কৃষি ও প্রকৃতি

বিক্রি বেড়েছে মাদারীপুরের খেজুর গুড়ের

শীত বাড়ার কারণে মাদারীপুরের ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড় বিক্রি বেশি হচ্ছে। তবে আগের মতো খেজুর গাছ না থাকায় গুড়ে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ মানুষের। তবুও খেজুর গুড় কিনতে ভিড় দেখা যায়। এদিকে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমাণ গুড় বেশি বিক্রি হয়। শীত এলেই এ গুড় প্রবাসীরাও নিয়ে যায়। যুগ যুগ ধরে মাদারীপুরের এ গুড়ের সুনাম ও এতিহ্য এখনও মানুষের মুখে মুখে।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে মাদারীপুর জেলায় ৫ লাখের মতো খেজুর গাছ আছে। তবে এ জেলায় একসময় এরচেয়ে অনেক বেশি খেজুর গাছ ছিল। গাছগুলো ইটভাটার মালিকরা প্রভাব খাটিয়ে প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে দিন দিন খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে। এতে ঐতিহ্যবাহী খেজুরের রস, গুড় ও পাটালি কমে যাচ্ছে। গাছিরাও (শিউলি) পেশা ছেড়ে ভিন্ন দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।

মফিজ হাওলাদার, জয়নাল ফকির, রেজাউল হক, আবুল কালাম আজাদ জানান, তারা একসময় খেজুরের রস ও গুড় বিক্রি করে অনেক টাকা রোজগার করতেন। বর্তমানে ইটভাটায় প্রতিনিয়ত খেজুরগাছকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করায় দিন দিন গাছ কমে যাচ্ছে। ফলে আগের মতো এ পেশায় তাদের সংসার চলে না। তাই যে যার মতো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন বলেন, ‘শীতের সময় মাদারীপুরের প্রবাসীরা খেজুর গুড় নিয়ে বিদেশে যান। তারা বিদেশে নিজেদের জন্য, পাশাপাশি অন্যদের উপহার দেওয়ার জন্যও এ গুড় নিয়ে যান। অনেকেই বিদেশে গুড় বিক্রিও করেন। আমাদের মাদারীপুর জেলা খেজুর গাছ জন্মানোর জন্য সবচেয়ে ভালো। তাই এ জেলায় খেজুর গুড় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।’

Advertisement

আরও জানা যায়, উৎপাদন হ্রাস পেলেও মাদারীপুর সদর উপজেলাসহ কালকিনি, রাজৈর ও শিবচর উপজেলায় যুগ যুগ ধরে খেজুর রস দিয়ে তৈরি ঐতিহ্যবাহী মধুখণ্ড ও পাটালি গুড় সবার পরিচিত ও প্রিয় খাবার। জেলা ছাড়াও দিন দিন এ গুড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি ইতালি, দুবাই, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, লন্ডন, কুয়েত, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা যাচ্ছে এ গুড়।

সরেজমিনে জানা যায়, আগে পাটালি গুড়ের ছোট ছোট খণ্ডের প্রচলন ছিল। এখন এর পাশাপাশি এক একটি খণ্ড আড়াই থেকে পাঁচ কেজি ওজনের থালা আকৃতির হয়ে থাকে। এ পাটালি গুড় জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তা পরিচিতি পাচ্ছে মধুখণ্ড নামে। সরাসরি নেওয়া ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের জন্য কুরিয়ার ও ডাকযোগে পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। মাদারীপুরে আসা অতিথিদের বিদায়ের সময় উপহার হিসেবে দেওয়া হয় পাটালি গুড়। যতই দিন যাচ্ছে; ততই কদর বাড়ছে এ গুড়ের। এ জেলার খেজুর রস দিয়ে তৈরি পাটালি গুড়ের খ্যাতি রয়েছে দেশব্যাপী। এ গুড়শিল্পের সুনামের পেছনে আছে এখানকার আবহাওয়া ও অনুকূল পরিবেশ।

মাদারীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামের গাছি ও ব্যবসায়ীরা পাটালি গুড় শহরে আনেন বিক্রির জন্য। এরপর পাইকাররা এ পাটালি গুড় কিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে দেন। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে খেজুরের গুড় তথা পাটালি গুড়কে কেন্দ্র করে আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কও যেন নতুন করে সুনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে।

এ ছাড়াও শীত এলেই এক শ্রেণির মানুষের আত্মকর্মসংস্থান বাড়ে। কেউ খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে তা বিক্রি করেন। কেউ খেজুর রস কিনে গুড় বানিয়ে তা পাইকারি বিক্রি করেন। আবার কেউ সেই গুড় কিনে শহরের লোকালয়পূর্ণ জায়গায়, বিশেষ করে রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় বসে খুচরা বিক্রি করেন। যত শীত বাড়বে; ততই এ ব্যবসা বেশি হবে। মাদারীপুর শহরের পুরাতন কোর্ট এলাকায় গুড় বেশি বিক্রি হয়। এ ছাড়াও স্বর্ণকার পট্টি, লেকপাড়, মস্তফাপুরসহ বিভিন্ন বাজারে এ গুড় পাওয়া যায়। গুড়ের গুণগত মান অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে কেজিপ্রতি ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

Advertisement

মাদারীপুর শহরের গুড় বিক্রিতা কালাম মুন্সি বলেন, ‘গাছ কমে যাওয়ায় গাছিদের কাছ থেকে চড়া দামে রস কিনে পাটালি গুড় বানাতে হচ্ছে। তাই গুড়ের দাম বেশি।’

শহরের পুরানকোর্ট এলাকার লালচান শরীফ ও আনোয়ার শরীফ জানান, এখন পাটালি গুড় প্রকারভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিন ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকার গুড় বিক্রি হয়। তবে কখনও কখনও প্রতিদিনই ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজারের মতো বিক্রি হয়ে থাকে।

লন্ডন থেকে এবার শীতে বেড়াতে আসা মাদারীপুরের তানজিম সিদ্দিকা, আরিফ হোসেন, দুবাই থেকে আসা রাকিব হক, আক্তার হোসেন খান, ইতালি থেকে আসা জাকির হোসেন, রাসেল হোসেনসহ প্রবাসীদের পরিবারদের কাছ থেকে জানা যায়, মাদারীপুরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। আর দেশে অবস্থানকারী আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে এ পাটালি গুড় পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। ওইসব দেশের অধিবাসীরা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে পাটালি গুড় পেয়ে খুব খুশি।

মাদারীপুরের পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অব নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজন মাহমুদ বলেন, ‘মাদারীপুরের মাটি খেজুর গাছ জন্মানোর জন্য উপযোগী। এখানে অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে ওঠা এ খেজুর গাছগুলোর রস থেকেই গুড় তৈরি হচ্ছে। যদি এখানে আলাদাভাবে খেজুর গাছ চাষ করা হয়। তবে এখানকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। মাদারীপুরের গুড় বিদেশে রপ্তানি করে টাকা অর্জন করা সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো একটু এগিয়ে এসে বেকার যুবকসহ যারা এ পেশায় কাজ করছেন, তাদের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে দক্ষ করে উৎসাহ দিলে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব।’

মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস বলেন, ‘সাধারণত মাদারীপুরে প্রাকৃতিকভাবেই খেজুরগাছ জন্ম নেয় ও বেড়ে ওঠে। এ জেলায় এর আলাদা কোনো চাষাবাদ নেই। যে কারণে প্রতিনিয়ত যে হারে খেজুর গাছ ধ্বংস হচ্ছে; সে হারে জন্ম নিচ্ছে না। ফলে আশঙ্কাজনকহারে খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে। তবে এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত।’

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, ‘খেজুর গাছ, রস ও গুড় মাদারীপুরের ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে বেশি করে খেজুর গাছ লাগাতে হবে। এরই মধ্যে আমি বিভিন্ন সভা-সেমিনারে খেজুর গাছ লাগানোর জন্য সবাইকে অবহিত করেছি এবং উৎসাহ দিয়েছি। পাশাপাশি ইটভাটায় যেন খেজুরগাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার না করে, সে ব্যাপারেও সর্তক করা হয়েছে।’

এসইউ/এমএস