবং কনের পিতামাতাকে প্রতিশ্রুতি দিন যে তিনি তার সঙ্গী থাকবেন সঠিকভাবে, আর্থিকভাবে, ইচ্ছার দ্বারা, আধ্যাত্মিকভাবে, আমি তার কাছ থেকে দূরে যাব না।
Advertisement
বিয়ের চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতাকন্যাদান এবং পানিগ্রহন পর্বের পর বর ও কনে পবিত্র আগুনের (ওঁম) চারপাশে সাতটি পদক্ষেপ নেওয়া জড়িত। বর প্রথম তিন রাউন্ডে এবং কনে পরবর্তী চার রাউন্ডে নেতৃত্ব দেয়। পরে বর-কনে মালা বিনিময় করে যা বর এবং কনে একে অপরকে অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করে। বিয়ের অনুষ্ঠানিক পর নব-বিবাহিত দম্পতি পিতা-মাতা সহ উপস্থিত সকলের আশীর্বাদ গ্রহণ করে সব প্রবীণরা দম্পতিকে ‘এচছেনতালু’ (হলুদ গুঁড়া মিশ্রিত চালের দানা) দিয়ে আশীর্বাদ করেন এবং ছোটরা তাদের অভিনন্দন জানায়। অতিথিরা বিয়ের কনে ও বরকে উপহার সামগ্রী প্রদান করেন। বিয়ের রাতে বর কনেসহ আত্মীয় স্বজনরা সারারাত আনন্দ উল্লাস করেন। সকালে রিকশা করে চা বাগান পরিদর্শন করানো হয় বর কনেকে। বিয়ের সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কনের পরিবার আনুষ্ঠানিকভাবে কনেকে বরের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। এই অনুষ্ঠানের পর কনে মণ্ডপ থেকে বরের সঙ্গে তার বাড়িতে চলে যায়।
‘আংটি খোঁজা’ খেলার আয়োজনতেলেগু বিবাহের সবচেয়ে সুন্দর আয়োজন রীতি হলো ‘আংটি খোঁজা’ খেলা আয়োজন। এই খেলায় পানির পাত্রের ভেতরে ২টি আংটি (একটি সোনা এবং একটি রৌপ্য) ফেলে দেওয়া হয়। বর এবং কনে তাদের ডান হাত পানির পাত্রের মধ্যে রাখে এবং আংটি খুঁজতে থাকে। দেখা হয় কে প্রথমে সোনার আংটি বাছাই করে। ৩ বার সুযোগ দেওয়া হয় বর-কনেকে, যে দুইবার সোনার আংটি খুঁজে পায় সে বিজয়ী এবং বলা হয় বিয়েতে তারই হাত রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও খাবারবিয়ের সময় সব ঘর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিষ্কার করে চকচকে করা হয়। তারা সাধারণত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো নারীদের তেলেগুরা চিরা (শাড়ি) এবং লাঙ্গা ওনি (হাফ শাড়ি) এবং পুরুষের পাঞ্চা (ধুতি), জুব্বা (কুর্তা) এবং লুঙ্গি। বিয়ের দিন তারা এই পোশাকই পরেন।
তবে তেলেগু জনগোষ্ঠীর বিয়ের উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হলো ঐতিহ্যবাহী তেলেগু খাবার। এর মধ্যে অন্যতম সুস্বাদু একটি পদ হলো গুট্টি ভাঙ্কায়া কুরা (বেগুন ভাজা)। যেটি তাদের জনপ্রিয় উদ্ভিজ্জ খাবারের মধ্যে একটি, যা তৈরি করা হয় তেলুগু রন্ধন শৈলীতে। অন্যান্য কিছু সুস্বাদু খাবারের মধ্যে রয়েছে মুদ্দা পাপ্পু (লবণ দিয়ে রান্না করা সাধারণ তুর ডাল), আভাকায়া (গরম আমের আচার) এবং চাক্কারাপোঙ্গালু।
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
কেএসকে/জেআইএম