বিদায়ী ২০২২ সাল বগুড়া জেলার জন্য ছিল কিছুটা অস্থিরতার বছর। এই সময়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ইস্যু ভুগিয়েছে সবাইকে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা, কিশোর অপরাধীদের আগ্রাসন, নানা কারণে খুনোখুনি ও মাদকের ব্যবহার ছিল আশঙ্কাজনক।
Advertisement
দেখা গেছে নানা ইস্যুতে বছরজুড়ে উত্তপ্ত ছিল জেলার রাজনীতির মাঠ। বছরের শেষভাগে জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির বিপক্ষে একাংশের আন্দোলনের কারণে অস্বস্তিতে পড়ে জেলা আওয়ামী লীগ। এ সংকট কাটাতে শেষ পর্যন্ত দলীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ করতে হয়। অন্যদিকে নতুন কমিটি, বিভাগীয় সম্মেলন নিয়ে মাঠে সরব ছিল বিএনপি।
বছরের শুরুতে গাবতলী উপজেলায় পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে গুলিতে রিকশাচালক, দিনমজুর ও গৃহিণীসহ চারজন নিহত হন, যা দেশজুড়ে আলোচিত হয়। ৬ জানুয়ারি গাবতলী উপজেলার বালিয়াদীঘি ইউনিয়নের কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানান, ভোটগ্রহণ শেষে গণনা না করেই সংশ্লিষ্টরা ব্যালট বাক্স উপজেলা সদরে নিতে চাইলে ভোটাররা তাতে বাধা দেন। ফলাফল ঘোষণার দাবি করেন। একপর্যায়ে কেন্দ্রের বাইরে সড়ক অবরোধ করা হয়। এসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে লাঠিপেটা করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। একপর্যায়ে জনতা ভোটকেন্দ্র ঘেরাও করলে পুলিশ-বিজিবি ভোটকক্ষের জানালা দিয়ে গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলেই গৃহবধূ কুলসুম, সবজি বিক্রি করতে আসা কৃষক আবদুর রশিদ, দিনমজুর খোরশেদ এবং রিকশাচালক আলমগীর নিহত হন।
Advertisement
দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত শিক্ষানবিশ আইনজীবী
গেলো বছর বগুড়া জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভুগিয়েছে সবাইকে। এসময় খুন, ধর্ষণ, চুরি, অপহরণ, নারী নির্যাতনসহ নানা অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাদক বিক্রি ও সেবন। ২০২১ সালে বগুড়া জেলায় সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৫৩টি অপরাধ সংঘটিত হলেও ২০২২ বছরের তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজারে ঠেকে।
তথ্য বলছে, এই অঞ্চলে দিনদিন খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আধিপত্য বিস্তার, পূর্বশত্রুতা ও তুচ্ছ ঘটনায় বাড়ছে এসব হত্যাকাণ্ড। অনেক হত্যাকাণ্ডে কিশোররাও জড়িয়ে যাচ্ছে। একইভাবে অস্ত্রধারী কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।
২০২১ সালে বগুড়ায় খুন হয় ৮২ জন। চলতি বছরে হয়েছে ৯০ জন। এছাড়া পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে মোট পাঁচ হাজার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এরমধ্যে ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে দুটি, দস্যুতা ৩১, ধর্ষণ ১১৪, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ সাতটি, অপহরণ ১৪৪, নারী নির্যাতন ৭৭, শিশু নির্যাতন ৬৮, সিঁধেল চুরি ৩৩, গরু চুরি ২৩, গাড়ি চুরি ২৭, অন্যান্য চুরি রয়েছে ৯৭, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছয়, পর্নোগ্রাফি ১৬, মোটর দুর্ঘটনা ৬০, অস্ত্র উদ্ধার ১৪৭, বিস্ফোরক দ্রব্য ১৫, জখম ৬২৮, মাদক দ্রব্য আইনে আরও প্রায় ২ হাজার ৪০০টি মামলা হয়েছে। এছাড়া পুলিশ আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে ১০টি। গত এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে দুস্যতা, খুন, ধর্ষণ অপরহন, সিঁধেল চুরি, গাভী চুরি, গাড়ি চুরি, অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার।
Advertisement
বগুড়ায় আলোচিত খুনের ঘটনাগুলোর কুল কিনারা হলেও এখনো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বর মাসের শুরুতেই খুন হন শিক্ষানবিশ আইনজীবী আব্দুল বারী চাঁন। গত ১ নভেম্বর সকালে জমি সংক্রান্ত বিরোধে সদর উপজেলার চকফরিদ এলাকায় ধারালো কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে তাকে গুরুতর আহত করা হয়। পরে গত ৫ নভেম্বর সকালে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান তিনি।
সদরের নামাজগড় এলাকায় গত ১১ নভেম্বর রাতে বিলিয়ার্ড (পুল) খেলাকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতের জুনায়েদ আল-হাবিব বিপুল নামে এক যুবক নিহত হন। গত ৪ নভেম্বর রাতে পূর্ব শত্রুতার জেরে ছুরিকাঘাতে ১৭ বছর বয়সী রবিউল ইসলাম রবিন নামে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। সদরের গোদারপাড়া এলাকায় ছুরিকাঘাতের শিকার হন রবিন।
এর আগে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ৯ জুন বগুড়া সদরের সাবগ্রাম ঘুনিয়াতলা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে রবিন ইসলাম নামে এক তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ৩ জুন বগুড়া সদরের কলোনী বটতলা এলাকায় ছুরিকাঘাতে খুন হন আল জামিউল বনি নামে ২২ বছরের এক শিক্ষার্থী। গত ৩১ মে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায় ছাগলে ঘাস খাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে ৪০ বছরের হানিফ প্রামাণিক নামে একজনকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। এছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যানের ব্যাটারি ছিনতাই করতে নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে চালককে হত্যা করে ব্যাটারি ছিনতাই হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই আবার ঘটছে শ্বাসরোধ করে। পারিবারিক ও জমি সংক্রান্ত বিরোধেও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
অন্যদিকে, গত জানুয়ারি মাসে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ এলাকায় জহুরুলনগরের একটি বাড়ির প্রাচীরে ‘শুধুমাত্র দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’ লেখা পোস্টার সাঁটিয়ে দেশজুড়ে আলোচিত হন আলমগীর হোসাইন। পড়াশোনা শেষে হন্যে হয়ে একটা ভালো চাকরি খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি। অন্যের বাসায় জায়গির হিসেবে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়। সন্ধ্যায় একটি বাসায় ছাত্র পড়ানোর বিনিময়ে রাতের খাবার খান। পরে বগুড়ার পুলিশ সুপারের উদ্যোগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয় আলমগীরের।
বছরের শেষদিকে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে জেলা। ৭ নভেম্বর বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওইদিন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে জেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ৩০ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। কমিটি ঘোষণার পরপরই শহরের টেম্পল সড়কে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে জড়ো হন পদবঞ্চিত ও কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়া নেতারা। ওই ভবনে ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সব সংগঠনের কার্যালয়। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা কমিটি প্রত্যাখ্যান করে ওই ভবনের ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। এরপর লাগাতার আন্দোলন ও বিক্ষোভ করেন পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি বাতিলের দাবিতে এক মাসের বেশি সময় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে রাখেন বঞ্চিত অংশের নেতাকর্মীরা। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পুলিশের সহযোগিতায় নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তালা ভেঙে কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন।
দুইবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাওয়া আলমগীর কবিরকে চাকরি দেয় সুপারশপ স্বপ্ন
বছরের শেষদিকে ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে বিভাগীয় গণসমাবেশ এবং ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে হঠাৎ চাঙা হয়ে ওঠে বিএনপির রাজনৈতিক অঙ্গন। দলের নেতারা জানান, রাজশাহী ও ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে বগুড়ার ১২টি থানায় ককটেল হামলার অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় বিএনপির প্রায় ৬০০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা ৭০০ জনকে। তারপরও তারা মাঠে ছিলেন সরব। এর আগে ২ নভেম্বর জেলা বিএনপির সম্মেলন হয়। বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা সভাপতি এবং আলী আজগর তালুকদার হেনা সম্পাদক নির্বাচিত হন।
বিগত বছরে বগুড়ার আরও একটি আলোচিত বিষয় ছিল বিয়ের কাবিননামায় দেনমোহর হিসেবে ১০১টি বই নেওয়ার ঘটনা। এতে আলোচনায় আসেন নিখিল নওশাদ ও সান্ত্বনা খাতুন দম্পতি। দুজনেই পড়াশোনা করেছেন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে। কবিতার সূত্র ধরেই পরিচয় হয় নিখিল-সান্ত্বনার। পরিচয় থেকে ভালো লাগা, ভালোবাসা। শেষে দুজনই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। তখন সান্ত্বনা শর্ত দেন, দেনমোহর হিসেবে ১০১টি প্রিয় বই উপহার দিতে হবে। প্রিয় বইয়ের তালিকাও দেন নিখিলের হাতে। ১৬ সেপ্টেম্বর নিখিল-সান্ত্বনার বিয়ে সম্পন্ন হয়।
এছাড়া বগুড়ায় যানজট নিয়ে সারাবছর সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। শহর ও শহরতলীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম ছিল ব্যাপক। সেই তুলনায় ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো ছিল না। শহরবাসীর অন্যতম একটি দুর্ভোগ এখন যানজট পরিস্থিতি।
সার্বিক পরিস্থিতিতে সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়ার সাধারণ সম্পাদক কে জি এম ফারুক বলেন, ২০২৩ সালে হত্যাকাণ্ডসহ সব অপরাধ রোধে বিট পুলিশিং ব্যবস্থা জোরদার ও সার্বিক মনিটরিং বৃদ্ধির সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। পুলিশ উদ্যোগী হলেই ৫০ ভাগ অপরাধ কমানো সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আব্দুর রশিদ বলেন, খুনসহ যেকোনো ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান চলছে। বগুড়া জনবহুল একটি জেলা। এ জেলায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুন বেশি হয়। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সামাজিকভাবে আলোচনা সভা করা হচ্ছে। সবার সহযোগিতা নিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, নতুন বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো হবে।
এমআরআর/জিকেএস