মতামত

একটি ব্যতিক্রমী পুনর্মিলনী

‘গাছেরা পাতা বদলায়, শিকড় বদলায় না।’১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ২৮তম ব্যাচের যে সব ছাত্র-ছাত্রী ডাক্তারি পাস করেছিল, তারা আবার ফিরে এসেছিল তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে তাদের নাড়ির টানে, বন্ধুদের ভালোবাসার টানে।

Advertisement

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ২৮তম ব্যাচকে বলা হয় গুণী ছাত্রদের পাওয়ারহাউজ। সময়ের পরিক্রমায় এই ছাত্ররা এখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের নামি-দামি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা করছেন, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রাখছেন।

বাংলাদেশের সারাপ্রান্ত, আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ থেকে ২৮তম ব্যাচের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ছুটে এসেছিল তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে। অনেকেই সাথে করে নিয়ে এসেছিল তাদের পরিবার-পরিজন।

এ পুনর্মিলনীর স্বপ্ন দেখেছিল এ ব্যাচের ইংল্যান্ড নিবাসী প্রথিতযশা ইউরোলজিস্ট ডা. আব্দুল মাবুদ চৌধুরী ফয়সাল। বেদনা জনকভাবে কোভিড অতিমারির শুরুতেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে জীবন হারান ফয়সাল। তার স্মৃতি বুকে ধরেই এ পুনর্মিলনীর নাম ছিল ‘ফয়সাল স্মারক পুনর্মিলনী’।

Advertisement

এ পুনর্মিলনী শুরু হয়েছিল কলেজের সব বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলগুলোতে সৌজন্য ভোজসভার মাধ্যমে। প্রাক্তন ছাত্ররা বর্তমানের ছাত্রদের সাথে তাদের হোস্টেলে একসাথে বসে নৈশভোজ করেছেন, মতবিনিময় করেছেন এবং তাদের পুরোনো আবাহনগুলো ঘুরে দেখেছেন। পঞ্চম বর্ষের ছাত্র মুনিব অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানালো এমনটি আগে হয়নি। অনেকেই পুনর্মিলনী করেন, তবে কেউ তাদের মনে রাখেন না। মুনিব মনে করেন যে এটি একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে ২৮তম ব্যাচ। তারা এখনকার ছাত্রদের কথা মনে রেখেছে। তাদেরও আনন্দের ভাগিদার করেছে।

পরদিন সমাবেশের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরুর পর সব প্রাক্তন শিক্ষককে সম্মাননা প্রদান করেন তারা। এটিও ছিল একটি অনন্য আয়োজন। এরপর কলেজের শিক্ষক আর গুণীজনদের জন্য করা হয় বিশাল ‘চাঁটগাইয়া মেজবান’। রাতে অনুষ্ঠিত হয় ২৮তম ব্যাচের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মাইলস ব্যান্ডের কনসার্ট।

এ পুনর্মিলনীর একটি অসাধারণ অংশ ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের জন্য একটি ‘ডিজিটাল এডুকেশনাল আই টি হাব’ তৈরি করে তা কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা। ২৮তম ব্যাচের বন্ধুরা ডা. ফয়সালের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এ আই টি হাবটির নামকরণ করেন।

মেডিকেল কলেজের মাননীয় অধ্যক্ষ অধ্যাপিকা শাহেনা এবং একাডেমিক কাউন্সিল এ জায়গাটি হস্তান্তর করেন। আইএফআইসি ব্যাংক এ ব্যাপারে সর্বোতভাবে সহয়োগিতা করে। প্রায় দেড়শ’ ছাত্র একই সময় বসে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের ডিজিটাল শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে এখানে। অনেকগুলো কম্পিউটার, প্রিন্টিং সেন্টার এবং একটি লাউঞ্জ রয়েছে। প্রায় চল্লিশটি জার্নালের ডিজিটাল সাইটে প্রবেশাধিকার থাকবে ছাত্রদের।

Advertisement

এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো মেডিকেল কলেজে প্রাক্তন ছাত্ররা এ ধরনের একটি পদক্ষেপ নিলেন যার মাধ্যমে মেডিকেল কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকরা ডিজিটাল এবং ভার্চুয়াল শিক্ষার সম্পূর্ণ সুযোগ পাবে। ইচ্ছা মতো ডিসট্যান্ট বা দূরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রমে সংযুক্ত হতে পারবে।

এই দৃষ্টান্ত হতে পারে যে কোনো মেডিকেল অ্যালামনাইদের জন্য একটি অনন্য পদক্ষেপ।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অনুষ্ঠান শেষ করে ২৮তম ব্যাচের চিকিৎসকরা দুদিন কক্সবাজারে সি পার্ল রিসোর্টে মেতে ওঠে পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনে। ৩০ বছর পর ২৮তম ব্যাচের এ অসাধারণ পুনর্মিলনীতে সব চিকিৎসক স্মৃতি রোমান্থন করেছেন, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ উল্লাসে মেতেছেন, গান কবিতা নাচে রাঙিয়ে তুলেছেন তাদের উৎসব, কিন্তু ভুলে যাননি তাদের উৎস, প্রাক্তন ও বর্তমানের শিক্ষকদের, কলেজের প্রতি কাদের কর্তব্য এবং বর্তমান ছাত্রদের।

পৃথিবীর সব বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত হয় অ্যালামনাইদের অনুদানে এবং অংশগ্রহণে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ২৮তম ব্যাচের চিকিৎসকরা একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে রইবেন এবং অনুপ্রেরণা হবেন অন্যান্য চিকিৎসক অ্যালামনাইদের।

লেখক: অরলান্ডো প্রবাসী চিকিৎসক।

এইচআর/এমএস