মতামত

বর্ণমালা যখন বর্ণহীন

আটপৌরে বাঙালিয়ানাকে ধারণ করেই চলছে নীরা আর রাতুলের সংসার। নুন আনতে পানতা হয়তো ফুরায় না কিন্তু সচ্ছলতাও যেন ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে অন্দরমহলে ঢুকতে সঙ্কোচবোধ করে। কিন্তু তাতে কী? সুখ কিন্তু খেলে যায় সমগ্র বাড়ি জুড়ে। নীরা রাতুলের একমাত্র সন্তান রিমঝিমের ফোটা আধবোলে মুখরিত হয়ে ওঠে দু কামরার সাজানো জগৎ। আর তুলতুলে পায়ে রিমঝিম যখন ছুটে বেড়ায় বেলকোনির এমাথা ওমাথা তখন যেন খুশির বান আনে নীরার মাতৃত্বে।  এভাবেই গড়িয়ে চলে সময়, তারিখ, মাস এমনকি সাল বদলায় দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারের পাতায়। দেখতে দেখতে রিমঝিম বেড়ে ওঠে নীরা রাতুলের স্বপ্নেরই মতো। সামনে মেয়ের স্কুলে ভর্তি। তাই আয় রোজগারটাকেও একটু ঝালিয়ে নিতে হবে। নীরার খুব শখ শহরের কোনো নামিদামী স্কুলে রিমঝিমকে দিবে। আর যে দিনকাল পড়েছে তাতে তো অবশ্যই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হতে হবে। বাংলা মিডিয়ামে পড়িয়ে তো আর সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে না! যেমনি চিন্তা তেমনি সিদ্ধান্ত। শহরের নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের খোঁজ নিতে বলে রাতুলকে। আর মেয়েকে একটু একটু করে বর্ণমালার তালিম দিতে লাগে নীরা ঘরে বসে। প্রায় সারাদিনই নীরা রিমঝিমকে শেখায় “এ, বি, সি, ডি”। তালিম যে ভালোমত এগুচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চার বছরের রিমঝিম এখন সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই বলছে “হ্যালো গুড মর্নিং” তা যতোই হোক না কেন দুপুর বিকেল কিংবা রাত। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের খরচের বহর দেখে রাতুল এরই মাঝে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এবং কিছুটা হতাশও বটে। এমনও কোনো কোনো স্কুল আছে যার ভর্তি ফি লক্ষ টাকাকেও ছাড়িয়ে। আর স্কুলের বেতন? সে টাকায় তো সারা মাসের সংসার খরচ হয়ে যায়। কিন্তু কিছুই বুঝতে নারাজ নীরা। নীরার সেই এক কথা “এই জমানায় বাংলা দিয়ে কিচ্ছু হবে না, বাংলা স্কুলে দিয়ে একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া চলে না।"উপায়-অন্ত না দেখে অবশেষে পাড়ার একটি তথাকথিত ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডার গার্টেন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় রাতুল রিমঝিমকে। শুরু হয় রিমঝিমের নতুন পথচলা। টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার এর আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় চাঁদ মামা। আর ব্যা ব্যা ব্লাকশিপের ভীড়ে দেখা মেলে না হাট্টি মাটিম টিমদের। স্কুলের অনুষ্ঠানে নীরা মেয়েকে সাদাকালো পোশাকে সাজিয়ে পাঠায় একুশে ফেব্রুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল মাদার্স ল্যাংগুয়েজ ডে পালন করতে। কিন্তু রিমঝিমের জানা হয় না রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরদের নাম। রিমঝিমের সাদাকালো পোশাক কতোটা শোক শ্রদ্ধা জানাতে পারলো ভাষা শহীদদের প্রতি সে বিচারে না গিয়েও স্পষ্টভাবে রাতুল উপলব্ধি করে উৎসবের রং সাদাকালো ক্রমশই বর্ণহীণ করে তুলছে আমাদের ইতিহাস, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের প্রাণের বর্ণমালাকে। ২০১৬ এর কোনো এক রাতে যখন রাতুলের ভাবনারা বিদ্রোহ করে উঠছে তখনই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্ন “এখানে আরেকটা কালচার দেখা যাচ্ছে, আরেকটা জিনিস আমরা লক্ষ্য করি। সেটা হলো ছোট ছোট শিশুদের ইংরেজি মিডিয়ামে না পড়ালে যেন ইজ্জত থাকে না। এই চিন্তাটা চলে এসেছে। আমি অনেক সময় জিজ্ঞেস করি কয়টা ইংরেজি মিডিয়ামের ছেলে ভালো রেজাল্ট করেছে? হাতে গুনে পাওয়া যায় না। তাহলে এ ধরনের মানসিকতাটা কেন থাকবে?” একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে রবিবার ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের প্রবণতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলা ভাষাটা ভুলে যাওয়া যেন বিরাট একটা গুণের কাজ, বাংলাকে বিকৃত করে ইংরেজি অ্যাকসেন্টে বলার চেষ্টা-অনেকেই মনে করে ওটাও তাদের একটা বিরাট গৌরবের বিষয়।" অতি বিচক্ষণতার সাথে যথার্থই পারিপার্শ্বিকতার মূল্যায়ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তবুও প্রশ্ন-কী করছি আমরা? কী হবে আমাদের সন্তানদের পরিচায়ক? কেনইবা আজ আমাদের এমন মানসিকতা?এ যতো না মানসিকতা তারচেয়ে ঢের বেশি মানসিক বৈকল্য। একটি মানুষের অস্তিত্বের ধারক বাহক পরিচায়কের অনন্য উপাদান ব্যক্তির সমাজ সংস্কৃতি। আর সংস্কৃতির অপরিহার্য চালক ভাষা। ভাষার মর্যাদা নিয়ে যখন ব্যক্তি কোনোরকম দীনতা বা হীনমন্যতায় ভোগে তখন প্রকৃত অর্থে সে নিজের মর্যাদা সংকটে ভোগে। এবং নিজ অস্তিত্বকে দ্বিধাগ্রস্ত করে ব্যক্তির মাঝে একরকম অস্বস্তিকর পরিচয় সংকটকে উস্কে দেয়। ব্যক্তি এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং নিজ দীনতাকে আড়াল করার জন্য সন্তানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। পাশাপাশি নিজের যে বিষয়কে সে অক্ষমতা হিসেবে ভাবে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য সন্তানদের মধ্য দিয়ে সে বিষয়ের প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা চালায়। ব্যক্তির এমন মানসিক অবস্থা নিঃসন্দেহে অস্বাস্থ্যকর এবং নিজের ও অন্যের জন্যও অস্বস্তির কারণ হতে পারে। সমাজে মর্যাদার মাপকাঠি নির্মাণের দায় জ্ঞানের। কিন্তু জ্ঞান যখন অসম্পূর্ণ কিংবা ত্রুটিপূর্ণ তখন সংকট অনস্বীকার্য। বিদেশি ভাষা শেখা অথবা অন্য দেশের কৃষ্টি-কালচার জানার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। বরং নিঃসন্দেহে তা ব্যক্তির মানসপটে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং উদারতা, মনের উম্মুক্ততাকে এক অর্থে নিশ্চিত করতে পারে।কিন্তু শৈশব থেকেই একটি শিশু যখন নিজ কৃষ্টি, মূল্যবোধ, রীতিনীতির সাথে যথাযথভাবে পরিচিত না হয়ে পরের শেখানো বুলিতে জগৎকে দেখার চেষ্টা করে তখন জগৎ দেখবে বৈকি, কিন্তু নিজ অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে। আর অস্তিত্বের সংকটে ভোগা মানুষ কখনো জীবনে যথার্থই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কারণ ব্যক্তির পারিপার্শ্বিকতা, নিজের দেখা-উপলব্ধি ভিন্ন অন্যকোনো আরোপিত কিছু ব্যক্তিকে গ্রহণ করতে হলে সে ওই বিষয়ে অভ্যস্ত হয় হয়তো কিন্তু কখনোই তা আত্মস্থ করতে পারে না। ফলে জীবনের পদে পদে সম্পর্কের টানাপোড়েন, সামাজিকতায় পিছিয়ে পড়া, অনুভূতির জগতে বিচ্ছিন্নতা এমনকি বাবা-মায়ের সাথে চিন্তা যুক্তির পৃথিবীতে নিজেকে একা নিঃসঙ্গ পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। সে কারণে সন্তানের সুস্থ্য স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রথমেই তাকে নিজ ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, মূল্যবোধ, বর্ণমালার  সাথে পরিচিত করুন। ব্যক্তিকে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে অহংকারী হয়ে উঠতে দিন। লক্ষ্য রাখুন আধুনিকতার পোশাকি চাকচিক্যে যেন বর্ণহীন না হয়ে যায় আমাদের সন্তানের পরিচয়। রংছুট যেন না হয় আমাদের আরেক সন্তান বর্ণমালা। লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/পিআর

Advertisement